Friday, April 17, 2009

মাহবুব মোর্শেদের নোট পড়ুন, -খালেদা জিয়ার বাড়ি

Today at 10:57am
খালেদা জিয়ার বাড়ি
Share
Wed 5:05am
মন্ত্রিসভা খালেদা জিয়ার মইনুল রোডের বাড়ির বরাদ্দ বাতিল করার সংবাদ গুরুত্ব সহকারে মিডিয়াগুলা প্রচার করলো, দেখলাম। তবে এই সংবাদ প্রচারে তারা বহুবার জেনারেল জিয়ার বিধবা স্ত্রী, তারেক-কোকোর দুর্নীতি এইসব বিষয় গুরুত্ব দিয়া উল্লেখ করছে। হরে দরে মিডিয়াগুলা খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থিকা তাড়ানোর ব্যাপারে একমত হইছে এইটা বুঝা যায়। ভাল কথা। মিডিয়ার লোকেরা, বুদ্ধিজীবীরা কী কী যুক্তি দিতেছেন সেইটাও খিয়াল করলাম।
বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের বিষয়টা জাতীয় রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পরিণত হইছে। হ্ওয়ারই কথা। কারণ এই বাড়ি শুধু বাড়ি না, বরাদ্দ বাতিলও শুধু বরাদ্দ বাতিল না। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাতিলের বিষয় এইটা আসলে না। এইটা আসলে কী?
সেনাবাহিনীর সাথে বাংলাদেশের অসামরিক রাজনীতির বুঝাপড়ার নতুন মাত্রা এই বাড়ি দিয়া নির্ধারিত হইতে যাইতেছে বইলা ধারণা করা যায়। জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রীকে দুইটি বাড়ি দিছিলেন জেনারেল এরশাদ। দুইটা বাড়ির একটা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত। এরশাদ কইছেন, উনি জানতেন না যে খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন। এরশাদের জানার কথা না। কারণ এরশাদ নিশ্চিত আছিলেন যে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতি জাতীয় পার্টি গঠনের মাধ্যমে বিএনপির হাত থিকা তার পকেটে গিয়া ঢুকবে। খালেদা জিয়া পলিটিক্যালি নিঃস্ব হয়া পড়বেন। তাই তিনি তৎকালে সেনাবাহিনী, দলত্যাগী বাংলাদেশী ন্যাশনালিস্ট ও ওই রাজনীতির লোকদের সহানুভূতি আকর্ষণের জন্য খালেদা জিয়াকে দুইটা বাড়ি দিছিলেন। বলা যায়, ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে খালেদা জিয়া সুখে আছিলেন। ওই বাড়িতেই তার রাজনৈতিক অভীপ্সার বিকাশ ঘটছিল। উনি এরশাদের দুর্বলতার সুযোগে আবারও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সমর্থিত ব্রিফকেস অভ্যস্ত স্যুট-টাই পরিহিত ভদ্রলোকদের জাতীয়তাবাদী ক্লাবটিকে মজবুত করেছিলেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদরে ব্রান্ডিং এরশাদের পকেট থেকে বের করে নিজের কবলে নিয়েছিলেন। সব মিলায়ে ৯০এর অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসছিলেন।
তখন ও পরে যে কোনো সময় বাংলাদেশের অপরাপর অসামরিক রাজনৈতিক শক্তিগুলা বিশ্বাস কইরা আসছে যে, মইনুল রোডের বাড়িটা খালেদা জিয়ার শক্তির অন্যতম খুঁটি। কিন্তু ওই বাড়ি থিকা তাকে বাইর কইরা দেওয়ার সাধ্য ও সাধ কারো হয় নাই। কথিত আছে, মহাপরাক্রমশালী তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার আগে দশবার ভাবছিল শুধু ওই বাড়ির কারণে।
খালেদা জিয়া ওইখানে নিরাপদে থাকেন। সেনাবাহিনীর মনোভাব বুঝতে পারেন। রাস্তায় চলতে গিয়া অনেকের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয় এইটা অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলার চক্ষুশূল হয়া থাকতে পারে। সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এইটারে তারা বাধা হিসাবেও দেখতে পারে। ফলে, সুযোগ পাইলে খালেদাকে সেনানিবাস ছাড়া করার সুযোগ তারা ছাড়বে না এইটা সহজবোধ্য। শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাইতে হয় যে, তিনি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে খালেদা জিয়ার নিবাস কাইড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। পিলখানায় শহীদ সেনাকর্মকর্তাদের পরিবারের বাসস্থানের জন্য শহীদ জিয়ার পরিবারের বাসভবন ছাড়তে হবে খালেদা জিয়াকে।
এর মধ্য দিয়া।
১. সেনাবাহিনীর দরদ কোন শহীদ/শহীদদের প্রতি বেশি সেটা পরীক্ষা হয়া যাবে।
২. পিলখানা শহীদদের ব্যাপারে খালেদা জিয়া কতটা স্যাক্রিফাইস করতে পারেন সেইটা বুঝা যাবে।
৩. এই বাড়ির আইনগত ভিত্তি কেমন মজবুত তা পরীক্ষা হয়ে যাবে।
৪. খালেদা জিয়াকে শেষ পর্যন্ত তাড়াতে না পারলেও আওয়ামী লীগ যে মরণ কামড় দিতে পারছিল সেইটার শক্তি পরীক্ষা হবে।
এখন প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনীতির জিম্মাদার হিসাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অধিকতর সমর্থন পাইতেছে সন্ত্রাসবিরোধী রাজনীতির নায়কদের কাছ থেকে। যে কালে যে আচার, বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো দেশে এই আচারে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে প্রগতিশীল আচরণ করতে হইতেছে। স্বাভাবিকভাবে বিএনপির সাথে তাদের মারিফতি ঐক্যের বদলে এখন আওয়ামী লীগের সাথে প্রাকৃতিক মৈত্রী তৈয়ার হইছে। কিছু ঝামেলাজনক এলিমেন্ট নাই তা না। কিন্তু সেনাবাহিনীকে মোটাদাগে প্রগতিশীল ভূমিকা এখন নিতেই হবে।
এই প্রাকৃতির মৈত্রীর সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে সরিয়ে সেই মারিফতি যোগাযোগ নষ্ট করতে চাইতেছে। রাজনীতির চাল হিসাবে এইটাও খারাপ না। কিন্তু এর মধ্য দিয়া আওয়ামী লীগ বিএনপির জায়গায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে চাইতেছে, যে জিনিশটা খুবই খারাপ।
খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে থাকতে পারবেন না কেন?
কারণ ওইখানে থাইকা উনি পলিটিক্স করেন। বেশ। ওনার ওইখানে থাকা অবৈধ। দুইটা বাড়ি নেয়া অবৈধ।
তাইলে ওইখানে বৈধভাবে থাইকা যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন তাদের ব্যাপারে সরকার কী বলেন?
ওইখানে না থাইকা যারা ওইখানকার চাওয়া পাওয়া রাজনীতিতে বাস্তবায়ন করেন তাদের ব্যাপারে শেখ হাসিনা কী বলেন?
দেশ সুরক্ষার জন্য যারা শপথ নিয়া অস্ত্র ধারণ করেন তারা রাজনৈতিক অভিলাষ প্রদর্শন করলে সেইটারে যে অন্যেরা উৎসাহ দেয় সেইটারে কী বলা যায়।
আমাদের সমাজে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের যে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি তার উৎস কোথায়? সবাইরে তো এরশাদ বাড়ি দিয়া প্রতিষ্ঠা করে নাই। ধরলাম, সেনানিবাসে একা খালেদাই রিয়েল বাড়ি দখল কইরা আছেন কিন্তু যারা ভার্চুয়াল বাড়ি কইরা আছে? কবি এইখানেই নীরব।
কথা হলো আওয়ামী লীগ কোনো গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য থিকা খালেদা জিয়াকে উৎখাত করতে চাইতেছে না। ফলে, ছাগমাতার তৃতীয় সন্তানের মতো যারা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তকে গণতন্ত্রকে বেসামরিকায়নের পদক্ষেপ হিসাবে দেখতেছেন তারা ভুল দেখতেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে চোখ বুলাইলে বুঝা যায়, ভুল শীঘ্রই ভাঙিবে।

মাহবুব মোর্শেদের মূল নোটটি দেখতে ক্লিক করুন নিচের লিংকে-
http://www.facebook.com/home.php?#/note.php?note_id=182188695313&ref=mf


Updated on Wednesday · Comment · LikeUnlike · Report Note
You, Omar Sharif Pallab, Angelica Lima and 11 others like this.
Omar Sharif Pallab, Angelica Lima and 11 others like this.
Niaz Morshed Chowdhury
Niaz Morshed Chowdhury at 5:32am April 15
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতাদের কথা-বার্তা থেকে শুরু করে স্বীদ্ধান্ত দেয়া পর্যন্ত এক ধরনের ছেলেভোলানো আচরন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বর্তমান সরকার রাজনীতির এক অন্য ধারা দেখাচ্ছে জনগনকে। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি তাদের নির্বাচনে সমর্থন করেছিলাম। পরবর্তিতে তাদের মন্ত্রীসভা দেখেও আশান্বীত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি খেলাটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। প্রায়... Read More সকল সিনিয়ার নেতাকে বাহিরে রেখে যে মন্ত্রীসভা গঠন করা হলো, সেটা রাজনীতির একটা দারুন চালই ছিল বলতে হবে। এবার খালেদা জিয়াকে তাড়ানোর জন্য যে চালটা দেয়া হয়েছে সেটা সম্ভবত স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে কঠিন চাল। (চলছে)
Niaz Morshed Chowdhury
Niaz Morshed Chowdhury at 5:33am April 15
আগের মন্তব্যের পর থেকে....

সেনাবাহিনীর আবেগকে সাথে নিয়ে খালেদা জিয়াকে সরানোর এই টাইমিংটা সরকার কাজে লাগিয়েছে। তার উপর তারেক জিয়ার দুর্নিতীর কথা এখনও জনগনের মাথায় আছে। তাছাড়া শুনতে পেয়েছি প্রধানমন্ত্রী তার একটি জমিও নাকি দান করেছেন। ফলে এখন খালেদা জিয়াকে সেনানিবাস ত্যাগ করা ছাড়া আর কোথাও চাল দেয়ার অবকাশ তারা রাখেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে এত গভীর চাল দেয়া সম্ভব, এবারই আমি প্রথম দেখলাম।

সত্য কথা বলতে কি, আমি বিষয়টাকে এখন রীতিমত উপভোগ করছি! কোন ড্রামা সিরিয়ালের থেকে এটা মত নয়!!!
Mahbub Morshed
Mahbub Morshed at 5:36am April 15
great bangladeshi darama.
Niaz Morshed Chowdhury
Niaz Morshed Chowdhury at 5:38am April 15
কোন ড্রামা সিরিয়ালের থেকে এটা কম নয়!!! (কারেকশন)
Mahbub Morshed
Mahbub Morshed at 5:40am April 15
humm
Raafiq Hariri
Raafiq Hariri at 6:38am April 15
We dont like to see plying of politics. Whenevere we need more food,more work,more secure life, more secure independent land country.What the hell is going on. Our politician(Poluted) again going to do teir old job.They have no fear of food they have no fear of work and money(They have demand of money)so they like to play kabadi,hado do and rokter ... Read Moreholy khela.
Honurable Niaz as a ordinary people I Cannot enjoy it(This drama.) I M afraid about it that we r going to see another confliction. May be Our poluted politician have no job to do.
Sayeed Jubary
Sayeed Jubary at 8:02am April 15
খালেদা জিয়ারে ক্যান্টনমেন্ট থিকা বাইর করার চাইতে ক্যান্টনমেন্ট ঢাকার বাইরে পাঠায় দেয়ার দাবিটা জোরে শোরে তোলা দরকার মনে হয়, আপনি কি কন?
Mahbub Morshed
Mahbub Morshed at 8:09am April 15
amar mote cantonment dhakay thaka valo.
Fatema Abedin Nazla
Fatema Abedin Nazla at 9:15am April 15
dhaka theke rajdhanitai shoray nea dorkar. joto boro boro sthapona ase shbo shoho.
ar apnar bishleshon valo. kintu lekhar vongi valo lage nai
Saifullah Mahmud Dulal
Saifullah Mahmud Dulal at 10:12am April 15
modhobitter moto kore tule dhoresen.
Tamal Tml
Tamal Tml at 11:27am April 15
আমি ঠিক বুঝলাম না এরশাদ কিভাবে বাড়ি দিল !! সেসময় বিচারপতি সাত্তার এর সরকার ছিল। আমার জানামতে সেই সরকার এই বাড়িটি বরাদ্দ করেছিল। এরশাদ তখন সেনাপ্রধান ছিলেন। সুতরাং অফিসিয়ালি বাড়ি দেয়ার এখতিয়ার তার থাকার কথা নয়।কিন্তু মিডিয়া, আওয়ামী-নেতাকর্মী, এরশাদ এমনকি মাহবুব মোর্শেদও তাই বলল। বিষয়টা নিয়ে আমি কনফিউজড।

তবে এ বিষয়ে আমি মোটেও কনফিউজড না যে এটা মোটাদাগে একটা বাজে-রাজনীতি।

আমি আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক কখনই ছিলাম না। তবে এদফায় তাদের মন্ত্রীপর্ষদ আমার বেশ ভালো লেগেছিল। আমি আশ্চর্য হয়ে ভেবেছিলাম সত্যিসত্যি এবার তারা 'পরিবর্তনের রাজনীতি' শুরু করবে। এক ধরনের ভালোলাগা বোধ তৈরী হচ্ছিল।... Read More

কিন্তু মুখোশটা দ্রুতই খুলে পরল।
Farhan Daud
Farhan Daud at 12:06pm April 15
dhaka city te 10-12 ghonta koira loadshedding,eidike chatro league dapaya beraitase campus gula,ordhek varsity bondho,jinisher daam abar bartase,ato shomossha raikha beti lagse khaledar bari nia. eigular ar shikkha hoibo na,akbare minus koira dile jaane bachtam.
Trivuz Nētwōrk
Trivuz Nētwōrk at 2:50pm April 15
একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য যুক্ত করি- শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোয় আর্মির বিশাল ভূমিকা ছিলো...... কিছুদিন আগে এরশাদ সাহেব বলেছিলেন।
Mourshed Uddin
Mourshed Uddin at 4:36pm April 15
fazlamir r shima nai...amago tothakothito boroboro rajnitibidgo. farhan vai ja koise akmot...ki korteche eraa tar chotto nomuna….

1. HSC porikha shuru hoitase...std ta loadshading er jonno porashuna korte parchena...nishshondehe bola jai porikhkhar hall eo loadshading hoibo...r odik e dokkhin asiar brihottom shopping mall hoitase ektar por ekta (puratai air conditioned!!!!).
2. Borokortago (WB/IMF type er organization) poramorsho onujayi Public uni gulare 2020 shaler moddhe dhongsho korar nil noksha…
3. TIFA…transit …koyla khoni to achai…shob hochche desh bikri koraar Imperialistic plan !!!... Read More

Ato matro tatkhonikvabe mathai je koyta common issue ashlo ta bollam…khujle shoto shoto baar hoibo…basically BNP/BAL/JAMAET/JAPA…arokomshobgular rajnaitik chorittre kono tofaat nai…
jara ek khana bari niya shokol Mohol e erokom ghoraar moto procharona korbaar lagse… shai ershader amol thekka jara ek khana barir shomoshsha shomadhan korte parenai..tara ki govt hishabe bertho noi??? … eder KUTTAMIR chorittro apner ekta kotha diya bujha jai---“...shekh hasinake ovinondon janaite hoi je, tini shothik shomoy shothikvabe khaleda ziar nibash KAIRA NEYAR shidhdhanto nite parsen” ai ‘KAIRA NEYA’ shobdotai enough ader rajnitir name KUTTAMI bujhar jonno…r upore ullekhito issu gula niya jatiyo shartho birodhi nongra rajniti ullekhito shobgula dol e borabor e kore jachche…goto 2 jug er o beshi shomoyer rajnaitik etihash tai bole & aki rajniti obbaheto ache…eder dara amra r kono shopno dekhte parina…
Mourshed Uddin
Mourshed Uddin at 5:32pm April 15
valo issue remind koraisen...thnk u...vabchi amr ai lekha tukui ektu modify kore ami note hishebe post korbo...
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:36pm April 15
Mr. M. Morshed, have you been Blind? Did you tried to read others , what they are saying or you are only focusing what is coming out as your news paper editorial?

Please read the following article by Sunita Paul.

Is there any government in Bangladesh?... Read More
Sunita Paul
April 11, 2009
Cross section of people in Bangladesh may raise a straight question to each-other. Is there any government in Bangladesh? With my knowledge and what I gather from the media, it is evident that, there is surely a government in Bangladesh, working hard for its survival. I am citing only a few examples, which will possibly give a convincible response to the questions of many:

1. Ruling ´Grand Alliance´ government in Dhaka led by Bangladesh Awami League recently decided in a Cabinet Meeting to cancel the lease of residence of the leader of the opposition, Mrs. Khaleda Zia, inside Dhaka garrison area. This decision was taken just in less than 20 hours from Prime Minister Sheikh Hasina Wajed´s call to the leader
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:37pm April 15
1. Ruling ´Grand Alliance... Read More´ government in Dhaka led by Bangladesh Awami League recently decided in a Cabinet Meeting to cancel the lease of residence of the leader of the opposition, Mrs. Khaleda Zia, inside Dhaka garrison area. This decision was taken just in less than 20 hours from Prime Minister Sheikh Hasina Wajed´s call to the leader of the opposition to vacate the house for constructing multi-storied apartments for the murdered army officers, who were killed during the Bangladesh Riffles (BDR) massacre during February 25-26.

2. Bangladesh Nationalist Party (BNP) has already started limited demonstrations and protests against this decision of the government. US State Department officials were quoted by News World from New York stating that, this decision of the government was ´unnecessary´ and was aimed at creating ´undue political issue´.
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:37pm April 15
3. Why the ruling government may create ´undue... Read More´ or ´unnecessary´ political issue? Response is not very complex. It is well publicized by now that Sheikh Hasina Wajed´s new government is certainly feeling shaken at the ongoing investigation into the BDR Massacre issue. Especially they are concerned at the investigation conducted by army probe committee, which may submit report anytime within May.

4. Several Bangladeshi newspapers are continuing publishing news scoops quoting probe committees, giving some details on the conspiracy behind the barbaric massacre, which not only caused lives of army officers but dignity of a large number of female members of their families.
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:38pm April 15
5. Bangladesh Awami League... Read More´s leader Torab Ali Akhand and his son Leather Liton (a notorious terrorist), BDR deputy assistant director (DAD) Towhid confessed to the interrogators giving details of the conspiracy. According to facts disclosed by them the matter of ´blueprint´ to stage the massacre and kill army officers were already within the knowledge of a number of influential members of the government. They are Sheikh Hasina Wajed´s cousin and influential leader of Bangladesh Awami League, Sheikh Fazlul Karim Selim; Sheikh Hasina Wajed´s nephew and Member of Parliament Sheikh Fazley Noor Taposh and Home Minister Advocate Sahara Khatun.

6. Criminal Investigation Department (CID) sources reported came to know that members of ´angry´ BDR men sat in a number of secret meetings at the residence of Sheikh Fazlul Karim Selim and Barrister Fazley Noor Taposh. Holding of such meetings began from October last year. Barrister Taposh assured the BDR men that once his party comes in power, the i
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:38pm April 15
7. There are allegations of involvement of Bangladesh Awami League... Read More´s student wing leader Harunur Rashid aka Leather Liton and his brother-in-law Rezaul Karim Razu with the brutal massacre conspiracy as well as of helping the fleeing mutineers.

8. According to information, the kingpins of the massacre met Barrister Fazley Noor Taposh at his office of 17-18 December with their demands. During the meeting, BDR men decided to vote for ´Boat´ symbol and help Barrister Taposh in winning the election.

9. ¾ days after the election and declaration of landslide victory of Bangladesh Awami League, some leaders of BDR met Taposh at his electoral office at Sky Center at Dhaka´s Dhanmondi area. Subsequently, the kingpins of BDR massacre met Barrister Taposh´s uncle and influential leader of the ruling party, Sheikh Fazlul Karim Selim on February 13, 2009 at 9:00 pm at his residence at Banani residential area in Dhaka, with their demands. He (Sheikh Selim) told them that, the matter was not within
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:38pm April 15
10. Later, the BDR men met Home Minister Advocate Sahara Khatun and pressed forward their demands. They went to ´Imperial Rest House... Read More´ and the residence of the Home Minister at least thrice to meet her. As they could not meet the Home Minister, a written copy of their demands were handed over to the personal secretary to the minister and subsequently, the kingpins were able to communicate with Advocate Sahara Khatun over cell phone on a number of times.

11. Later, the kingpins of the massacre prepared a leaflet (which was later distributed inside the BDR headquarters on February 24) and sent copies of it to Barrister Fazley Noor Taposh, Sheikh Fazlul Karim Selim, Home Minister Advocate Sahara Khatun and Prime Minister Sheikh Hasina Wajed.
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:39pm April 15
12. Subsequently, the kingpins decided to hold the director general of BDR and other senior officer hostage to press their demand. A number of leaders of Bangladesh Awami League gave them this suggestions with the hope that, once the officers are held hostage, the government will quickly accept their demands.

13. While, the issue of anger within ... Read MoreBDR was already within the knowledge of some of the influential members of the ruling party, this message also reached the attention of anti-army elements like Mohiuddin Khan Alamgir, Jahangir Kabir Nanak, Mirza Azam etc. This angry section of leaders started efforts in turning the hostage plan to murder and rape conspiracy with the goal of ´giving a proper lesson´ to army for their ´anti politician offensives´ during the anti-corruption drive.
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:40pm April 15
15. There are similar instructions with Criminal Investigation Department to avert any involvement of Awami League leaders behind the conspiracy and bring out a ´eye-washing´ report to the nation. Officers are given promises of ´multiple benefits´ once they will be able to ´cool down´ the entire issue.
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:40pm April 15
16. Meanwhile, huge volume of counterfeit currency was recovered from a residential hotel named Imperial Guest House in Dhaka, which is owned by the brother of Home Minister Advocate Sahara Khatun. Members of Rapid Action Battalion (RAB) raided the hotel at around 5 pm (Bangladesh Time) on April 10, 2009. Sensing RAB... Read More´s presence, nephew of the Home Minister, Polash entered into verbal altercations as well physical assault with the members of the elite force. This raid was conducted following statement from some counterfeit money dealers arrested earlier. Huge volume of counterfeit money as well as equipment of making such currency was seized from the hotel. Forgers were arrested along with the nephew of the Home Minister. But, later, due to ´influence´ from the high-ups, Polash was released.
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:40pm April 15
16. Meanwhile, huge volume of counterfeit currency was recovered from a residential hotel named Imperial Guest House in Dhaka, which is owned by the brother of Home Minister Advocate Sahara Khatun. Members of Rapid Action Battalion (RAB) raided the hotel at around 5 pm (Bangladesh Time) on April 10, 2009. Sensing RAB... Read More´s presence, nephew of the Home Minister, Polash entered into verbal altercations as well physical assault with the members of the elite force. This raid was conducted following statement from some counterfeit money dealers arrested earlier. Huge volume of counterfeit money as well as equipment of making such currency was seized from the hotel. Forgers were arrested along with the nephew of the Home Minister. But, later, due to ´influence´ from the high-ups, Polash was released.
Purba Rahman
Purba Rahman at 5:40pm April 15
18. A number of leaders of Bangladesh Awami League are trying to flee the country fearing disclosure of their involvement behind the bloody massacre. Mirza Azam is trying frantically to leave Bangladesh. Barrister Fazley Noor Taposh is already abroad! Mohiuddin Khan Alamgir is also looking into the opportunity to flee.

From the above points, it is possibly clear that the present rulers in Dhaka are struggling hard for their survival. One of the key factors for the government of Sheikh Hasina Wajed is to make sure that the BDR Massacre investigation never sees light of the sun. This is the most crucial point for her government, and they will do anything in ensuring this.
Print Share Email
Your Name... Read More
Recipient's Name
Recipient's Email
Sunita Paul

Sunita Paul was born in 1952 in an affluent family in Kochin, India.

Born as a deaf and dumb, Sunita Paul decided to use pen in expressing herself. She was unwilling to surrender to the fate due to her being a deaf and dumb. This has inspired
Shamim Ashrafi
Shamim Ashrafi at 10:02pm April 15
ভালোই তো লেখসো। গনতান্ত্রিক না হইলেও খালেদা জিয়ার ঐজাগা ছাইড়া দেওয়া আওমিলীগের লাইগা ভালো পাবলিকের লাইগাও।
Tarik Saifullah
Tarik Saifullah at 1:56am April 16
boss joss lekha diseb. poira valo lagse.
Bdeshi Mahathir
Bdeshi Mahathir at 4:02am April 16
khali bari na,office o kere nibe amag chomok pordhan montiri

http://www.amardeshbd.com/dailynews/detail_news_index.php?NewsID=220012&NewsType=bistarito&SectionID=home&JVO=DIKZMLDR
Farhan Daud
Farhan Daud at 4:51am April 16
Purba Rahman,ami nijere BAL birodhi vabi thik e,kintu shunita paul er article re jara reference hishabe use kore tader 1 no bekub and deshdrohi bolte amar kono apotti nai. dure giya moren,jodio democracy te kaure dure giya morte bolaro right nai,eitai mushkil.
Shams Shamim
Shams Shamim at 8:32am April 16
a muhurte a o guruttopurno bishoyta digital sorkarer mathay kara dukalo? ata ki importent kichu?
Nury Afrin
Nury Afrin at 11:59am April 16
পূর্বা রহমান@ আপনার কমেন্ট থেকে তথ্য পেলাম, এই ইংরেজি লেখাটার লেখিকা হলেন-
Sunita Paul was born in 1952 in an affluent family in Kochin, India.

Born as a deaf and dumb, Sunita Paul decided to use pen in expressing herself. She was unwilling to surrender to the fate due to her being a deaf and dumb. This has inspired... Read More.
তিনি বোবা-কালা। কিন্তু লিখতেন তো বেশ ধ্বলা। এই বোবা কালা ভারতের হিন্দু মেয়ে বাংলাদেশের এ্ই রকম বিষয়টা বিষয়টা নিয়ে কত ধৈর্য ধরে এই লেখাটা লিখেছেন , ভেবে অবাক হলাম। তিনি এই এত তথ্য কোথায় পেলেন ভাই পূর্বা রহমান? যেন তিনি ভারতের নন, বাংলাদেশে লোক এবং শেখ সেলিম, তাপসদের ঘরে প্রায়ই তার যাতায়াত আছে। যেন সেনাদপ্তর, র্যাব, সিআইডি সহ বাংলাদেশের সর্বত্র তার নখ দর্পনে। যেন সব কিছু নিজের চোখে দেখেছেন। এই যেএকজন বো-কালা বিদেশী মেয়ে এত কিছু লিখল, তার লেখার সপক্ষে কিন্তু উৎস দেন নাই। বিষয়টা কি? তাহলে কি এই লেখার মধ্যে অন্য কোন বিষয় আছে?
Nury Afrin
Nury Afrin at 12:09pm April 16
এই রকম লেখা নির্বাচনের আগে শফিক রেহমান আর ফরহাদ মজহার কিছু আমদানী করতেন। তারাই লিখতেন। বিভিন্ন এলাকার বিশেষ করে ভারতের কিছু ক্লেখকের নামে এগুলো পয়সা কড়ি দিয়ে প্রকাশ করতেন। তারপর সেইগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কলাম লিখতেন। সেই একই কায়দা। তবে এবারে একটু ভীন্ন। এবারে তারা আমদানী করছেন, একজন মেয়েকে। সে আবার ভারতীয়। হিন্দু। সুতরাং মোর বিশ্বাসযোগ্য এই লেখাটা। আবার মেয়েটা বোবা-কালা! পাঠকদের সহানুভূতিই পাবে। পাঠক বিশ্বাস না করে আর যাবে কোথায়, তাই না পূর্বা রহমান? ভাল, ভাল কায়দা। ধরে নিন আমিও বিশ্বাস করেছি এই গল্প। অসাধারণ গল্পটি। আশা করছি আপনার এই মেয়েটি অচীরেই আরব্য উপন্যাস লেখিকা হিসাবে বুকার পুরন্কার পাবে আপনারা একটু চেষ্টা করলেই।
Nury Afrin
Nury Afrin at 12:11pm April 16
কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি আপনাকে নিয়ে পূর্বা রহমান। আপনি তো আবার মুখোশধারী। কোনো মুখোশধারীকে মাহবুব মোর্শেদ, সুমন রহমানরা তাদের ফ্রেন্ডস তালিকায় রাখছে না, রাখবে বলে জেহাদ ঘোষণা করেছে। ভাই, আপনি গোলাপ ফুলের মুখোশ পরে তো এই ওোদের ফ্রেন্ডস তালিকায় দিব্যি বহাল তবিয়তে আছেন। আপনার অবস্থা পাখি বলে, কালো কালি দাস, ডোবার ব্যাঙের মতো হল না কেন? এইখানেও কি কোনো কিন্তু আছে নাকি? নাকি সুমিতা আপনিই। আপনার লেখাটা সুমিতার নামে গেছে। আর এইটা নিয়ে সংগে সংগে মাহবুব মোর্শেদ সাহেব নোট দিয়ে ফেলেছেন যেমন করতেন ফরহাদ মজহার, শফিক রেহমান!
Nury Afrin
Nury Afrin at 2:24pm April 16
যাই হোক আপনার সৌভাগ্য আপনি আছেন ওদের সাথে। আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমার একটু ভাল লাগত যদি আপনি এই সুমতা পালের লেখার সাথে সাথে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ১৫ এপ্রিলে প্রকাশিত বাংলাদেশী বাংলাভাষী অমর একুশে গানের শ্রষ্টা এবং আপনার এলাকা বরিশালের লোক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখাটা জুড়ে দিতেন। তাহলে সেটা কি নিরপেক্ষ হত না? পাঠকরা বিচার বিশ্লেষণের সুযোগ পেত না ...আসলে কোনটা ঠিক? উৎসহীন লেখার লেখিকা সুমিতা পাল, না আব্দুল গাফফার চৌধুরী?
যারা খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সেই লেখাটা পড়তে চান- তারা নিচের লিংকে ক্লিক করুন-
http://www.dailyjanakantha.com/chn.pdf
Purba Rahman
Purba Rahman at 10:33pm April 16
আফরিন, আমাকে ক্যান সুমন বা মম বন্ধু তালিকায় রাখসে, তার উত্তঅর আমারে জিগাইয়া স্ময় ন্সট করসেন ক্যান? আপনার ত ইস্কুল খুলা, পড়ালেখা নাই? সেইটা করেন। জীবনে কাযে আসবে।
গাপ্পার ভাই কি বলেন তা দিয়া আমি কি করব? আমার বিষয় What is US State Dept. had to say or will do. Who cares what is Gaffer Chow.... or Janakhantha is writing !
For your info, do you know who... Read More is Masud khan? The woner of Janakantha Group? Brother in Law of Cl. Faruk Khan, the hon' Commerce Minister of BAL.

আপ্অনের photo দেইখা অনুমান করি আপনের বয়স কুড়ি হয় নাই। এই বয়েসে আমি বাংলা পত্রিকা বলতে " robe-bar ঈদ শংখা চিন্তাম, ফরহাদ মাযহার,সফিক রেহমান, মতিউর রহমান, বদ্অরুদ্দিন উমর,... নাম ও কওন দিন সুনাই। আমি আপ্নের গ্যানের পরিশিমা দেইখা টাশকি খাইসি।
Nury Afrin
Nury Afrin at 12:26am April 17
আপনার জ্ঞানের পরিসীমা যদি কম মনে করেন, সেইটা আপনার সমস্যা। আমার নয়। আপনারে কেন সুমন এবং লোকজন কেন ফ্রেন্ডস তালিকায় রাখছেন সে প্রশ্ন তো আমি আপনেরে করি নাই। আমি আম অবাক হইছি এই প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিবর্গ কিভাবে নিজেরা নিজেদের ঘোষিত আদর্শ থেকে সইরা যাইতেছেন। নিজের প্রতিজ্ঞা নিজেরাই ভাঙতেছেন। দেখেন নাই সুমন সাহেব এইজন্য একটা প্রচার কেন্দ্র খুলছেন- Say no to...? আর নোটের লেখক তো একজনের নাই কাইট্যা দিলেন কেন তিনি তাকে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা বললেন! আবার এই নোটেই দেখেন নিজেই লিখছেন-''ছাগমাতার তৃতীয় সন্তানের মতো যারা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তকে গণতন্ত্রকে বেসামরিকায়নের পদক্ষেপ হিসাবে দেখতেছেন'' এখন কি দাড়াইল? কে তার নাম কাটবে? কোথায় থাকল তার নিজের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি সৎ থাকার সেই হুংকার?
Nury Afrin
Nury Afrin at 12:32am April 17
আর ফারুক খানের কথা বলছেন? হতে পারে তিনি জনকণ্ঠের মালিকের ভাই। প্রশ্ন হল, প্রগতিশীল কবি বেলাল চৌধুরীর ভাই কি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর প্রতিভু গিয়াস কামাল চৌধুরী নন? কী বলবেন একে পূর্বা রহমান। আমি তো শুনেছি আপনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। বিবির পুকুর পাড় দিয়ে অনেকবার ছাত্র ইউনিয়নের সৎ রাজনীতির সপক্ষে মিছিল করেছেন। এখন সেসব কি ভুল গিয়া? সব উল্টা হো গিয়া? চকলেট গল গিয়া!
ধন্যবাদ আপনাকে।
Nury Afrin
Nury Afrin at 12:41am April 17
'এই বয়েসে আমি বাংলা পত্রিকা বলতে " robe-bar ঈদ শংখা চিন্তাম'- আপনার এই লাইনটা পইড়াই বুঝতে পারছি কেন আপনার আজকের এই পরিণতি! কেন এই হুক্ক হুয়া।
Purba Rahman
Purba Rahman at 12:57am April 17
Young Lady you must be mistaken. I have never ever attended a rally in Barisal or in DU Campus cheering with Chatro Union. I was introduced to the CU in the family.
My elder brother, one of the founder leader of Dhaka University Student Union.He served as a VP of Salim Ullah Hall , before I was born.

Instead, wasting your time telling people ... Read Morewhat they should do, ... why do not know do a favor to yourself?Go To SUNITA PAUL website, and learn about her before you make any further stupid comments. If you really live in the USA , you should be able to contact her. You must know the rules and law about the land. You have made enough
offensive comments about her in a public forum, which will be sufficient for a law suit. Be very care full.
Nury Afrin
Nury Afrin at 10:17am April 17
হাস ছিল সজারু/ হয়ে গেল হাঁসজারু। জানা গেল আরেকটি কাহিনী যে, আপনার পরিবার ছাত্র ইউনিয়নের ফাউন্ডারদের অন্যতম। পারিবারিক হিসাবে আপনি ছাত্র ইউনয়নে ছিলেন। ছেলেবেলায় হাবিজাবি পত্র-পত্রিকা পড়ে সেসব এখন আপনার মাথা থেকে আউট হয়ে গেছে। যেতেই পারে। কারণ দুনিয়াতো আর এক জায়গায় দাড়িয়ে নেই। এখন দুনিয়ার মজদুর পুরনো হইয়া গেছে। মহানের দেয়া নতুন তত্ব আইসা পড়ছে- এ ভবে সাব আল্টার্নরে তবে কে কেইখা রাখবে। সুতরাং সাব অল্টার্নদের দেখইখা রাখার জন্য নতুন কিছু করতে হবে। প্রযোজনে বউরে ধইরা মারতে হবে।
আপনি জনকণ্ঠ এবং আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে বলেছেন- Who cares what is Gaffer Chow.... or Janakhantha is writing ! এটা পড়ে আরও আনন্দ পাইলাম। জনকণ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। সেজন্য সাব অল্টার্নদের পিতমাতারা এটাকে কেন পছন্দ করবে! য
শরীফ খিয়াম আহমেদ ঈয়ন
শরীফ খিয়াম আহমেদ ঈয়ন at 10:23am April 17
@nury & purba afamoni, shabbash...chalai jan...
Nury Afrin
Nury Afrin at 10:24am April 17
দি বলতাম সংগ্রাম, নয়া দীগন্ত- তাহলে বোধ হয় ঠিক কেয়ার হত? আর আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে আপনে আপনের সেই ফাউন্ডার ব্রাদারকে জিগাইয়েন। তিনি বলতে পারবেন কেন তাকে কেযার করা দরকার আন্টি। শুধু একটা কবিতার কথা মনে পড়তাছে ছোট বেলা হাসিব স্যার বলতেন- স্বদেশের ঠাকুর ছেড়ে ধরি বিদেশের কুকুর...। ধরুন, আপত্তি নাই। গুড। ভেরী গুড।
একন সুনিতা পালের মতন একজন বোবা-কালো হিন্দু ইন্ডিয়ার মাইয়ার কথাই একমাত্র সদা সত্য বলিয়া ধরিতে হইবে কেন? তিনি কি এঞ্জেল? তার লেখা কি লুক লিখিত সুসমাচার? যে লেখিকার লেখার তথ্য সূত্র নাই, যিনি প্রতিবন্ধী বলিয়া আপনি পরিচয় দিচ্ছেন, একমাত্র তার বেচে থাকার ইচ্ছাই হল লেখালেখি করা- তাহলে বাংলাদেশের ঘরের গোপন খবর কি তিনি গায়েবীভাবে পাইছেন? না, স্বপপনে দেখছেন?
Nury Afrin
Nury Afrin at 10:29am April 17
এরকম অনেক ওয়েব সাইট ছাইট আছে হে আন্টি? আপনে তো নতুন এ লাইনে। প্রথম প্রথম এরকম সবারই হয়। পাগলা গারদে গেলে সবাই প্রথম প্রথম নিজেরে দেশের প্রেসিডেন্টই ভাব্যা লয়। দিন গেলে সব ঠিক হইয়া যায়। আপনারও যাবে।
আপনি তো ইংরেজি ভালই লেখেন। এই লেখাটি আপনি লিখেছেন আগেই সন্দেহ করছিলাম। এখন আপনি যখন বারবার বলছেন লেখাটির ওয়েব সাইটে যাওয়র জন্য তখনই আরও শক্তভাবে বিশ্বাস হচ্ছে, লেখাটি আপনারই লেখা। শুধু শুধু মানুষকে ধোকা দেওয়ার জন্য মাঝখান থেইক্যা একজন হিন্দু ইন্ডিয়ান বোবা-কালা মাইয়ার নাম আমদানী করলেন। এমনিতেই সাবঅল্পার্নটা চাণ্স পাইলেই হিন্দুগো ওপর চড়াও হয়- এবার দেখি বিরুদ্ধ পার্টিরেও হিন্দগো বিরুদ্ধে চেতানোর চেষ্টা করতেছেন হিন্দু মাইয়ার নাম লইয়া।
Nury Afrin
Nury Afrin at 10:37am April 17
কী বলিব, আপনি তো আবার মামাগো গো ছাড়া রেফরেন্ম পছন্দ করেন না। মামারা যে মোশাদদের মদদদাতা হেইডা কি এখন ভুইলা গেছেন? আপনার কথিত ফরহাদ মজহারতো আবার সেই মোশাদদের ষঢ়যন্ত্র দেখেন জঙ্গিদের মধ্যে। আর আমার ফটো দেইখা আমার বয়েস সম্পর্কে যা বললেন, শুনে বড়ো কৌতুক পাইলাম। আমি না হয় ১৮/১৯ বছর বয়সে পাকা ঝাল হইছি, আর আপনার ছবি দেইখা তো মনে হয় আপনি এখনো জন্মানই নাই- মায়ের পেটে আছেন, গোলাপ ফুলের গন্ধ শুকতাছেন। জন্ম হওয়ার আগেই যখন আপনার লেখালেখির/ কাজকামের এই অবস্থা, আপনার জন্ম হইলে কি হইবেন? কি করবেন আন্টি?
Nury Afrin
Nury Afrin at 10:44am April 17
আপনারতো অনেক ক্ষমতা!আপনি ব্যবস্থা কইরা দ্যান। মামাগো দ্যাশ থেকে সুনিতা পালের লগে দেখা করার ছলে স্বপ্নের দেশে ঘুইরা আসি। কে বসে বসে আর পচে এই ঢাকা শহরে! আর আপ্নেও গুরুদের কাছ থেইকা এই ফাকে নিজের জন্যও একখান লইয়েন। এইটাই তো আসল উদ্দেশ্য। ছাতার ছাত্র ইউনিয়নরে মনে রাইখা আর হবে। প্রথম প্রথম যখন উঠছিল- তখন তো পিদ্দুম ধইরা অনেক দেখা হইছে। এখন তো পাইকা ঝুনা হইছে। আর দেখনের দরকার কি!! কী বলেন গোলাপী আন্টি?
Written 44 minutes ago · Comment · LikeUnlike · Report Note
You like this.

Prachchhad Chowdhury
Prachchhad Chowdhury at 11:17am April 17
hasinar nongrami notun kicuna.... jemni notun kicuna amader moto jonogoner bekuper moto ray die asha... BNP -jamat jot shorkar 5 bocor shob lutpat korce, eta shotto... tai bole AL dhoa tulshipata, eder khomotay anle desh dhonno hoe jabe, manush shukhe shantite boshobash korbe.... ai shob olik kolpona kore jara AL ke vote die joyjukto korce, tarai ... Read Moreabar jamat je juddhaporadhi, eta vule gie 5 bocor por tader khomotay boshabe... er ageo 5 bocor amra hasinar gortumi marka shashon dekheci, kintu mone rakhina kicui... she bar hasinar chokh porecilo jiar majarer shamner julonto pul er opor... vabte lojja lagto erokom chorom irshanddho manushera bangali jatike nettritto dicce... ek pal god father er jonmo diecilo shebar hasina... ar khaleda eshe tar cele ar celer bonddhu derkei shi kaj korie nilo.... ai amader nettritto... ebar abar hasinar pala.... mattroto sattro liger gundami shuru hoice... er por aro koto ki dekhte hobe... desher eto eto shomosha thakte nojor porlo khaledar barir opor...???
Ashfaqur Rahman
Ashfaqur Rahman at 11:25am April 17
Akta poribortoner ashay amader bikolpo ar kichu ki korar chilo? Apniki 5+5 year dhore ak-e joter hate nishsho hote cheyechilen? Akhon atai cholbe. 5 yaer ak jote, porer 5 year onno jote-er hate pisto howa. Tar por-o amader asha kortei hobe jodi kuno kichu valo hoy.
Prachchhad Chowdhury
Prachchhad Chowdhury at 11:39am April 17
Rahman vai, ami jodi agune hat die vabi hate shitol onuvuti pabo sheta bokami hobe... ai BNP- Jamat jot abong AL mohajot era shob eki chig... eder karo hatei desh nirapod na... nirbachoner shomoy ekta slogan shobar kace pouce diar icce cilo khub... ' NOUKA-LANGGOL-PALLA-SHISH....shob shaperi date bish...' . ai kothata ami bishash kori... era shob ... Read Moremuddrar apit-opit... AL khomotay ashbe, eta porishkar cilo... kintu kicu valo lokto ashte aprto... B. chowdhury, Ibrahim, Dr. kamaler keu, ecarao onek shot joggo lok shotonttro prarthi hoecilen... amra taderke pattai deini... so hol dokhol, bari dokhol, hashpatal dokhol... eshob ekhon amader nitto diner ghotona hoai shavabik... ( ami ghorotoro jamat birodhi... )

Sunday, April 12, 2009

কবিতায় রাজনীতি ও নান্দনিকতা প্রসঙ্গে কবি তুষার গায়েনের নোট পড়ুন- প্রসঙ্গ রণজিৎ দাশ ও সাজ্জাদ শরীফ সম্পাদিত সংকলন।

১.ধরা যাক দু'একটা ইঁদুর এবার

আলোচিত সংকলনটি নিয়ে সুমন রহমান তার একটি নোটে আমাকে ট্যাগ করেছেন। সুমন রহমানের নোট নিয়ে অনেক আলোচনা, মন্তব্য চোখে পড়লো। সংকলনটা যেহেতু হাতে নেই এইসব আলোচনা, মন্তব্যের সূত্র ধরে কথা বলতে হচ্ছে। সুমন রহমানের নোট থেকে জানতে পারলাম যে বাংলাদেশের কবিতার বিষয়ে সাজ্জাদ শরীফের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।…’সাজ্জাদ শরিফ বলছেন আশিপূর্ব কবিতা "ইতিহাসের দায় মিটিয়েছে সত্য, কিন্তু কবিতার যথাযথ দায় মেটাতে পারেনি। আভিধানিক অর্থ থেকে শব্দের যে বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে কবিতার সূচনা ঘটে, কবিতাকে এবার তার সেই ভাষা-সংবেদনার কাছে নিয়ে যাওয়ার তাড়নায় এ সময়ের কবিরা ষড়যন্ত্রময়’।সুমন রহমানের পরবর্তী আলোচনা থেকে এই কথার ব্যাখ্যা পেলাম যে, সাজ্জাদ শরীফ আশি-পূর্ব কবিতাকে অকবিতার কাল এবং আশি-পরবর্তী কবিতাকে কবিতার কাল মনে করেন, ‘যে কালক্রমকে আপনি প্রকারান্তরে বলছেন "অকবিতা"র কাল সেখানে আপনি লিবারাল, আবার যখন থেকে "কবিতা" শুরু হয়েছে বলে বলছেন সেখানটায় এসেই আপনি কনজারভেটিভ হয়ে গেলেন।"
সাজজাদ শরীফের এ ধরনের মূল্যায়নের ভিত্তি কী? ইতিহাসের দায় মেটানো বলতে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন? ইতিহাসের দায় মিটিয়ে লেখা কবিতা কবিতা হয় না, এটাই কি তার বলবার বিষয়? ইতিহাসের দায় মেটানো বলতে তিনি যদি কবিতার রাজনীতি-সংলগ্নতা বুঝিয়ে থাকেন এবং তাকে গৌণ (inferior) জ্ঞান করেন, তবে তার পিছনে যুক্তি কি? পৃথিবীতে সব কালে, সব দেশে কবিতার ইতিহাস ও রাজনীতি সংলগ্নতা একটি স্বাভাবিক ও সার্বজনীন বিষয়। বিশেষ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতেই যে মহৎ কবি ও কবিতার জন্ম হয়, সেটা কি সাজ্জাদ শরীফ জানেন না? পাবলো নেরুদা, ফেদোরিকা গার্সিয়া লোরকা, নাজিম হিকমত, পাউল সেলান, সিমাস হিনি, কাজী নজরুল ইসলাম ও আরো কত শত কবি যে ইতিহাসের দায় মিটিয়ে বড়ো কবি সেকথাতো স্কুলের শিশুরাও জানে। বাংলাদেশ কি তার ব্যতিক্রম? বাংলাদেশের কবিতা বলতে আজ বাংলাদেশী পাঠক ও বিশ্ব পাঠক যা বোঝেন, তার উদ্ভব ও বিকাশ ইতিহাসেরই গর্ভে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে পাকিস্তানী দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রত্যাখ্যান ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েইতো বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কবিতার বিপুল, বিচিত্রময় বিকাশ সম্ভব হয়েছে। এটাইতো ইতিহাস। বাংলাদেশের বহু বিখ্যাত কবিতা রাজনীতি ও ইতিহাসের দায় মিটিয়ে শিল্পোত্তীর্ণ ও ক্লাসিক। শামসুর রাহমানের বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা, আসাদের শার্ট, স্বাধীনতা তোমাকে পাবার জন্য; সিকান্দার আবু জাফরের বাংলা ছাড়ো, শহীদ কাদরীর স্কিজোফ্রেনিয়া, নির্মলেন্দু গুণের হুলিয়া, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কোনা এক মাকে, আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, বৃষ্টি ও সাহসী মানুষের জন্য প্রার্থনা, আসাদ চৌধুরীর বারবারা বিডলারকে ও আরো কতো কবিতা, লিস্ট দিলে তো অনেক লম্বা হয়ে যাবে। আশি ও নব্বইয়ের কোনো কোনো কবি শিল্পোত্তীর্ণ রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন, সাজ্জাদ শরীফ হয়তো তা অকবিতা মনে করেন। কবিতা রাজনৈতিক হবে না ঐতিহাসিক হবে না ব্যক্তিগত জ্বালা যন্ত্রণার হবে, তার উপর কবিতার মান নির্ভর করে না। যে কোনো বিষয়ে কবিতা লেখা হতে পারে এবং কবির মেধা ও সৃষ্টিশীলতাই সেই কবিতার মান প্রদান করে। ৪০ দশক থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত এই পর্বে , কবিরা যে শুধু ইতিহাসের দায় মেটাতেই কবিতা লিখেছেন এই কথার বা ভিত্তি কি? এই কালপর্বে (৪০-৭০ দশক) কবিরা পৃথিবীর অন্যান্য কবিদের মতোই জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তা পাঠক জানেন। যেটা হয়েছে, কিছু নিম্নমেধার কবিরা জনপ্রিয়তার লোভে রাজনৈতিক কবিতার নামে শ্লোগান নির্ভর সস্তা কবিতা লিখেছেন। সেগুলো আমরা আমলে নেবো কেন? অইসব কবি ও কবিতাকে রেফারেন্স হিসাবে নিয়ে কি আমরা রাজনৈতিক কবিতার সুদীর্ঘ ইতিহাস অস্বীকার করতে পারি? শামসুর রাহমান লিখেছেন,’তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা আর কতোবার ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়’, আমাদের রক্ত গংগা কি বন্ধ হয়েছে? ৭১-এর রক্ত গংগার পরেও আরো কতোগুলো রক্ত গংগা আমাদের দেখতে হয়েছে। দুদিন আগেই তো দিনে দুপুরে বিডিআরে আরেকটি রক্ত গংগা আমাদের দেখতে হল, তার দাগ কি শুকিয়েছে? বাংলাদেশের মতো সদা বিক্ষুদ্ধ, রাজনৈতিক আবর্তের দেশে বাস করে কবিরা কিভাবে অরাজনৈতিক হবেন এবং ইতিহাসের দায় অস্বীকার করবেন? এ ধরনের দাবীর পিছনে কি কোনো রাজনীতি নেই? আশির দশকে বাংলা কবিতার এমন কি মহান পরিবর্তন অথবা বাক-বদল ঘটেছে যাকে বাংলাদেশে ‘কবিতার শুরু’র কাল বলতে হবে? যে কোনো সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলনের পিছনে কোনো দেশ ও জাতির অনিবার্য ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাটা বিরাজ করে যা নতুন স্বপ্ন, নতুন চেতনা ও নতুন বুদ্ধিবৃত্তির সূচনা করে, যার উত্তাপে নতুন কবিতা ও সাহিত্যের জন্ম হয়। এগুলো আকাশ থেকে পড়ে না, অথবা কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে বিখ্যাত করার জন্য এমনি এমনি এসে হাজির হয় না। বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস তাই বলে।
ইংরেজ শাসনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে,ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজ ইংরেজী শিক্ষা, ডিরোজিওর যুক্তিবাদী চিন্তাপদ্ধতি ( rational thinking) ইউরোপীও এনলাইটেনমেন্ট ও রেনেসাঁর সাথে পরিচিত হয়ে যে যুগান্তকারী মানসিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তার ফসল বাঙালীর আধুনিকতা ও বাঙালী রেনেসাঁ। কবিতার ক্ষেত্রে এটাই মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিহারী লাল চক্রবর্তী, রংগলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কামিনী রায়, রজনীকান্ত সেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-র মতো ক্ষণজন্মা কবিদের আবির্ভাব সম্ভব করেছিল। এই বাঙালী রেনেসাঁ নিয়েও সমালোচনা আছে, যা অন্নদা শঙ্কর রায়, শিবনারায়ণ রায় অথবা আজকের পোস্ট মডার্ন/ উত্তর আধুনিক সমালোচকেরা করে থাকেন, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তিরিশের দশকে আমরা আরেক আধুনিকতার রুপ দেখলাম– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, ইউরোপে হাই-মডার্নিজমের যে চর্চা হল( স্যুররিয়ালিজম, ইমপ্রেশনিজম, দাদাইজম, কিউবিজম ইত্যাদি ইত্যাদি) তার প্রভাবে বাঙালী হাই মডার্নিজমের নতুন কাব্য ধারার সূত্রপাত , যার পিছনে রবীন্দ্র কাব্যবলয়কে অতিক্রম করে নতুন ধারা নির্মাণের তাগিদ ক্রিয়াশীল ছিল। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এই ধারার প্রধান পুরুষ। এই আধুনিকতা নিয়েও সমালোচনা আছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। চল্লিশের দশকে মাকর্সবাদী সমাজবাস্তবতার শক্তিশালী ধারায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ অনেক কবি- সাহিত্যিক সাহিত্যের সব শাখাতেই আবির্ভূত হয়েছেন এবং এখনো অনেকে ক্রিয়াশীল আছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এমন একটি ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে ৫২-র ভাষা আন্দোলন, যার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালী মুসলিম নিজেদেরকে নতুন ভাবে আবিস্কার করেছিল, যাকে অনেক চিন্তাবিদ বাঙালী মুসলমানের ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ বলে অভিহিত করেন, যা ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে পূর্ণতা পায় ও বহমান থাকে। এই ধারাতেই ৫০, ৬০ ও ৭০ দশকের কবিরা আত্মপ্রকাশ করেছেন ও বিকশিত হয়েছেন, যার প্রাসঙ্গিকতা এখনো সমানভাবে বিদ্যমান। আমি বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের প্রধান কতগুলো ধারার যে উল্লেখ করলাম এবং তার পিছনে যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকারণ উল্লেখ করলাম, আশির দশক কি সেই রকম কোনো ধারা সৃষ্টির দাবী করতে পারে? আশির দশক বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিকভাবে এক অন্ধকার যুগ। এই সময় এরশাদের সামরিক শাসন চলছিল, এর আগে ৭৫-এ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, ৮২-তে আরেক রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করা হয়েছে (যিনি নিজেও সামরিক ছাউনি থেকে এসেছিলেন) ও প্রতি্ক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটছে। এই সময়ে ৭০ দশকের কিছু গৌণ কবি (সকলে নয়) শ্লোগান নির্ভর, সস্তা রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন যা নতুন কবিরা গ্রহণ করতে পারেন নি। কিন্তু এই কথাতো সত্য যে, আশির দশকের আগের দশকের অনেক প্রধান কবি তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থগুলো এই সময়ে প্রকাশ করেছেন। তাই ঢালাওভাবে কোনো কিছু খারিজ করার কি অর্থ হয়? আশির দশকের কবিরা শুদ্ধ কবিতা লিখতে গিয়ে এমনই কোষ্ঠকাঠিন্যের পরিচয় দিয়েছেন যে, গত ৩০ বছরে কেউ একটি অথবা আধখানা বই পয়দা করতে পেরেছেন! এবং অধিকাংশ কবি এখন আর লিখছেন না। তারা এতই উচ্চমার্গের লেখা লিখে ফেলেছেন যে আর না লিখলেও চলবে। এখন সংকলন করে তার মধ্য নিজের ৯টি করে কবিতা ঢুকিয়ে দিলেই তেলেসমাতি শেষ, অমরত্ব ঠেকায় কে? চমৎকার, ধরা যাক দু’একটা ইদুঁর এবার! এইসব স্বঘোষিত মহান কবিদের কবিতার গন্ধ নিলে আবার ওপার বাংলার কিছু কবিদের গন্ধ শুধুই নাকে এসে লাগে, এই যেমন- বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু, রনজিৎ দাশ, জয় গোস্বামী প্রমুখ। স্বঘোষিত মহানেরা যেখানে নিজেদের কাব্যভাষাই খুজেঁ পাননি, সেখানে কবিতার দায় কিভাবে মেটাবেন? আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, এ সময়ের কবিদের মধ্যে সিকি, আধুলি খুজেঁ পাওয়া যায়, একটা পুরো টাকা খুজেঁ পাওয়া যায় না। এতো অল্প কাজ দিয়ে কাব্য সাহিত্যের বাকবদল করবেন? আশির হাতে গোণা দু’একজন কবি নিয়মিত লিখে চলেছেনএবং যদি চর্চা করে যান, তাহলে তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ টাকা হয়ে উঠতে পারেন, আশা করি। সেই দিক থেকে দেখলে, নব্বইয়ের কবি এবং তাদের সৃষ্টির পরিমাণ অনেক অনেক বেশি এবং বিচিত্রময়। অধিকাংশ কবি সমানে লিখে চলেছেন। কিন্তু সাজ্জাদ শরীফ তাদের ভিতর থেকে খুব কম কবিকেই নিয়েছেন। এবং প্রধান সেইসব কবি যাদের নেননি, তিনি নিজে কি তাদের ধারে কাছে আসতে পারবেন? নাম করে আর কি হবে, ইতিমধ্যে অনক নাম আলোচকেরা উল্লেখ করছেন।

সুমন রহমান তার লেখায় সাজ্জাদ শরীফের সাথে প্রধান বিষয়ে কোনো দ্বিমত পোষণ করেন না। তিনিও সাজ্জাদ শরীফের মতো মনে করেন যে, আশি-পূর্ব কবিতা’অকবিতার কাল’ এবং আশি-পরবর্তী কবিতা’ কবিতার শুরুর’ কাল। তার যতো আপত্তি তা হল, সাজ্জাদ শরীফ বিভাজিত এই দুই কালপর্বের কবিদের সংখ্যা নিয়ে। সুমন রহমান তার ‘ইনক্লুসিভ’ এবং ‘এক্সক্লুসিভ’ থিওরী প্রয়োগ করে বলতে চেয়েছেন যে, সাজ্জাদ শরীফ আশি-পূর্ব যতো কবিদের ইনক্লুড করেছেন, এতো না করাই উচিৎ ছিল, কারণ তারাতো ইতিহাসের দায় মেটানো কবি, প্রকৃত কবি নন। বরং ‘এক্সক্লুসিভ’ নীতি পরিহার করে সাজ্জাদ শরীফ যদি আশি পরবর্তী কবিদের থেকে আরো কিছু কবিদের ইনক্লুড করতেন, তাহলে এই ঝামেলা থাকত না। আমি কিন্তু সুমন রহমানের এই ধারণার সাথেও একমত হতে পারলাম না। আমি মনে করি আশি পূর্ব এবং আশি পরবর্তী, উভয় ক্ষেত্রে, সাজ্জাদ শরীফ এক্সক্লুসিভ নীতি প্রয়োগ করেছেন। তা না হলে, তিনি কিভাবে সিকান্দার আবু জাফর, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, হেলাল হাফিজ, দেলওয়ারের মতো কবিদের বাদ দেন ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং আনোয়ার পাশার মতো অকবিদের ইনক্লুড করেন? আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক-জাতিসত্তা অণ্বেষণের কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা ইতিহাসের দায় একটু বেশি মিটিয়েছেন বলেই কি সাজ্জাদ শরীফের এতো রাগ?

সাজ্জাদ শরীফের এই সংকলন শুধুমাত্র দলবাজি এবং গোষ্ঠীবাজির নমুণা, নাকি তার থেকেও কোনো গভীর উদ্দেশ্য ও রাজনীতি রয়েছে, তা ভেবে দেখার জন্য বঙ্গের কবিকুলকে আহবান জানাই। ধন্যবাদ।
সংযোজনঃ কবিতার অগ্নি ও আংগিক
২.
কবিতার অতি রাজনীতিকরণ বা তার অশৈল্পিক ব্যবহার বাংলাদেশের কবিতার জন্য যেমন কখনো কখনো ক্ষতির কারন হয়েছে, তেমনি বিরাজনীতিকরনের ধারণা তার থেকে আরো বেশী ক্ষতির কারণ হবে, সন্দেহ নেই।বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা রাজনীতি এবং সমাজ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে পারব না। এরপরেই একটি প্রশ্ন সংগতভাবে এসে হাজির হবে, আমরা তাহলে রাজনীতি ও ইতিহাসের দায় মিটিয়ে কবিতার নান্দনিক দাবী মেটাতে পারব তো? আমাদেরকে কি তবে পুনরাবৃত্তিমূলক রাজনীতি ও ইতিহাসের মতই কাব্যভাষার পুনরাবৃত্তি করতে হবে?মানে, আমরা কি তাহলে শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুন, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান অথবা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার ভাষাতেই কবিতা লিখব? উত্তর- না!এটা প্রতিটি যুগের কবিদের দায়িত্ব যে, দেশ সমাজ ও বাস্তবতাকে আত্মস্থ করেই কাব্যভাষা ও আংগিককে অগ্রসর (update) করে নেয়া যা অগ্নি ও আংগিককে একইসংগে ধারণ করবে। এখানেই তো প্রকৃত কবির চ্যালেঞ্জ ও তার সৃজনশীলতার প্রমান। সাজ্জাদ শরীফ ও রনজিৎ দাশ যেভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, আশিতে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বংগের কবিতা শুদ্ধ পশ্চিমি আধুনিকতার পথে সমান্তরালে চলেছে, তা যে ভ্রান্ত সে ব্যাপারে পূর্ববর্তী আলোচকেরা দৃষ্টিপাত করেছেন।

শামসুর রাহমানের প্রথম পর্বের কবিতা, সিকদার আমিনুল হক এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের সমগ্র জীবনের কবিতা যে পশ্চিমি আধুনিকতার মুগ্ধ অনুসারী সে কথা কারো অবিদিত নয়। বরং শামসুর রাহমানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কবিরা পশ্চিমি আধুনিকতাকে গ্রহন করেছিলেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শে লালিত সাম্প্রদায়িক মনোজগতের বিপরীতে অগ্রসর সমাজ ভাবনায় এবং তা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত বাংগালী জাতিসত্তা ও তার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্নের ভেতর সঞ্চারিত করে নতুন আধুনিকতার জন্ম দিতে। ফলে পশ্চিমি আধুনিকতা ও স্বাদেশিকতার যৌথতায় যে নতুন আধুনিকতার জন্ম হল, সেটাই বাংলাদেশের কবিতার আধুনিকতা।কিন্তু সেখানেও পশ্চিমি আধুনিকতার যে অবশেষ রয়ে গেল, তা থেকে সচেতন উত্তরনের আকাংখাই নব্বইয়ের কবিতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। পৃথিবী জুড়েই উত্তর-ঔপনিবেশিক যেসব ডিসকোর্স ৬০-উত্তর কালপর্বে বিভিন্ন তত্ত্ব ও চিন্তার আকারে হাজির হ’ল, তার থেকে ৯০-র অনেক কবিই আলো নিতে সচেষ্ট হয়েছেন। স্বদেশ, ঐতিহ্য এবং মাটি-ঘনিষ্ঠ কাব্যভাষা অন্বষনের তাগিদ এপর্বের অধিকাংশ কবিদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যা কলাকৈবল্যবাদী পশ্চিমি আধুনিকতার ধবজাধারী কবিদের থেকে যোজন দূরত্বে অবস্থান করে। কিন্তু রাজনীতি বিমূখীনতার কারনে অথবা রাজনীতি ও শিল্পের যে মরমীয়া সম্পর্ক তা অনুধাবনের অভাব এইসব ঐতিহ্য অন্বেষী কবিদের অনেককেই পরিনামদর্শী কাব্যভাষা অর্জনে বঞ্চিত করে রেখেছে।রাজনৈতিক সচেতনতা কাব্যদেহে প্রবাহিত রক্তসঞ্চালনের মত যা দৃষ্টিগোচর নয়, কিন্তু যার অভাবে জীবিত মানুষকে ফ্যাকাশে দেখায়। নব্বইয়ে এমন কবিরাও রয়েছেন, যারা উপরোক্ত শর্তাবলী পূরণ করে দৃষ্টিগোচরভাবে উজ্জ্বল, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন, কিন্তু মিডিয়ার আলো তাদের উপর অতবেশী পড়ে না। প্রকৃত পাঠক তাদের কথা জানে এবং অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাদের নিশ্চয়ই খুঁজে নেবে।









মূল নোটটি পড়তে ক্লিক করুন-
http://www.facebook.com/note.php?note_id=173109440124&ref=mf
Written on Wednesday · Comment · LikeUnlike
You, Ovizit Das, Sayeed Jubary, Hazrat Binoy Bhodroe and 4 others like this.
Ovizit Das, Sayeed Jubary, Hazrat Binoy Bhodroe and 4 others like this.
Ashraf Shishir
Ashraf Shishir at 3:52pm April 8
এখানে না বোঝার কিছু নেই যে,সাজ্জাদ শরীফের এই সংকলন শুধুমাত্র দলবাজি এবং গোষ্ঠীবাজির নমুণা, নাকি তার থেকেও কোনো গভীর উদ্দেশ্য ও রাজনীতি রয়েছে
Pradip Dasgupta
Pradip Dasgupta at 12:25am April 9
puro uposthapona ta amar khub pochondo. jehetu mul o dhor kichu jana nei tai gobhirotai pouchote parlam na.
Tushar Gayen
Tushar Gayen at 1:48pm April 9
প্রদীপবাবু, পুরো লেখাটির পূর্বাপর সংযোগ বোঝার জন্য এই লেখার সাথে সংযুক্ত লিঙ্কগুলোতে ক্লিক করে অন্য লেখাগুলো পড়ুন। প্রথমে এই লেখার শেষে যে লিঙ্ক আছে সেটাতে ক্লিক করুন, তাহলে আমার মূল লেখাটা যেখানে রয়েছে সেখানে যেতে পারবেন।এরপর মূল লেখায় আরো দুটো লিঙ্ক রয়েছে, সেখানে ক্লিক করলেই এ’সম্পর্কিত সমস্ত আলোচনা আপনি পেয়ে যাবেন এবং এর পূর্বাপর সংযোগ বুঝতে পারবেন।

কবির পটো/ নূরী আফরিন


কবির পটো
Share
Today at 5:34pm | Edit Note | Delete

পাকি বলে কি সব বলে। সব সময় কিচির মিচির।
পরহাদ মজহারের পটো দেকলাম। তার কবিতা পড়তে চাইসিলাম। কেউ তো পাটালেন না?
পটোতে দেখলাম বুড়ো হলেও বেশ সেকসি। (লজজা লাগসে।)আমার বানদবি তামাননা বলসে- উনি যুবককালে কি জানি কী চিলেন। কত মেয়েদের হিরিদয়ে আগাত করসেন। আহা আমি কেন সেইকালে জনমালাম না! (আহা, তামাননা, আমি যদি তোর মত বলতে পারতাম!)
পটোটা বাল করে দেকলাম। সরসতী হিনদুদের গ্যানের দেবি। উশকুলে হিনদুরা পুজো করে। কী সুনদর করে সাজায়। সাদা, সাদা- আরো সাদা। পুত পবিতর। আমরা গুরে গুরে দেকি। বালই লাগে। কাজল চাচা বলসেন, উনি যাকে বিয়ে করবেন, তাকে হতে হবে সরসতীর মত সুনদর।
পটোটা বাল করে দেকলাম। সরসতী দেবীর সামনে উনি পা তুলে বসে আচেন। হাটুর উপরে হাত রেকেসেন। পরনে নীল লংগি। মাতায় মেয়েদের মত এলকেশি চুল। মুকে হাসি নাই। বলসেন যেন আমাকে দেকো। দেকলাম হে কবি, আপনাকে।
আমার বানদবী তামাননা বলেসে, ওদের বাড়ি পাবনায়। সেকানে এক বুড়ো দাদাজান চিলেন। বুড়োর বিবি মারা গেলে বুড়ো বাড়ির মাসনে বসে তাকতেন। একপা তুলে এই পরহাদ মজহারের মত বসতেন। এই পতেই চিল মেয়েদের ইসকুল। একদিন ইসকুলের আপারা নালিস করল বুড়োর চেলেদের কাছে। ইশকুলের মেয়েরো নাকি ঐ পতে যেতে যেতে লজজা পায়। দাদাজানের কি সব দেকা যায় ঐবাবে বসার কারনে। ওনার চেলেরা ওনাকে অনেকবার মানা করল। সেষে ওনাকে মানসিক ডাকতারের কাচে নিল। ডাকতার বলল. এটা পারবারসন রোগ। অনেকের বুড়োকালে হয়। এই পটোটা দেকে আমার তামানানার বুড়ো দাদাজানের কতা মনে পড়ল।
আমার এক হিনদু বানদবীআছে- পরমা। সে এই পটোটা দেকেসে। দেকে কাউমাউ করে কেদেচে। বলেচে, এইবাবে পটো তুলে উনি হিনদুদের অপমান করসেন। উনি হিনদুদের হিংসা করসেন।
তামাননা কাল আসবে বাসায়। ওকে বাল করে পটোটা দেকাবো। উনি কি সত্যি হিনদুদের অপমান করসেন? আমি বুজতে পারসি না। জটিল লাগসে। তামাননা বাল বলতে পারবে। ও আমার চেয়ে বুজদার।
বাল তাইকেন। আর কবির কবিতা পাটাবেন। পড়ে দেকব।
দন্যবাদ।
Written 22 hours ago · Comment · LikeUnlike · Report Note
You and Dobar Bang like this.
Dobar Bang likes this.
Pakhi Bole
Pakhi Bole at 12:57pm April 8
এই মেয়ে কি সব বলে? হাওর এলাকায় আমার বাড়ি। হাওড়ের শো শো শব্দ শুনছো কখনো? সাগরে গেছো? সাগরের ভাষা বুঝতে পারো? ?
কিচির মিচির শব্দ করি না আমি। গান করি। পাখির মনে যা আসে সে তাই বলে।
Kkhhudiram Mon
Kkhhudiram Mon at 2:24pm April 8
Satire-ta upobhog korlam
Kalo Kali Das
Kalo Kali Das at 2:39pm April 8
এইখানে হাসির শব্দ শুনিয়া আসিলাম! প্রভু , কিসব বাক্য ! বুঝা বড়ই মুছিবত !
Sezan Mahmud
Sezan Mahmud at 2:46pm April 8
হচ্চেটা কি?????
Kalo Kali Das
Kalo Kali Das at 1:55am April 9
সাহিত্যে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইতেছে...
নুরী আফরিন
নুরী আফরিন at 10:31am April 9
কি বললেন? সাহিত্যে সত্রিকার গনতনত্র? এইটা কি জিনিত? আগে কি এইটা চিল না? বা কারা বাদা দিয়েছে? কারা নসট করছে? এসব কতাবাতরা একটু বাল করে বুজায়া বলবেন কি কালো কালিদাস বাই। আমার বানদবী তামানানা আবার রাচনীীত কম বোজে। আর কাজল চাচাতো সরসতীর খোজে বিজি। আপনারা বুজায়া দিলে বুজতে পারবো। দন্যবাদ।

পাখি বলে, আপনার জন্য একটি হট বা সেকসি গল্প- বিঃদ্রঃ এটা কবি সুমন রহমানের উদ্দেশ্যে কিন্তু নয়-

নূরী আফরিন

আগে ভালোচনাটুকু পড়ুন। তারপর হট বা সেকসি গল্পটি পড়বেন। মজা পাবেন।
১.
পাখি বলের নাম বন্ধু তালিকা থেকে কেটে দিয়েছেন সুমন রহমান। তিনি কবি। কবিতা লেখেন। তার কবিতার প্রিন্ট বের করেছেন কাজল চাচা। কাজল চাচা নিজে কবিতা টবিতা লেকেন। অন্যদের কবিতাও পড়েন মনোযোগ দিয়ে। আমার কবি প্রতিভা নাই দেকে বকাঝকা করেন।
সুমন রহমানের কবিতাটি দেকলাম। নাম- মেঘশিশু। পরিচিত টচিরিতি মনে হল নামটা। বললাম, কোথায় যেন দেকেচি এই নামটা?
চাচা গজ গজ করে ভরলেন, কোথায় আবার, জয় গোস্বামীর বিখ্যাত কবিতা- মেঘবালিকা। এখান থেকেই সুমন রহমান টুকলি কইরা দিছেন।
বললাম, তাতে কি হয়েচে? এক নামে কি অনেক কবিতা হতে পারে না? এই যেমন- রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। নজরুলের সঞ্চিতা। নামে কি অসাধারণ মিল। করে ঝিলমিল।
চাচা রেগে গেলেন, পারবে না কেন ? কবিতা অনেক রকম হতে পারে। আর রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কথা বলছিস? ওনাদের মধ্যে কি কোনো নোংরামী ছিল? অসৎ উদ্দেশ্য ছিল? জীবনে খারাপ কিছু করেছেন? খারাপ দলে মিশেছেন?
-কথা বলতে বলতে রাগ কেন চাচা?
- রাগব না। এই সুমন রহমানরা বাংলাদেশের আশি দশকের আগের কবিতাকে বলল, ওগুলো কবিতা না। ওগুলো রাজণীতি নির্ভর কবিতা। কবিতার দায় মেটায়নি। কবিতা হবে নন্দনিকতার সূত্র মেনে। নিজস্ব স্টাইল থাকতে হবে। আর নিজেরা কবিতা লিখছেন অন্যের শব্দ ধার কইরা। অন্যের স্টাইল ধার কইরা। পাখি বলে তো বলছেন- সুমন রহমান পশ্চিম বঙ্গের কবি রনজিৎ দাশকে অনুসরন কইরা কবিতা লিকছেন। তার নিজের কবিতার ভাষা নেই। সুমন রহমানদের কবিতা পড়লেই মনে হয়, অন্যের কবিতা পড়ছি।
আমি বললাম, চাচা, পাখি বলে বললেই তো আর হবে না। সেতো ভুলও বলতে পারে?
চাচার সাফ সাফ কথা, সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব কবি সুমন রহমানের। তার কবিতার যে নিজের স্টাইল আছে - অন্যের কবিতার স্টাইল তার কবিতায় না- সেটা প্রমাণের দায়িত্ব তার। তা না করে তিনি সমালোচনা সহ্য করতে পারছেন না। যারা তার মতের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন তাদের নাম ধমাধম করে তার ফেন্ডস লিস্ট থেকে কেটে দিচ্ছেন। তারিক টুকু, কালো কালি দাশের নাম কেটেছেন। আরো অনেকের কেটেছেন। এটা তো ঠিক নয়! তর্কের জায়গাটা খোলা রাখতে হবে। এটা বন্ধ করা অন্যায়- স্বেচ্চাচারিতা। এটা কি হিটলারি ফিলোসফি? এটা তো সভ্যতা নয়! অভিযোগকে অপ্রমাণের দায়িত্ব নিতে হবে অভিযুক্তকেই। এটাই সততা।
- তাহলে সুমন সুমন রহমান কি অসততা করেছেন?
-কেন নয়? উনি তো একবার সাজ্জাদ শরীফের বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনে তার নিজের কবিতা নেই দেখে গোস্বা করলেন। যাদের কবিতা আছে তাদের কাছে জানতে চাইলেন, কিভাবে তাদের কবিতা গেল। আবার যখন প্রগতিবাদিরা সাজ্জাদ শরীফের গোষ্ঠীবাজির সমালোচনা করলেন, তখন কিন্তু দলের জন্য তার দরদ উথলে উঠল। সাজ্জাদ শরীফকে রক্ষার জন্য বলে উঠলেন, না, না সাজ্জাদ শরীফ ঠিক কাজটিই করেছেন। আবার অন্য নোটে সাজ্জাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ করলেন। তালিকা দিলেন সাজ্জাদ কি কি ভুল করেছেন। এইগুলা কি? ভণ্ডামিা নয়? প্রতারণা নয়? অসততা নয়?
- উনি তো বেশ পড়াশোনা জানাওয়ালা লোক। তরক বিতরকে অংশ নেন।
- রাখ তোর পড়াশোনা। ওরা হল জ্ঞানপাপী। ভুয়া পণ্ডিত। সিউডো ফিলোসফারের গুষ্ঠিতে নাম লেখাইয়া সব খুয়াইয়া বইছে। গুষ্ঠিবাজি করে করে ওদের মাথা ঠিক নাই।
কাজল চাচা রাগে গজ গজ করতে করতে সুমনের তর্কের নোট, কবিতার প্রিন্টগুলো ছিড়ে টয়লেট বক্সে ফেলে দিলেন। বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি হা করে চেয়ে রইলাম। কিছু ঢুকল না আমার মাথার মধ্যে।

২.
তামান্না বলল, শোন তোর এইসব জটিল কথাবার্তা বোঝার দরকার নেই। একটা গল্প শোন। গল্পটা একটু হট বা সেকসি। মৌসুমি আন্টি আম্মুকে শোনচ্ছিল সেদিন, আমি শুনে ফিলেছিলাম।
হট বা সেকসি গল্প-------------------------
এক ছেলের নাম হিমু। সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ায়। তার সখ হল ছিপ পেতে মাছ ধরা।
একবার দেশে ভয়ানক খরা হল। খাল-বিল-নদী-নালা-পুকুর-ডোবা সব শুকিয়ে গেল। মাছ ধরার জল নাই। হিমু কিন্তু শুকনো পুকুরে ছিপ পেতে বসে রইল সারাদিন। লোকজন ধরে তাকে একদিন বাসায় দিয়ে গেল। ওর বাবাকে বলল, আপনার ছেলের মাথা ঠিক নাই। পাগল হয়ে গেছে।
বাবা আর কি করেন। ওকে পাবনায় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। ২/৩ বছর সেখানে চিকিৎসা চলল হিমুর। ডাক্তারা যা বলেছে হিমু তাই করেছে। ডাক্তাররা মনে করলেন, হিমু এবার সম্পূর্ণ সুস্থ। ওকে ছেড়ে দেওয়া যায়। ছেড়ে দেওয়ার আগে একজন সাইকোথেরাপিষ্ট হিমুর ফাইনাল চেকআপ করলেন।
সাইকোথেরাপিষ্ট বলরলন, হেমু, তুমি এখন সুস্থ। তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হলে তুমি কি করবে?
হিমু চটপট উত্তর দিল, কেন, বাড়ি যাব।
- গুড। খুশি হলেন সাইকোথেরাপিষ্ট। বাড়ি যেয়ে কি করবে?
-আমার বাণ্ধবী মায়াকে ফোন করব।
- তারপর?
- মায়াকে আমার বাসায় আসতে বলব।
-তারপর?
ও এলে ওকে ঘরে নিয়ে ঘরের দরোজা আটকে দেবো।
সাইকোথরাপিষ্ট খুব খুশি হচ্ছেন। এইতো সুস্থ যুবকের মতো কথা। বললেন, তারপর?
- ওর কাপড় খুলব।
- তারপর?
-এর ব্লাউজ খুলব।
-তারপর?
-ওর পেটিকোট খুলব।
এইবার সাইকোথেরাপিষ্ট আরও খুশি ও উত্তেজিত হয়ে বললেন, তারপর, তারপর?
-ওর পেটিকোটে যে দড়িটা দিয়ে গিট দেয় সেটা খুলে ফেলব। সেই দড়িটা একটা ছিপে বেঁধে মাছ ধরব।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, তামাননা এই গল্পটিার অর্থ কি?
- তামাননা জবাব দিল, হিমু আগে ছিল পাগল। পাগলা গারদে যাইয়া হইসে বদ্ধ বদ পাগল।

৩.
তামাননা কি সব বলে। ওর মুখে কিছু আটকায় না। অনেকদিন অস্ট্রেলিয়ায় ছিল তো ওরা। এ মা! আমার কিন্তু খুব শরম লাগছে। আপনাদের?

৪.
একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। এইটা ১০০%মৌলিক কবিতা। নন্দনিকতায় ভরপুর। এবং কোন রাজনৈতিক দায় নেই এবং আশি পরবর্তী একটি দুর্মর কবিতা। আশা করি বোদ্ধাজনেরা বাংলা কবিতা সংকলনে ইনক্লুসিভ তত্বে ইহাকে অন্ন্তর্ভুক্ত করতে ভুল করবেন না। এবং হে খোদা কাজল চাচার চোখে যেন না পড়ে। আমেন।

তোমার আমার মিল
করে ঝিলমিল

মাথা ভর্তি পচা গোবর
করছে কিলবিল
Written 2 hours ago · Comment · LikeUnlike · Report Note
You and Kalo Kali Das like this.
Kalo Kali Das likes this.
Purba Rahman
Purba Rahman at 12:14pm April 10
বন্ধু ই যদি তাইলে আবার কাটাকাটি কি ? সুম্ন আপ্নে কি এত্ত ডেরামাটিক?
Omi Rahman Pial
Omi Rahman Pial at 12:15pm April 10
bepok moja pailam. sumon rahman re bash dite je facebook e o notun nick khulte hoile, eita aro bapok lagse. hayre duinna
Kalo Kali Das
Kalo Kali Das at 2:12pm April 10
মাইন্ড খাইতেছেন কেন?
সুমন রহমান রংবাজ়ি আর কবিতাবাজি একই সঙ্গে চালাইতে চাহিতেছেন আপনার তাতে সমস্যা কি? কবিতাবাজ হইলেই যে রংবাজ হওয়া যাইবে না তাহা কে বলিল? আমাকে দেখিয়া লন, দুইটার কোনটা কি বাদ দিয়াছি?
সুমন রহমান রাজ সভার কবি বলিয়া কথা! হউক না ওইখানে পাতিকবি।
'প্রথম আলো রাজদরবার' আপনাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইল বলিয়া।
আপনি কবি নহেন। কবিতা লইয়া বড় বুলি ছাড়িবেন না। না বুঝিয়া এত কথা বলেন কিসের জইন্য?
Omi Rahman Pial
Omi Rahman Pial at 2:17pm April 10
sompurok prosno? kobira sobsomoy biponnota bodhe akranto thaken keno? tader moddomai ba eto durgondho jukto keno?

Tuesday, February 3, 2009

যেভাবে কবিতা পাঠ আর আলোচনা ঠিক নয়


চঞ্চল আশরাফ

স্কুলের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যখন আমাদের কবিতা পড়ান, তখন তিনি প্রথমে সেটি শব্দ করে পড়ে শোনান, তারপর তা বোঝাতে গিয়ে বারবার ‘কবি বলেছেন’ কথাটি বলেন। পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তি তিনি ব্যাখ্যা করে, শেষে কবিতার মূল কথাটি জানিয়ে দেন বা সেই চেষ্টা করেন। এতেও তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; কবিতার কোন অংশটি গুরুত্বপূর্ণ, তিনি দেখিয়ে দেন এবং কোন প্রশ্ন ও কোন অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা পরীক্ষায় আসতে পারে, এলে উত্তরটি কেমন হবে — তা-ও বাতলে দেন। আমরাও বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করি; কারণ, আমাদের তো পরীক্ষা দিতে হবে, সন্তুষ্ট করতে হবে শিক্ষককে। ফলে, আমাদের কবিতা বোঝা-না-বোঝা একান্তই পরীক্ষাকেন্দ্রিক এবং এই অবস্থা থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী মুক্ত হতে পারে না বা তাদের উত্তরণ ঘটে না; সেই লক্ষ্য বা সচেতনতা তাদের থাকে না। যাদের থাকে না, কবিতা সম্পর্কে তাদের ধারণার পরিবর্তনও ঘটে না। তা না-ঘটুক, শ্রেণিকক্ষে শব্দ করে যা পড়ান শিক্ষক, তা ‘কবিতা’ কি-না, তা বুঝে ওঠার আগেই আমাদের সামনে তিনি এর ব্যাখ্যায়, শব্দার্থে, সারমর্মে মনোযোগী করে তোলেন। পাঠ্যপুস্তকের ওই রচনাটি ‘কবিতা’ কি-না, তা জানার অবশ্য উপায়ও তখন থাকে না। কারণ, শিক্ষকই তো পূর্বনির্ধারিতভাবে, বা, নিয়তির মতোই আমাদের সামনে একে ‘কবিতা’ জেনেই উপস্থিত হয়েছেন। অথবা, তিনি হয়ত ভাবেনও নি ওটা ‘কবিতা’ কি-না, হলে কী-কী শর্ত তাতে রয়েছে। না-ভাবার কারণ হল, পাঠ্যপুস্তক-প্রণেতারাই স্থিরনিশ্চিত করে দিয়েছেন — যা পড়ানো হবে তা-ই কবিতা; এতে কোনও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
‘কবি বলেছেন’ কথাটা স্কুল-কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের শ্রেণীকক্ষে পর্যন্ত আছড়ে পড়েছে। এটি শিক্ষকদের মুদ্রাদোষ হয়ে উঠল কেন? তারা কি জানেন না যে, কবিতার মধ্যেই কবির কথা বলা হয়ে আছে, ‘শ্রেণিকক্ষের কবিতা’য় অন্তত কবির কথা সম্পর্কে কারও দ্বিমত হওয়ার কথা নয়। আমরা এটা কখনও দেখি না, ‘কবিতা’টি সম্পর্কে শিক্ষক নিজের ধারণা ও ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন। তো, সবই যখন ‘কবি বলেন’ তখন আমরা অসহায় বোধ করি অথবা করি না; কারণ আমরা এই মর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি — শ্রেণিকক্ষে কবিতার বক্তব্য নিয়ে শিক্ষকের কিছু বলার নেই, কবিই সব বলবেন; বছরের পর বছর একই কথা বলবেন; শিক্ষকের কাজ কেবল তার স্বরযন্ত্রটি ব্যবহার করা। কিন্তু কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী পাঠক এক সময় জানতে বা বুঝতে পারে, শ্রেণিকক্ষে যে রচনা নিয়ে (সব) শিক্ষক একই কথা বলেন বছরের পর বছর, তা আসলে কবিতাই নয়। কারণ, সেটিই কবিতা, যার ব্যাখ্যা পরিবর্তনশীল এবং পাঠকভেদে ভিন্ন। পাঠ্যবইয়ে স্থান-পাওয়া ‘কবিতা’গুলো ব্যর্থ, কারণ, যে-ব্যাখ্যা নির্ধারণ করা হয় এগুলোর জন্যে, তার বাইরে যাওয়ার যোগ্যতা বা সামর্থ্য এরা বহু আগেই হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চিতভাবেই, রচনাটি বরণ করেছে পদ্যত্ব — কেননা, তার ভাষার মৃত্যু ঘটেছে, বেঁচে আছে কেবল সাহিত্যের ইতিহাসের খুব ক্ষুদ্র ও নিরীহ ইউনিট হিসেবে; যদিও শ্রেণিকক্ষে এর দাপটের সীমা নেই। আমরা ধরে নিতে পারি, একসময় কবিতা হিসেবে এগুলোর প্রকাশ ঘটেছিল, হয়তো এগুলোর ছিল অনেকান্ত পাঠ ও ব্যাখ্যা; ভাষার গতিশীলতার সঙ্গে টিকে থাকতে না-পারায় আজ এই দশা হয়েছে: একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যায় এটি স্থির হয়ে গেছে, সারমর্ম বলে যা বোঝানো হয়, তাতেই থমকে আছে; এমন অবস্থা হয়েছে, ব্যাখ্যা বা সারমর্ম পড়লে কবিতাটি পড়ার আর দরকার হয় না; কবিতাটি একবার পড়লে প্রয়োজনই হয় না এর ব্যাখ্যা বা সারমর্ম খুঁজতে যাওয়ার, কেননা, সবই চূড়ান্ত হয়ে আছে ওই রচনায়, তাতে পাঠকের অংশগ্রহণের যে জায়গাটুকু শুরুতে ছিল, সময় তা কেড়ে নিয়েছে। সময় মানে ভাষার সময়, তার গতিশীলতা, পরিবর্তন। তো, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা ভাষার এই পরিবর্তনের কাছে অসহায়; যদিও তারা জানেন না ভাষার গতিশীলতার কাছে পাঠ্য রচনাটি নিহত হয়েছে; রচনাটি কেবল একটা কাঠামো হয়ে পাঠসূচিতে ঠাঁই নিয়েছে। কাঠামোটি খুব মামুলি ও নিরীহ; কেননা, আর সব পাঠ্য ‘কবিতা’ থেকে একে আলাদা করা যায় না। করা যায়, যখন এর বক্তব্যটি আমরা লক্ষ করি। সেটি অবশ্য ‘কবি’রই বক্তব্য, এতে পাঠকের অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ নেই। ফলে, শিক্ষকেরও উপায় নেই, রচনাটির ব্যাখ্যায় বারবার ‘কবি বলেছেন’ কথাটা বলা ছাড়া!
বোঝা যাচ্ছে, প্রতিটি কবিতাই, এমন-কি একটু আগে যেটি লেখা হয়েছে, ভাষার গতিশীলতার সঙ্গে সেটি একরকম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। চট করে কেন, দশ বছরেও দৌড়টির চেহারা বুঝে ওঠা কঠিন, যেমন সহজ নয় ভাষার গতিশীলতাকে বুঝে ওঠা। ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রগুলো এই কাজে আমাদের সাহায্য করতে পারে। কবিতার ভাষা কেমন করে বদলে যায়, তা বুঝতে সেই সূত্রগুলোর সমর্থন কাজে লাগতে পারে। সে-সব আমরা কম-বেশি জানি। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরের কবিতা প্রতিদিন যত পড়ছি, তত মনে হচ্ছে কবিতার মৃত্যু নিয়ে কবিদের মধ্যে যথেষ্ট উদাসীনতা আছে। কীভাবে কবিতার মৃত্যু ঘটে এবং তা আর্কাইভের খাদ্য হয়ে যায় — বুঝে নিতে পারলে, আমার ধারণা, কবিতার এমন দশা হত না। অবশ্য এ-ও ঠিক, এইসব ভেবেটেবে কবিতা রচিত হতে পারে না, হয়ও নি কোনও কালে। তবু কথাটা এজন্যেই বলা, ভাষার আপেক্ষিকতা ও অনির্ণেয় ভবিতব্য রচনামুহূর্তে যদি কবির সামনে এসে দাঁড়ায় এবং চেতন-অবচেতনের মধ্যে যাতায়াত করতে থাকে, সেই কবিতা কেন সৃষ্টি হবে না যা সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বহুদূর টিকে থাকতে পারে? প্রতিটি কবিতাই তার ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্য থেকে লেখা হচ্ছে; কিন্তু কবির ভাবা দরকার, তার সময়ে কবিতা যেখানে এসে পৌঁছেছে, অন্তত সেই জায়গা থেকে তাকে লিখতে হবে। কোথায় পৌঁছেছে, তা জানতে পারি আলোচনা থেকেই, গ্রন্থালোচনা থেকেও তা জানা কিছুটা সম্ভব কখনও-কখনও; কিন্তু বাংলা ভাষায় গ্রন্থালোচনার অবস্থা বহু আগে থেকেই শোচনীয়। এখন অবশ্য সামান্য উন্নতি হয়েছে: বইয়ের প্রচ্ছদ, মলাট, কাগজ, ছাপা, বাঁধাই নিয়ে কোনও কথা আলোচকদের আর লিখতে দেখা যায় না। যা-ই হোক, কবিতা যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেখান থেকে লিখলে, সমালোচনার ভাষাও তো বদলে যেতে পারে, অন্তত পরিবর্তনের প্রভাবটুকু পড়তে পারে। জীবনানন্দ দাশ ঝরাপালক (১৯২৭) কাব্যগ্রন্থে না-পারলেও ধূসর পাণ্ডুলিপিতে (১৯৩৬) সেটি, মানে বাংলা কবিতা যেখানে পৌঁছেছে, সেখান থেকে শুরু করতে পেরেছিলেন। বইটি প্রকাশের কাল থেকে সত্তর বছরের বেশি সময়ে বাংলা কবিতায় বৈপ্লবিক না-হলেও কিছু লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে; কিন্তু সমালোচনায় তেমন কোনও বদল ঘটে নি। জীবনানন্দের কবিতারও উপযুক্ত পাঠ-বিশ্লেষণ কারও পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর জীবনানন্দ (১৯৮৯) বইটি ছাড়া আর কারও বইয়ের নাম ভাবা যাচ্ছে না; বুদ্ধদেব বসু স্মরণীয় হতে পারেন, তবে তা কেবল এই কবিকে চিনিয়ে দেবার জন্যে; কেননা, জীবনানন্দ সম্পর্কে তিনি যে-আলোচনা হাজির করেছেন, তা উদ্ধৃতিপীড়িত ও বিশেষণনির্ভর। উল্লেখ বাহুল্য নয়, আজও সেই ধারাটি চলছে। এক্ষেত্রে একটা আত্মতৃপ্তি ও সান্ত¡না হয়ত আমাদের আছে। আত্মতৃপ্তিটি জীবনানন্দ বাংলা ভাষার কবি বলে আর সান্ত¡না তাঁর কবিতা এতই আপেক্ষিক ও অনির্ণেয় সমগ্রতা ধারণ করে আছে যে, এর বিশ্লেষণ আজও দুঃসাহসের বিষয়, কঠিন এবং কখনও-কখনও প্রায়-অসম্ভব ব্যাপার।) একটা কথা শুনে আসছি, আগে সৃষ্টি, পরে তত্ত্ব এবং তারপর সেই তত্ত্বের প্রয়োগ। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের মত একজন কবির আগমনের বহু বছর পরও বাংলা ভাষার কবিতার পাঠ ও আলোচনার ধরনটি কেন আগের মতোই রয়ে গেল? সমালোচনার পদ্ধতি ও ধারা কেন বদলায় নি?
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতে গিয়ে শিক্ষকদের বেশ ‘উহু-আহা’ করতে দেখেছি। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এর সঞ্চার ঘটলে এবং পাঠ-বিশ্লেষণের কোনও পদ্ধতি জানা না-থাকলে সেই ধ্বনি-প্রতিধ্বনির বিস্তার ঘটাই স্বাভাবিক। ফলে, কবিতার সমালোচনায় ‘লাইনটি চমৎকার’, ‘উপমাটি অতুলনীয়’, ‘কবিতাটি অসাধারণ’, ‘হয়ে ওঠে নি’, ‘ছুঁয়ে যায়’ ইত্যাদি উল্লেখের বিচিত্র গৎ তৈরি হয়েছে। বিশেষণ ব্যবহার তো রয়েছে বেশ আগে থেকেই। জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে যখন কোনও আলোচনার বই ছিল না বাংলাদেশে, তখন শুদ্ধতম কবি (১৯৭২) নামে আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি বই বেরোয়। এটি পড়েন নি, এমন লেখকদের এক সময় বেশ বিব্রত হতে দেখেছি সাহিত্যসমাজে। তো, খুব আগ্রহ নিয়ে শুদ্ধতম কবি পড়ে দেখি, জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে বিশ্লেষণের অজুহাতে এতে আছে উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি, ক্যাটালগিংয়ের বিস্তৃত আড়ম্বর আর কবির জন্যে কী বিশেষণ বরাদ্দ হতে পারে, এ-নিয়ে বিশেষ ব্যস্ততা! বুঝতে পারি, বাংলা সাহিত্য-সমালোচনার একটা বড় অর্জন হল কবিদের জন্যে বিশেষণ আবিষ্কার করতে পারা; বুদ্ধদেব বসু এই পথ প্রথমে দেখান, শুদ্ধতম কবি সেটি চওড়া ও লম্বা করেছে। এ-ছাড়া বইটির কোনও অর্জন দেখতে পাওয়া কঠিন। কিন্তু ততদিনে এটিই কবিতা বিশ্লেষণের ‘আদর্শ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ফলে, কোনও কবিতার আলোচনায় উপযুক্ত বিশেষণ খোঁজার কাজটি আলোচকের জন্যে অবধারিত হয়ে আসছে। কিন্তু কবিতা কেন, সাহিত্যের কোনও বর্গের কোনও রচনার আলোচনায় এটি শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও পরিষ্কার ধারণা দিতে পারে না। সাহিত্য-আলোচনার কোনও পদ্ধতিই দীর্ঘকাল চলে না, চলা ঠিকও নয়; সাহিত্যের জন্যে তা অস্বাস্থ্যকর। অথচ দেখা যায়, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আলোচনায় যুগ-যুগ ধরে বলা হচ্ছে, এটি বীর রসের কবিতা; ছন্দ এখনও কবিতার আলোচনার বড় একটা জায়গা দখল করে আছে; কোন শব্দটি বিদেশি বা তৎসম সেই প্রসঙ্গও গুরুত্ব পাচ্ছে; উপমা, অন্ত্যমিল, অনুপ্রাস ইত্যাদি দেখানোর কাজ অন্তত আশি বছর ধরে চলছে। চিত্রকল্প সম্পর্কে এখানকার আলোচকদের আগ্রহ বেশি দিনের নয়, কিন্তু এ-নিয়ে অধিকাংশেরই নেই পূর্ণাঙ্গ ধারণা, একরকম আংশিক, আড়ষ্ট ও ভুল ধারণা ব্যবহৃত হয় চিত্রকল্প-ব্যাখ্যায়। ফলে, ব্যাখ্যাটিও গোলমেলে হয়ে পড়ে। এর জন্যে বইয়ে ও শ্রেণিকক্ষে শেখানো চিত্রকল্পের সংজ্ঞা কেবল নয়, দায়ী সেই সংজ্ঞাটি ঠিক বা পূর্ণাঙ্গ কি-না তা যাচাই করে না-দেখা; চিত্রকল্প নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা বই ও প্রবন্ধগুলো অভ্রান্ত জেনে বিনা প্রশ্নে মস্তিষ্কে স্থান দেওয়া। বলা হয়ে থাকে, ইন্দ্রিয়ঘন বর্ণনাই চিত্রকল্প: রঙ, ঘ্রাণ, স্পর্শানুভূতি, স্বাদ ইত্যাদি প্রকাশ করা বা পাঠকের মধ্যে সঞ্চার করা চিত্রকল্পের কাজ। সংজ্ঞাটি খুব আকর্ষণীয় এবং এতে আকৃষ্ট হয়ে কবিরা তাদের রচনায় প্রচুর ‘চিত্রকল্প’ সৃষ্টি করে চলেছেন; আলোচকরাও বেশ ব্যস্ত, কবিতার কোন অংশে পাঠকের ইন্দ্রিয়কে সক্রিয় করে তোলার কাজটি আছে তা খুঁজে বের করতে; কিন্তু এখানকার পণ্ডিতদের মন-গড়া একটা সংজ্ঞা অনুসরণ করে যে কাজটি চলছে, সে-সম্পর্কে কে ভাববে? চিত্রকল্পের ধারণাটি এসেছে পশ্চিম থেকে, প্রথম এটি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন চিত্রকল্পবাদী কবিরা; আর একে কবিতার জন্যে অনিবার্য বলে প্রচার করা হতে থাকে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে, ওই কবিদের হাতেই। এর প্রবক্তা ছিলেন এজরা পাউন্ড, এফ এস ফ্লিন্ট ও টি ই হিউম; একটা ইশতেহার তারা দেন এবং এতে চিত্রকল্পের সংজ্ঞাটিও নির্ধারিত হয়ে যায়: আবেগ ও বুদ্ধিগত জটিলতার তাৎক্ষণিক প্রকাশই চিত্রকল্প। ইন্দ্রিয় এখানে খুব প্রাথমিক একটি বিষয়। মধ্যযুগের গীতিকবিতায়ও ইন্দ্রিয়ঘন বর্ণনা আছে, কিন্তু সে-সব চিত্রকল্প নয়; কারণ, তাতে আবেগ ও বুদ্ধির জটিলতার আনকোরা প্রকাশ নেই। আধুনিক কবিতার ব্যাখ্যায় চিত্রকল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে আছে।
আর ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি কবিতার প্রাথমিক শর্ত মাত্র। এগুলো অপরিহার্য না-ও হতে পারে। আমি মনে করি, একটি ভালো কবিতা প্রচলিত এইসব শর্তকে আড়াল করতে পারে; না-পারলে সেই কবিতা ভালো নয় বা ব্যর্থ; অনেক কবিতা আছে যেগুলো পাঠের সময় এবং পরে ছন্দ আর উপমা জেগে থাকে, ফলে কবিতাটির আসল বা আপাতত অভিপ্রায়টি বোঝা মুশকিল বা সেদিকে পাঠকের মনোযোগ থাকে না। পাঠক নিজের অজান্তেই তখন কবিতা থেকে দূরে সরে যায়। কোনও কবি যদি একে একটা কৌশল বলে দাবি করেন, তা হলে বলব: খুবই বাজে কৌশল এটি; সস্তা ফাঁকিবাজি; এতে কবি অচিরেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়বেন। চিত্রকল্প, অলঙ্কার, ছন্দ এসবের চমৎকারিত্ব দেখানোর মধ্য দিয়ে কবিতার উৎকর্ষের পক্ষে যত সাফাই হোক, কবিতার সংগ্রাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার সংগ্রাম; সমকালোত্তর হয়ে ওঠা তার অভিপ্রায়; নানা তত্ত্ব, সংজ্ঞা ও বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতির ছক বা দাসত্ব থেকে মুক্তি সে চায়। দেখা যায়, কিছু কবিতা সেই লক্ষ্য পূরণ করে, বা, সেই চেষ্টা ওই কবিতাগুলোর প্রতিটি পাঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে, তার ব্যাখ্যায় প্রচলিত ছকের উপাদানগুলো আর কাজে আসে না।
তখন আমাদের সামনে কী করণীয় থাকে? এ-কথা বারবার বলি যে, একটি কবিতা প্রকাশের পর যখন আলোচ্য হয়, দু’টি জিনিশ, প্রধানত, লক্ষ করা দরকার: ১. কবিতা সম্পর্কে কী ধারণা এটি প্রকাশ করতে চাইছে ও ২. জীবন ও জগত নিয়ে কী মনোভাব এতে রয়েছে। উল্লেখ বাহুল্য নয়, এ-দুটোর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায় পূর্বসাধক ও সমকালীনদের থেকে কবি কতটা স্বতন্ত্র বা নতুন; না-কি তিনি প্রতিষ্ঠিত কবিদের সম্প্রসারণকর্মটি কেবল সম্পাদন করে চলেছেন; হয়ে পড়ছেন প্রচলিত ধারার নিরীহ একক মাত্র!
ডিসেম্বর, ২০০৮
chanchalashraf1969@yahoo.com

যেভাবে কবিতা পাঠ আর আলোচনা ঠিক নয়

চঞ্চল আশরাফ

স্কুলের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যখন আমাদের কবিতা পড়ান, তখন তিনি প্রথমে সেটি শব্দ করে পড়ে শোনান, তারপর তা বোঝাতে গিয়ে বারবার ‘কবি বলেছেন’ কথাটি বলেন। পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তি তিনি ব্যাখ্যা করে, শেষে কবিতার মূল কথাটি জানিয়ে দেন বা সেই চেষ্টা করেন। এতেও তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; কবিতার কোন অংশটি গুরুত্বপূর্ণ, তিনি দেখিয়ে দেন এবং কোন প্রশ্ন ও কোন অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা পরীক্ষায় আসতে পারে, এলে উত্তরটি কেমন হবে — তা-ও বাতলে দেন। আমরাও বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করি; কারণ, আমাদের তো পরীক্ষা দিতে হবে, সন্তুষ্ট করতে হবে শিক্ষককে। ফলে, আমাদের কবিতা বোঝা-না-বোঝা একান্তই পরীক্ষাকেন্দ্রিক এবং এই অবস্থা থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী মুক্ত হতে পারে না বা তাদের উত্তরণ ঘটে না; সেই লক্ষ্য বা সচেতনতা তাদের থাকে না। যাদের থাকে না, কবিতা সম্পর্কে তাদের ধারণার পরিবর্তনও ঘটে না। তা না-ঘটুক, শ্রেণিকক্ষে শব্দ করে যা পড়ান শিক্ষক, তা ‘কবিতা’ কি-না, তা বুঝে ওঠার আগেই আমাদের সামনে তিনি এর ব্যাখ্যায়, শব্দার্থে, সারমর্মে মনোযোগী করে তোলেন। পাঠ্যপুস্তকের ওই রচনাটি ‘কবিতা’ কি-না, তা জানার অবশ্য উপায়ও তখন থাকে না। কারণ, শিক্ষকই তো পূর্বনির্ধারিতভাবে, বা, নিয়তির মতোই আমাদের সামনে একে ‘কবিতা’ জেনেই উপস্থিত হয়েছেন। অথবা, তিনি হয়ত ভাবেনও নি ওটা ‘কবিতা’ কি-না, হলে কী-কী শর্ত তাতে রয়েছে। না-ভাবার কারণ হল, পাঠ্যপুস্তক-প্রণেতারাই স্থিরনিশ্চিত করে দিয়েছেন — যা পড়ানো হবে তা-ই কবিতা; এতে কোনও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
‘কবি বলেছেন’ কথাটা স্কুল-কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের শ্রেণীকক্ষে পর্যন্ত আছড়ে পড়েছে। এটি শিক্ষকদের মুদ্রাদোষ হয়ে উঠল কেন? তারা কি জানেন না যে, কবিতার মধ্যেই কবির কথা বলা হয়ে আছে, ‘শ্রেণিকক্ষের কবিতা’য় অন্তত কবির কথা সম্পর্কে কারও দ্বিমত হওয়ার কথা নয়। আমরা এটা কখনও দেখি না, ‘কবিতা’টি সম্পর্কে শিক্ষক নিজের ধারণা ও ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন। তো, সবই যখন ‘কবি বলেন’ তখন আমরা অসহায় বোধ করি অথবা করি না; কারণ আমরা এই মর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি — শ্রেণিকক্ষে কবিতার বক্তব্য নিয়ে শিক্ষকের কিছু বলার নেই, কবিই সব বলবেন; বছরের পর বছর একই কথা বলবেন; শিক্ষকের কাজ কেবল তার স্বরযন্ত্রটি ব্যবহার করা। কিন্তু কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী পাঠক এক সময় জানতে বা বুঝতে পারে, শ্রেণিকক্ষে যে রচনা নিয়ে (সব) শিক্ষক একই কথা বলেন বছরের পর বছর, তা আসলে কবিতাই নয়। কারণ, সেটিই কবিতা, যার ব্যাখ্যা পরিবর্তনশীল এবং পাঠকভেদে ভিন্ন। পাঠ্যবইয়ে স্থান-পাওয়া ‘কবিতা’গুলো ব্যর্থ, কারণ, যে-ব্যাখ্যা নির্ধারণ করা হয় এগুলোর জন্যে, তার বাইরে যাওয়ার যোগ্যতা বা সামর্থ্য এরা বহু আগেই হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চিতভাবেই, রচনাটি বরণ করেছে পদ্যত্ব — কেননা, তার ভাষার মৃত্যু ঘটেছে, বেঁচে আছে কেবল সাহিত্যের ইতিহাসের খুব ক্ষুদ্র ও নিরীহ ইউনিট হিসেবে; যদিও শ্রেণিকক্ষে এর দাপটের সীমা নেই। আমরা ধরে নিতে পারি, একসময় কবিতা হিসেবে এগুলোর প্রকাশ ঘটেছিল, হয়তো এগুলোর ছিল অনেকান্ত পাঠ ও ব্যাখ্যা; ভাষার গতিশীলতার সঙ্গে টিকে থাকতে না-পারায় আজ এই দশা হয়েছে: একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যায় এটি স্থির হয়ে গেছে, সারমর্ম বলে যা বোঝানো হয়, তাতেই থমকে আছে; এমন অবস্থা হয়েছে, ব্যাখ্যা বা সারমর্ম পড়লে কবিতাটি পড়ার আর দরকার হয় না; কবিতাটি একবার পড়লে প্রয়োজনই হয় না এর ব্যাখ্যা বা সারমর্ম খুঁজতে যাওয়ার, কেননা, সবই চূড়ান্ত হয়ে আছে ওই রচনায়, তাতে পাঠকের অংশগ্রহণের যে জায়গাটুকু শুরুতে ছিল, সময় তা কেড়ে নিয়েছে। সময় মানে ভাষার সময়, তার গতিশীলতা, পরিবর্তন। তো, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা ভাষার এই পরিবর্তনের কাছে অসহায়; যদিও তারা জানেন না ভাষার গতিশীলতার কাছে পাঠ্য রচনাটি নিহত হয়েছে; রচনাটি কেবল একটা কাঠামো হয়ে পাঠসূচিতে ঠাঁই নিয়েছে। কাঠামোটি খুব মামুলি ও নিরীহ; কেননা, আর সব পাঠ্য ‘কবিতা’ থেকে একে আলাদা করা যায় না। করা যায়, যখন এর বক্তব্যটি আমরা লক্ষ করি। সেটি অবশ্য ‘কবি’রই বক্তব্য, এতে পাঠকের অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ নেই। ফলে, শিক্ষকেরও উপায় নেই, রচনাটির ব্যাখ্যায় বারবার ‘কবি বলেছেন’ কথাটা বলা ছাড়া!
বোঝা যাচ্ছে, প্রতিটি কবিতাই, এমন-কি একটু আগে যেটি লেখা হয়েছে, ভাষার গতিশীলতার সঙ্গে সেটি একরকম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। চট করে কেন, দশ বছরেও দৌড়টির চেহারা বুঝে ওঠা কঠিন, যেমন সহজ নয় ভাষার গতিশীলতাকে বুঝে ওঠা। ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রগুলো এই কাজে আমাদের সাহায্য করতে পারে। কবিতার ভাষা কেমন করে বদলে যায়, তা বুঝতে সেই সূত্রগুলোর সমর্থন কাজে লাগতে পারে। সে-সব আমরা কম-বেশি জানি। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরের কবিতা প্রতিদিন যত পড়ছি, তত মনে হচ্ছে কবিতার মৃত্যু নিয়ে কবিদের মধ্যে যথেষ্ট উদাসীনতা আছে। কীভাবে কবিতার মৃত্যু ঘটে এবং তা আর্কাইভের খাদ্য হয়ে যায় — বুঝে নিতে পারলে, আমার ধারণা, কবিতার এমন দশা হত না। অবশ্য এ-ও ঠিক, এইসব ভেবেটেবে কবিতা রচিত হতে পারে না, হয়ও নি কোনও কালে। তবু কথাটা এজন্যেই বলা, ভাষার আপেক্ষিকতা ও অনির্ণেয় ভবিতব্য রচনামুহূর্তে যদি কবির সামনে এসে দাঁড়ায় এবং চেতন-অবচেতনের মধ্যে যাতায়াত করতে থাকে, সেই কবিতা কেন সৃষ্টি হবে না যা সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বহুদূর টিকে থাকতে পারে? প্রতিটি কবিতাই তার ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্য থেকে লেখা হচ্ছে; কিন্তু কবির ভাবা দরকার, তার সময়ে কবিতা যেখানে এসে পৌঁছেছে, অন্তত সেই জায়গা থেকে তাকে লিখতে হবে। কোথায় পৌঁছেছে, তা জানতে পারি আলোচনা থেকেই, গ্রন্থালোচনা থেকেও তা জানা কিছুটা সম্ভব কখনও-কখনও; কিন্তু বাংলা ভাষায় গ্রন্থালোচনার অবস্থা বহু আগে থেকেই শোচনীয়। এখন অবশ্য সামান্য উন্নতি হয়েছে: বইয়ের প্রচ্ছদ, মলাট, কাগজ, ছাপা, বাঁধাই নিয়ে কোনও কথা আলোচকদের আর লিখতে দেখা যায় না। যা-ই হোক, কবিতা যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেখান থেকে লিখলে, সমালোচনার ভাষাও তো বদলে যেতে পারে, অন্তত পরিবর্তনের প্রভাবটুকু পড়তে পারে। জীবনানন্দ দাশ ঝরাপালক (১৯২৭) কাব্যগ্রন্থে না-পারলেও ধূসর পাণ্ডুলিপিতে (১৯৩৬) সেটি, মানে বাংলা কবিতা যেখানে পৌঁছেছে, সেখান থেকে শুরু করতে পেরেছিলেন। বইটি প্রকাশের কাল থেকে সত্তর বছরের বেশি সময়ে বাংলা কবিতায় বৈপ্লবিক না-হলেও কিছু লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে; কিন্তু সমালোচনায় তেমন কোনও বদল ঘটে নি। জীবনানন্দের কবিতারও উপযুক্ত পাঠ-বিশ্লেষণ কারও পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর জীবনানন্দ (১৯৮৯) বইটি ছাড়া আর কারও বইয়ের নাম ভাবা যাচ্ছে না; বুদ্ধদেব বসু স্মরণীয় হতে পারেন, তবে তা কেবল এই কবিকে চিনিয়ে দেবার জন্যে; কেননা, জীবনানন্দ সম্পর্কে তিনি যে-আলোচনা হাজির করেছেন, তা উদ্ধৃতিপীড়িত ও বিশেষণনির্ভর। উল্লেখ বাহুল্য নয়, আজও সেই ধারাটি চলছে। এক্ষেত্রে একটা আত্মতৃপ্তি ও সান্ত¡না হয়ত আমাদের আছে। আত্মতৃপ্তিটি জীবনানন্দ বাংলা ভাষার কবি বলে আর সান্ত¡না তাঁর কবিতা এতই আপেক্ষিক ও অনির্ণেয় সমগ্রতা ধারণ করে আছে যে, এর বিশ্লেষণ আজও দুঃসাহসের বিষয়, কঠিন এবং কখনও-কখনও প্রায়-অসম্ভব ব্যাপার।) একটা কথা শুনে আসছি, আগে সৃষ্টি, পরে তত্ত্ব এবং তারপর সেই তত্ত্বের প্রয়োগ। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের মত একজন কবির আগমনের বহু বছর পরও বাংলা ভাষার কবিতার পাঠ ও আলোচনার ধরনটি কেন আগের মতোই রয়ে গেল? সমালোচনার পদ্ধতি ও ধারা কেন বদলায় নি?
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতে গিয়ে শিক্ষকদের বেশ ‘উহু-আহা’ করতে দেখেছি। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এর সঞ্চার ঘটলে এবং পাঠ-বিশ্লেষণের কোনও পদ্ধতি জানা না-থাকলে সেই ধ্বনি-প্রতিধ্বনির বিস্তার ঘটাই স্বাভাবিক। ফলে, কবিতার সমালোচনায় ‘লাইনটি চমৎকার’, ‘উপমাটি অতুলনীয়’, ‘কবিতাটি অসাধারণ’, ‘হয়ে ওঠে নি’, ‘ছুঁয়ে যায়’ ইত্যাদি উল্লেখের বিচিত্র গৎ তৈরি হয়েছে। বিশেষণ ব্যবহার তো রয়েছে বেশ আগে থেকেই। জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে যখন কোনও আলোচনার বই ছিল না বাংলাদেশে, তখন শুদ্ধতম কবি (১৯৭২) নামে আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি বই বেরোয়। এটি পড়েন নি, এমন লেখকদের এক সময় বেশ বিব্রত হতে দেখেছি সাহিত্যসমাজে। তো, খুব আগ্রহ নিয়ে শুদ্ধতম কবি পড়ে দেখি, জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে বিশ্লেষণের অজুহাতে এতে আছে উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি, ক্যাটালগিংয়ের বিস্তৃত আড়ম্বর আর কবির জন্যে কী বিশেষণ বরাদ্দ হতে পারে, এ-নিয়ে বিশেষ ব্যস্ততা! বুঝতে পারি, বাংলা সাহিত্য-সমালোচনার একটা বড় অর্জন হল কবিদের জন্যে বিশেষণ আবিষ্কার করতে পারা; বুদ্ধদেব বসু এই পথ প্রথমে দেখান, শুদ্ধতম কবি সেটি চওড়া ও লম্বা করেছে। এ-ছাড়া বইটির কোনও অর্জন দেখতে পাওয়া কঠিন। কিন্তু ততদিনে এটিই কবিতা বিশ্লেষণের ‘আদর্শ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ফলে, কোনও কবিতার আলোচনায় উপযুক্ত বিশেষণ খোঁজার কাজটি আলোচকের জন্যে অবধারিত হয়ে আসছে। কিন্তু কবিতা কেন, সাহিত্যের কোনও বর্গের কোনও রচনার আলোচনায় এটি শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও পরিষ্কার ধারণা দিতে পারে না। সাহিত্য-আলোচনার কোনও পদ্ধতিই দীর্ঘকাল চলে না, চলা ঠিকও নয়; সাহিত্যের জন্যে তা অস্বাস্থ্যকর। অথচ দেখা যায়, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আলোচনায় যুগ-যুগ ধরে বলা হচ্ছে, এটি বীর রসের কবিতা; ছন্দ এখনও কবিতার আলোচনার বড় একটা জায়গা দখল করে আছে; কোন শব্দটি বিদেশি বা তৎসম সেই প্রসঙ্গও গুরুত্ব পাচ্ছে; উপমা, অন্ত্যমিল, অনুপ্রাস ইত্যাদি দেখানোর কাজ অন্তত আশি বছর ধরে চলছে। চিত্রকল্প সম্পর্কে এখানকার আলোচকদের আগ্রহ বেশি দিনের নয়, কিন্তু এ-নিয়ে অধিকাংশেরই নেই পূর্ণাঙ্গ ধারণা, একরকম আংশিক, আড়ষ্ট ও ভুল ধারণা ব্যবহৃত হয় চিত্রকল্প-ব্যাখ্যায়। ফলে, ব্যাখ্যাটিও গোলমেলে হয়ে পড়ে। এর জন্যে বইয়ে ও শ্রেণিকক্ষে শেখানো চিত্রকল্পের সংজ্ঞা কেবল নয়, দায়ী সেই সংজ্ঞাটি ঠিক বা পূর্ণাঙ্গ কি-না তা যাচাই করে না-দেখা; চিত্রকল্প নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা বই ও প্রবন্ধগুলো অভ্রান্ত জেনে বিনা প্রশ্নে মস্তিষ্কে স্থান দেওয়া। বলা হয়ে থাকে, ইন্দ্রিয়ঘন বর্ণনাই চিত্রকল্প: রঙ, ঘ্রাণ, স্পর্শানুভূতি, স্বাদ ইত্যাদি প্রকাশ করা বা পাঠকের মধ্যে সঞ্চার করা চিত্রকল্পের কাজ। সংজ্ঞাটি খুব আকর্ষণীয় এবং এতে আকৃষ্ট হয়ে কবিরা তাদের রচনায় প্রচুর ‘চিত্রকল্প’ সৃষ্টি করে চলেছেন; আলোচকরাও বেশ ব্যস্ত, কবিতার কোন অংশে পাঠকের ইন্দ্রিয়কে সক্রিয় করে তোলার কাজটি আছে তা খুঁজে বের করতে; কিন্তু এখানকার পণ্ডিতদের মন-গড়া একটা সংজ্ঞা অনুসরণ করে যে কাজটি চলছে, সে-সম্পর্কে কে ভাববে? চিত্রকল্পের ধারণাটি এসেছে পশ্চিম থেকে, প্রথম এটি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন চিত্রকল্পবাদী কবিরা; আর একে কবিতার জন্যে অনিবার্য বলে প্রচার করা হতে থাকে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে, ওই কবিদের হাতেই। এর প্রবক্তা ছিলেন এজরা পাউন্ড, এফ এস ফ্লিন্ট ও টি ই হিউম; একটা ইশতেহার তারা দেন এবং এতে চিত্রকল্পের সংজ্ঞাটিও নির্ধারিত হয়ে যায়: আবেগ ও বুদ্ধিগত জটিলতার তাৎক্ষণিক প্রকাশই চিত্রকল্প। ইন্দ্রিয় এখানে খুব প্রাথমিক একটি বিষয়। মধ্যযুগের গীতিকবিতায়ও ইন্দ্রিয়ঘন বর্ণনা আছে, কিন্তু সে-সব চিত্রকল্প নয়; কারণ, তাতে আবেগ ও বুদ্ধির জটিলতার আনকোরা প্রকাশ নেই। আধুনিক কবিতার ব্যাখ্যায় চিত্রকল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে আছে।
আর ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি কবিতার প্রাথমিক শর্ত মাত্র। এগুলো অপরিহার্য না-ও হতে পারে। আমি মনে করি, একটি ভালো কবিতা প্রচলিত এইসব শর্তকে আড়াল করতে পারে; না-পারলে সেই কবিতা ভালো নয় বা ব্যর্থ; অনেক কবিতা আছে যেগুলো পাঠের সময় এবং পরে ছন্দ আর উপমা জেগে থাকে, ফলে কবিতাটির আসল বা আপাতত অভিপ্রায়টি বোঝা মুশকিল বা সেদিকে পাঠকের মনোযোগ থাকে না। পাঠক নিজের অজান্তেই তখন কবিতা থেকে দূরে সরে যায়। কোনও কবি যদি একে একটা কৌশল বলে দাবি করেন, তা হলে বলব: খুবই বাজে কৌশল এটি; সস্তা ফাঁকিবাজি; এতে কবি অচিরেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়বেন। চিত্রকল্প, অলঙ্কার, ছন্দ এসবের চমৎকারিত্ব দেখানোর মধ্য দিয়ে কবিতার উৎকর্ষের পক্ষে যত সাফাই হোক, কবিতার সংগ্রাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার সংগ্রাম; সমকালোত্তর হয়ে ওঠা তার অভিপ্রায়; নানা তত্ত্ব, সংজ্ঞা ও বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতির ছক বা দাসত্ব থেকে মুক্তি সে চায়। দেখা যায়, কিছু কবিতা সেই লক্ষ্য পূরণ করে, বা, সেই চেষ্টা ওই কবিতাগুলোর প্রতিটি পাঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে, তার ব্যাখ্যায় প্রচলিত ছকের উপাদানগুলো আর কাজে আসে না।
তখন আমাদের সামনে কী করণীয় থাকে? এ-কথা বারবার বলি যে, একটি কবিতা প্রকাশের পর যখন আলোচ্য হয়, দু’টি জিনিশ, প্রধানত, লক্ষ করা দরকার: ১. কবিতা সম্পর্কে কী ধারণা এটি প্রকাশ করতে চাইছে ও ২. জীবন ও জগত নিয়ে কী মনোভাব এতে রয়েছে। উল্লেখ বাহুল্য নয়, এ-দুটোর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায় পূর্বসাধক ও সমকালীনদের থেকে কবি কতটা স্বতন্ত্র বা নতুন; না-কি তিনি প্রতিষ্ঠিত কবিদের সম্প্রসারণকর্মটি কেবল সম্পাদন করে চলেছেন; হয়ে পড়ছেন প্রচলিত ধারার নিরীহ একক মাত্র!
ডিসেম্বর, ২০০৮
chanchalashraf1969@yahoo.com

Sunday, January 25, 2009

আনন্দ রোজারিও-র কবিতা

ছায়াপাখি

এ গান শুনেছি আমি খরসান হাওয়ার ভিতরে
অনন্ত পাখির প্রায় আমিও জেনেছি-
যে সকল পাতা ঝরে পড়ে
নবীন মুকুল এসে ক্ষত সেরে রাখে তার
তবু কেন মনে পড়ো তুমি হে মুরলী মোহন?
রচো কেন গুপ্ত প্রণয়? নিঝুম মধুক্ষরা দিন?

গাছে গাছে বিলাপের ফুল ফুটে ওঠে
তাই আমি ক্ষীণ স্রোতধারা পার হয়ে যাই
অপার পায়ের নীচে সুরভিত পথরেখা
স্তব্ধপ্রায় মুথাঘাস
রথ চলে গেছে বহু দূর
যে গেছে এ পথে আজ তার কোন নাম নয়-
ধুলি ধুসরিত মায়া পড়ে আছে পথের উপরে

এই পথ হ্রস্ব মনে হয়,যদিও সুদূর

পাখি তুমি কোন গান গাও?
কেন তাকে ফিরে ফিরে ডাকো?
যে যায় লাবণ্য বনে সে কি আর ফিরে আসে?

এই হেতু দুপুরের কোনে কোনে
খরসান হাওয়া ওঠে,বারবার ঝরে পড়ে পাতা

কত হাহাকারে পাখি তুমি নিরাকার ছায়া

২৫ জানুয়ারি/২০০৯

Friday, January 16, 2009

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি



মুক্তিযুদ্ধ: ভাস্বর সেই দিনগুলি
সন্তোষ চৌধুরী

ফেলে আসা দিনগুলির দিকে ফিরে তাকালে সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি যা আমাকে আলোড়িত করে তা মুক্তিযুদ্ধ। নিঃসন্দেহে শুধু আমার জীবনের নয়, সমগ্র বাঙ্গালী জাতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা-সবচেয়ে শ্রেষ্ট ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙ্গালী জাতি তার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অর্জন করেছে নিজের একটি দেশ, নিজের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড- বাংলাদেশ। গর্বিত শির উঁচু করে সে দেশটি আজ পৃথিবীর মানচিত্রে আপন বৈভবে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যৎ সামান্য অবদান রাখার প্রয়াস রেখেছি- সেই স্মৃতিই আমাকে আপ্লুত করে রেখেছে সারাটি জীবন। কতগুলি বছর কেটে গেছে তারপর। কিন্তু সেই জীবন্ত স্মৃতিগুলিকে মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা। সেই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হামলার মুখে দাদা,বৌদি এবং গ্রামের অন্যদের সংগে দুই দিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া, প্রশিক্ষণ নেওয়া, আরো প্রশিক্ষণের জন্য দেরাদুন যাওয়া, জেনারেল ওবানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ, ফিরে এসে বাংলাদেশের ভিতরে অভিযান চালানো, রানীনগরে অপারেশনে অংশ নেওয়া- এসবই আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
একাত্তরে আমি ছিলাম মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে- বি.এস.সি.প্রথম বর্ষের ছাত্র। থাকতাম হোস্টেলে। ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসাবে। মার্চে প্রথম থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছিলাম বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচি নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের পল্টনের জনসভায় যাওয়া প্রস্তুতি নিয়েছিলাম হোস্টেলের ছেলেরা মিলে। কিন্তু যাওয় সম্ভব হয়নি যানবাহনের অভাবে। রাস্তায় তখন কোন যানবাহন চলছিল না।
এরই মধ্যে শুনতে পেলাম আমার বাড়ি নওগাঁ বগুড়ার দিকে হাদানার বাহিনীর তৎপরতার কথা। বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে যাওয়া সহজ ছিল না। অনেক কষ্টে আরিচা গিয়ে সেখান থেকে ফেরি পার হয়ে পরদিন সকালে আমার বাড়ি নওগাঁর ইকড়তারায় পৌঁছাই। তখনও কি জানতাম এ যাত্রায় আর ফেরা হবে না মানিকগঞ্জে। আসলে আমরা কেউ কি কল্পনা করেছিলাম পাকিস্তানীরা আমাদের উপর এমন বর্বর হামলা চালাবে! তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে? কখনও কি ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে আমাদের নিজেদের স্বাধীন বাংলাদেশ?এই অভাবনীয় ঘটনার দিকেই আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ২৫ শে মার্চের রাতে হানাদারদের নৃশংসতা ও সর্বাত্বক হামলায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। তাদের সঙ্গে লড়াই আমাদের অনিবার্য। স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী আমাদের নওগাঁ শহর দখল করে নেয় এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় আত্মরক্ষা করা যাবে না এটা বুঝতে পেরে আমাদের গ্রামের লোকজন সীমান্তের পথ ধরে। আমার সেজদা নওগাঁ জেলা স্কুলের শিক্ষক শ্রী শক্তিপদ চৌধুরী এবং বৌদিও পথে নামেন। আমিও তাদের সংগ নেই।
দুইদিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে আমরা পশ্চিম বাংলার বালুরঘাট শহরের পাশে আমার বড় বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠি। আমার বাবা,মা,ভাই বোন এবং আরো কিছু আত্মীয়স্বজনও এর পরপরই চলে আসেন। আসার পথে দাদের অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। আমার মেজো ভগ্নিপতির ছোট ভাই বিধুভূষণ সরকার ধাসুরহাটের সীমান্ত এলাকায় পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হন। পাক সেনাদের এই হামলায় বিধুভূষণ সরকারের সহযাত্রী আরো অন্তত: চল্লিশজন প্রাণ হারান।
ওপারে গিয়ে চুপ করে থাকার অবকাশ ছিল না। বাংলাদেশের দুঃশ্চিন্তায় আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের সমস্ত মন মানসিকতা জুড়ে বিরাজ করছিল একটাই চিন্তা- বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। হানাদেরদের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হবে। এই চিন্তা থেকেই গ্রামের দুজন বন্ধুকে নিয়ে চলে যাই বাঙ্গালীপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সেখানে নাম লেখাই। সেখানে দিন পনের প্রশিক্ষণের পর আমাকে মনোনীত করা দেরাদুনে প্রশিক্ষণের জন্য। নওগাঁর একজন ছাত্রনেতা মোয়াজ্জেম ভাই আমাকে দেরাদুন পাঠাবার জন্য বাঙ্গালীপুর ক্যাম্প থেকে বালুরঘাট ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মার্শাল মনি ভাই।
তিনদিনের মধ্যে আরো প্রায় ৩০ জন ছেলেকে নিয়ে আসেন মোয়াজ্জেম ভাই। একদিন ভোরে আমাদর সবাইকে একটি ট্রাকে করে জলপাইগুড়ি শহরের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুই সপ্তাহ থাকার পর দুটি ট্রাকে করে ষাট সত্তর জন ছেলেকে প্রথমে বাগডোবরা বিমান বন্দর এবং সেখান থেকে একটি বিশাল রাশিয়ান মালপরিবহন বিমানে শাহারানপুর নেওয়া হয়। এরপর দুইটি ট্রাকে আমাদের দেরাদুন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেরাদুনে প্রশিক্ষণের সময় জানতে পারলাম এটা একটা বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানকার দায়িত্বে আছেন তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক,শেখ ফজলুল হক মনি এবং সিরাজুল আলম খান। সার্বিক তত্বাবধানে আছেন একজন ভারতীয় জেনারেল সুজন সিং ওবান। প্রশিক্ষণ চলাকালে একদিন হঠাৎ করে সিরাজ ভাই বললেন- তুই আমার সঙ্গে আয়। তুই দ্বিতীয় ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তোকে জেনারেল ওবান দেখতে চায়। আমি সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে জেনারেল ওবানের কাছে যাই। ওবান আমাকে দেখে খুব খুশি হন।
দেরাদুন থেকে এক মাসের প্রশিক্ষণ শেষে আমরা জলপাইগুড়ি ফিরে আসি। এই সময় জলপাইগুড়ি ক্যাম্পে সিরাজুল আলম খানএবং আব্দুর রাজ্জাক কেন আমরা মুক্তিযদ্ধ করছি এবং বাংলাদেশ প্রবেশের পর আমাদের করণীয় বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিতেন।
সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর আমাদের বালুরঘাট শহরের সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে এনে রাখা হয়। এখানে সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন মোয়াজ্জেম ভাই। তিনিই আমাদের গ্রুপকে বাংলাদেশে ঢোকার সব ব্যবস্থা করেন।
এখানে একদিন থাকার পর রাত ১১টায় মায়াজ্জেম ভাই আমাদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। দশ বারো মাইল হাঁটার পরে খুবশীর বিলের পাশে একটি বাড়িতে আমরা আশ্রয় নেই। সেখানে সারাদিন থাকার পর রাত দশটায় নৌকাযোগে খুবশীর বিল পার হয়ে দশ বারো মাইল হেঁটে মল্লিকপুর গ্রামে আসি। মল্লিকপুরে সারাদিন থেকে রাতে হেঁটে এবং নৌকাযোগে দুবলাহাটি এলাকার বিল অঞ্চলে আশ্রয় নেই। এখানে তিনদিন থাকার পর আমার নিজ এলাকা তিলকপুর ইউনিয়নে চলে আসি। আমরা কেন এ মুক্তিযুদ্ধ করছি সে বিষয়ে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের উদ্বুদ্ধকরণের দায়িত্ব পালন করি। একই সঙ্গে স্থানীয় যুবক ছেলেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করি।
নভেম্বরের শেষ দিকে আমরা চার পাঁচটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ সম্মিলিতভাবে রানীনগর থানা আক্রমণ করি। সেখানে দুইদিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ফেলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। কয়েকজন পাকসেনা গুরুতরভাবে আহত হয়।আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত এবং একজন আহত হন। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৫ জন রাজাকার আমাদের কাছে আত্মসমর্পন করে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণকাজে আমি কেশবপুর গ্রামে অবস্থান নেই। এমন সময় রেডিওর খবরে জানতে পারলাম ভারত বাংলাদেশকে স্বীকুতি দিয়েছে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল বিজয় আমাদের সন্নিকটে। সত্যি সত্যিই সময় আর বেশি দিন লাগেনি। কদিন পরই ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর তিরানব্বই হাজার সৈন্যযৌথবাহিনীর কাছে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে।
অতঃপর বঙ্গবন্ধুর আহবানে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা স্টেডিয়ামে আমরা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ জমা দেই।

*(মুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ চৌধুরী বর্তমানে নিউ ইয়র্ক,যুক্তরাস্ট্রে বসবাস করছেন।)
**প্রবন্ধের শিরোণামে ক্লিক করুন,জহির রায়হান পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের অমর দলিল স্টপ জেনো সাইড চলচ্চিত্রটি দেখতে পাবেন।
***এর পর ভিডিও স্ক্রিনের উপরে ডান দিকে previous বাটনে ক্লিক করুন। স্টপ জেনোসাইডের পার্ট ২ দেখতে পাবেন।
**** see all ক্লিক করুন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেকগুলো চলচ্চিত্র এখানে পাবেন।

রবীন্দ্র সঙ্গীত

রবীন্দ্রনাথের গান

কেন নয়ন আপনি ভেসে যায় জলে।
কেন মন কেন এমন করে।।
যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে-
মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে।।

চারি দিকে সব মধুর নীরব,
কেন আমারি পরান কেঁদে মরে।
কেন মন কেন এমন কেন রে।।
যেন কাহার বচন দিয়েছে বেদন,
যেন কে ফিরে গিয়েছে অনাদরে-
বাজে তারি অযতন প্রাণের 'পরে।

যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে-
মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে।।

(গীতবিতান/২৪৬ সংখ্যক গান)

Friday, January 9, 2009

তুষার গায়েনের কবিতা

তুষার গায়েনের কবিতা

যে রূপ আমি শুনলাম কানে
মালিনী মাসির হাসি, নিলাজ গুঞ্জন তুলে আনে
আনন্দিত শিহরণ এই ভীত মনে- সরোবরে
ছায়া পড়ে আছে তার এ অমোচনীয় আঠার প্রলেপ
বায়ুযোগে ঢেউ ওঠে গোল হয়ে, সরে যায় দূর
গোলাকার তলে-তবু রূপ তার হাসিতে অনড়
বেড়ালের মতো এই অপরাহ্ণ বেলা!

নিবিড় নৈঃশব্দ চারিদিকে, ফুল ফোটাবার যত
আয়োজন গাঢ় প্ররোচনা করে যায় ঝিঝিঁদেঁর
দল, জোনাকিও জোটে এসে-জ্বলে নেভে ঈর্ষাতুর
দূর তারাদের দেখে। যে গেছে চন্দনবনে-

মাসি তার চোখ বেঁধে রাখো কেন?
সুরভি কি ঢেকে রাখা যায় বলো, আঁচলের তলে?
সখির কাঞ্চনরূপ কালির কলঙ্কে বুঝি মোছে!
হয়েছে হযেছে মাসি, তাকেঁ দূর থেকে ভালবাসি
দেখি নাই যাকে কোনদিন, তবু তার রূপের কীর্তন
তাঁর শুনেছি তো কানে!

Monday, January 5, 2009

তিতা মিঞার জঙ্গনামা

তিতা মিঞার জঙ্গনামা
অদিতি ফাল্গুনী


১.
শ্রী শ্রী এলাহি ভরসা

মোরসেদের বাহুর তলেনাচার সাজন বলে
ফজল কর আজি জেল গপ ফুল।
নামনি হালদারের গাতিমেসে-সোমপুর বসতি
জমা রাখি পাশ আউসে সোমপুর।
বড় ভাই-এর নাম মাজমছোট পাতলা মেজো সাজন
ছোট ভাই গিয়েছে মরে।
সাজন বড় গোনাগারসাত বছর মেয়াদ তার
কয়েদ হ’ল দিনের লড়াই করে।

পাশাপাশি দুই গ্রাম। মেসে আর সোমপুর। লোকে মেসে গাঁ-কে মাসিয়া-ও বলে। সোমপুর সাজন গাইনের বাড়ি। সাজন গাজি বা সাজন গাইন, যে নামেই ডাকো না কেন। সোমপুরের উত্তরে উত্তরপাড়া আর রামচন্দ্রপুর, দক্ষিণে ধরো গে তোমার মাসকাটা খাল, পূর্বে মেসে বা মাসিয়া গ্রাম আর
—————————————————————–
… একুন এই আলীপুর জেলের অন্ধকার দরজা-জানালার শিক গুনতে গুনতে তোমরাই কও, হে এই জঙ্গনামার পাঠকেরা, মুই সাজন গাজি আর কী করতি পারি এই ময়লা খাতাটায় জঙ্গের গানগুলো আর চাষার বাদশা তিতা মিঞার কতা সাজোয়ে-গুচোয়ে রাকা ছাড়া?
—————————————————————-
পশ্চিমে হলো গে সেই মাসকাটা খাল আর তোমার ভড়ভড়িয়ার বিল। রাত জেগে লুকিয়ে লুকিয়ে সাজন গাজি আর তার জোয়ান দুই ভাই নীলের বীজ সিদ্ধ করে। সাত সকালেই কোম্পানির লোক এসে বলবে জমিতে নীল বোনা হয় নাই? বাপ পুরুসউল্লাহ ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে যাবে। কেন যে এত ভয় বুড়োর? আরে, তার তিন জোয়ান ছেলে আছে না? মাজম, সাজন আর পাতলা। পাতলার আসল নাম গোলাব। তবে, মানুষটা সে রোগা-পাতলা বলে সবাই তাকে পাতলা বলেই ডাকে। পাতলার মাথাতেই এলো এই বুদ্ধি। ভোর বেলা জমিদার আর কোম্পানীর লোক এসে যেই না কিনা খোঁজ করবে নীলের বীজ পোঁতা হয়েছে কিনা, রাত জেগে সেদ্ধ করা নীলের বীজ তারা তখন টপাটপ বুনবে ভুঁইয়ে। হে..হে..সেদ্ধ বীজে তো আর চারা গজাবে না। বেলা পড়ে এলে, কোম্পানী আর জমিদারের লোক যখন তাদের ডেরায় ফিরে যাবে, তখন মাজম, সাজন আর পাতলা মিলে সেদ্ধ নীল বুজে তুলে আবার ধানের বীজ বুনবে সে জায়গায়। বছর শেষে আমন ধানের কচি ডগা লকলক করবে ক্ষেতে। তবে, সাজন গাজি কি আর আজকাল চাষ করে? সে যোগ দিয়েছে তিতা মিঞার দলে। তিতা মিঞার দলে বিশেষ কদর সাজন গাজির। কারণ, সাজন গাজিদের বংশ আসলে গায়েনের বংশ। গান বান্ধার বংশ। মুখে মুখে গাজির গীত, মনসামঙ্গল, সত্যপীরের পুঁথি কী না তারা গাইতে পারে! মুখে মুখে গান সাজাতে পারে বটে সাজন গাজি। তিতা মিঞার গৌরব সেসকল গানে। লোকে কয় জমিদার আর কোম্পানীর দিন সামনে আর বেশি দিন না! তিতা মিঞাই নদীয়া, কুষ্টিয়া আর সাতক্ষীরার সব জমির বাদশাহ হতে যাচ্ছে। তিতা মিঞা অবশ্য কন অন্য কথা। তিনি বলেন যে জমির মালিক আল্লাহ। সাত আসমানের নিচে যত জমিন, তার ভাগ নাকি সকল মানুষের সমান। হও তুমি মুসলমান কি হিন্দু। হও উঁচু জেতের হিন্দু কি নিচু জেতের হিন্দু। হও তুমি গোরা সৈন্যের মতো ধলা কি কালা কুষ্টি দেশি মানুষটি। জমির হক সবার সমান। এই এক তিতা মিঞার কথায় দলে দলে নিচু জেতের হিন্দু গত কয় বছরে জাত দিয়ে মুসলমান নাম নিচ্ছে। মুসলমানের ধর্ম নিচ্ছে। না নিয়ে যাবেই বা কই? আশপাশের তল্লাটের পাঁচটা বড় জমিদারির পাঁচ জমিদারই উঁচু জেতের হিন্দু। পুঁড়া গাঁয়ের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় এই পাঁচ জমিদারের ধরো গে নেতা। কৃষ্ণবাবুর অন্য চার সারেঙ্গি হলো তারাগোনিয়ার জমিদার রামনারায়ণ নাগ, নাগরপুরের গৌরপ্রসাদ চৌধুরী বাবু, সরফরাজপুরের জমিদার কালিপ্রসন্ন মুখুজ্যে আর গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়। এছাড়াও কুরগাছির জমিদার এক বিধবা মহিলা। তার গোমস্তাই তার হয়ে নড়াচড়া করে। কোলকাতার এক লাটু বাবু গোমস্তা না কি নাম সে-ও যোগ দিয়েছে এই কৃষ্ণদেবের দলে। কৃষ্ণদেবের দলের কাজ একটাই। মুসলমান আর নিচু জেতের হিন্দু ঠ্যাঙানো। অথচ, জমি চাষ করে কারা? এই তোমার শেখ আর কৈবর্তরাই তো করে! শরিফ কি খানদানি ঘরের মুসলমান বা বামুন-কায়েত কিই বা জানে ফসল ফলানোর বিদ্যের? না তারা পারবে নানে বাপু লাঙ্গলের বাঁট শক্ত মুঠোয় ধরতে কি না পারবে গরুর ন্যাজাখানা মুচড়োতে। এ তল্লাটে তিন পুরুষ আগেও প্রায় সবই ছিল হিন্দু। মানে নিচু জেতের হিন্দু। উঁচু জেতের অত্যাচারে তিন পুরুষেই সব ইসলাম কবুল করেছে। কিন্তু, ইসলাম কবুল করলেই কি আর জেত পেয়েছে তারা? চাষা যে সেই চাষাই। না খান্দানি মুসলমান ঘরে ডাকে না বামুন-কায়েত ছায়া ছোঁয়! তারপর এখন জমানায় আবার দ্যাখো গে নতুন কোম্পানীর শাসন! এখন আর দিল্লীর মোগল বাদশা নয় গো, দরিয়া পারের সাদা খেরেস্তান দেশের শাসক। তিতা মিঞা কন…কী জানি কন…কন যে কাফেরের হাতে কি বিদেশীর হাতে দেশ থাকলে সেই দেশ আর মুসলমানের দেশ থাকে না!

‘বাপ-দাদার পুরনো ধর্ম দিয়ি নতুন দ্বিন কবুল করিচো মিঞারা…কিন্তু, দ্বিনের পতে আসলি সেই দ্বিনের নিয়ম ঠিক-ঠাক মানতি হয়। চেলে-মেয়ের নামই একুনো রাকো দিকি সব হিন্দু নাম…আরবি-ফার্সি এক পাতা পড়া শেকো নি কো! জানো শুদু জমি চষতি! তা’ চাষারা জমি চষপা না ক্যানো? কিন্তু, ফসল কি গোলায় নিতি পারো মিঞারা? নেয় তো জমিদার আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী!’

তিতা মিঞার চোখে জল ছলছল করে। তিতা মিঞার চোখে আগুন ধবধব করে। আর, তখন সাজন গাজি আর তার দলের যত যুবক ছেলে…ধরো গে শাহগাজী চাষার ছেলে নূররাপ, সাতখানের ছেলে বাদল কারিগর, কালুর ছেলে কাইম, দিনাতের ছেলে নাকারি, হানিফের ছেলে মূলুক চাঁদ, বালতোরের ছেলে সাফি কারিগর, সাধুর ছেলে বায়োপার, কুশাইয়ের ছেলে রাফি, বরকতউল্লাহর ছেলে মাংলাই…সবার চোখেই জল ছলছল করে। সবার চোখেই আগুন ধবধব করে।

‘আর নিচু জেতের হিন্দুরা যারা আমার দলে আসিচেন, তাদের আমার নমষ্কার। তাদের আমার সালাম। ইসলাম জাতিভেদ মানে না। তবু, আমি জোর করপো নানে যে আপনারা ইসলাম কবুল করুন! যদি অপমান মুখ বুঁজি সইয়েও আপনারা পিতৃপুরুষের বিশ্বাসে থাকতি চান, আমি কই মুবারক! কিন্তু, বামুন-কায়েত কি কুনোদিন আপনাদের ইট্টুও মর্যাদা দিয়িচে? তাও বড় কতা না দাদারা! জমির ফসল আপনারাও পাতিচেন না, মুসলমান চাষা বা রায়তও পাতিচে না! গোরাদের কোম্পানী সরকার কি বলতিচে? ধানী জমিতে নীলির আবাদ করতি বলতিচে। নীলিতে কি চাষার পেটে ভাত হয় কন দিনি? চাষার এক যম, এক আজরাইল হলো গে এই নীলির চাষ। আর এক যম, আর এক আজরাইল হলো গে চিরস্তায়ী বন্দোবস্ত। এই বাংলায়… এই হিন্দুস্তানে… গোরা বৃটিশ আসার আগে মুসলমান বাদশাহর বাদশাহীতে কন আর হিন্দু রাজার রাজত্বে কন জমি কোন রাজা-বাদশা-জমিদার কি আমিরের গর্ভে চিরস্তায়ি ভাবে বন্দোবস্তি হয়নিকো! জমি চাষাগেরই থাকতো। চাষার কি রায়তের হয়ে জমিদার লাখেরাজ দেখাশুনো করতো। বছর শেষে প্রজারা মানে মানে একটি খাজনা দিতো। আবার চাষাগের খাজনা হতি একটি অঙ্ক জমিদার বাদশাহকে পাঠাতো। জমিদার ককুনো রায়তের মাথায় বাদশাহর বাদশাহ, রাজার রাজা হইয়ি চাপি বসতি পারে নিকো। আজ পারতিচে। বৃটিশ এসে উঁচু জেতের হিন্দুদের চিরস্তায়ি বন্দোবস্ত দিতিচে। আজ মুসলমানের দাড়ি রাকলি কর দিতি হয়। মিলাদ পড়তি গিলি কর দিতি হয়। গোরার দেশের কাপড়ের কল চালাতি হাজারকে হাজারকে জোলার, হাজারকে হাজার তন্তুবায়ের তাঁত বিনাশ হলো। কাজির বিচার বদলে বৃটিশের কোর্ট বসিচে। এ তো গেল মুসলমানের ফরিয়াদ। ছোট জেতের হিন্দুদেরও বলতি গিলি কোন সুক নেই। জমিদার সব ফসল কাড়ি নিতিচি। আজ এই নদে (নদীয়া), কুষ্টে (কুষ্টিয়া), সাতক্ষীরা, যশোর, চব্বিশ পরগণা, খুলনে (খুলনা) কি বারাসতের গাঁও কে গাঁও শুদু অভাব। যমুনা হতি ইছামতীর চরে চরে চাষার জমিতে চাষার ফসলে সবার হক আছে। শুদু চাষার কুনো হক নাই। অথচ, জমি কার? বলো তো মিঞারা?’

‘আল্লাহর!’

তিতা মিঞা যেন ধ্যানস্থ। টান টান বসা অবস্থায় চোখ বোঁজা। ডান হাতের তর্জনী তিনি আকাশের দিকে তুলে দেখান, ‘উপরে আল্লাহর…আসমানে আল্লাহর…আর নিচিতে…জমিনে?’

সবাই চুপ।

‘আরে মিঞারা! যার লাঙ্গল, তারই জমি! লাঙ্গল যার জমি তার! এই কতাটাও কতি পারো না? কী শেকাচ্ছি শুদু শুদু রোজ রোজ?’ তিতা মিঞা গলা চড়ান।

সবাই অপ্রতিভ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। সত্যি সত্যি কি তারা… কিছু গরীব শেখ আর কৈবর্ত… না খান্দানি মুসলমান যে পাতোর পর পাতো আরবি-ফার্সি পরে, চোগা-চাপকান পরে, গজল গেয়ে কি কোর্মা-পোলাও খেয়ে দিন কাটায় না তারা ভট্টাচাজ্জি মশায়দের মতো সদা গঙ্গাজলে নেয়ে কি পূজো-আচ্চা করে পূতঃপবিত্র, অং বং চং নানা সংস্কৃত পুঁথি পড়ে, বারবেলা আর অমাবশ্যা তিথি মেনে কি হাজারো সাধন-ভজনে সুখী ও ফিনফিনে দিন কাটে, সম্বৎসর গোলায় ধান ভরা থাকে তাদের… তারা ছোট জেত… জোলা মুসলমান, নমঃশুদ্দুর, হাইলা চাষা, তন্তুবায় কি কৈবর্ত… লাঙ্গল দরলিই কি জমির হক এত সহজে আসপে আনে?

‘তিতা মিঞা, নীলকর-জমিদার-কোম্পানী… এই তিন বাগের সাতে লড়াই করা কি সোজা কতা? চাষারে কোম্পানী কী কয় কন দিনি? না, তোমার সব ধানী জমির সবচেয়ে ভালো জমিতে নীল বুনো। তারপর জমি মাপ-জোকের সময় গজ-ফিতা দিয়ি কোম্পানীর গোমস্তা কি করবি? না, ধানী জমি কমায়ে নীলির জমির মাপ বাড়াবে। তারোপর নীল জমা দিতি কুঠিতে যাবা তো ওজনে ঠকাপেআনে। আবার কয় নতুন আইন করিচে কী যে নীল চাষের দাদন নিলি সে চাষ করতিই হবে। নীল বদলে ধান রুয়িচো কি জেল-হাজত। এই যে বারঘরিয়া আর হুগলির নীলকুঠির মালিক এসটরম (স্টর্ম) সায়েব আর তার ম্যানেজার পিরো (পিঁরো) সায়েব… এরা গোরা মানুষ… তেনাদের হাতে বন্দুক-কামান… সে কয় কোলকাতার ফোর্টুলিয়াম (ফোর্ট উইলিয়াম) তেকে তাদের ম্যাজিস্ট্রেট, সিপাই, ঘোড়া, লোক-লস্কর কত আসপেআনে… আমরা নেংটি পরা চাষাভূষো কি করে তেনাদের সাতে জঙ্গ করি তো সে আমি বাপু বুজে পাইনে!’ খিজার জোলার বাপ বুড়ো শান্তজান জোলা কথা শেষ করে গামছায় কপালের ঘাম মোছে।

‘আপনার কতা আমি বুয়িচি চাচাজান! কিন্তু, জুলুমের আর বন্দুকের ভয় কি পুরুষ মানুষির ধর্ম? কন দিনি!’

পেছন থেকে যুবক ছেলেদের গলার সমবেত আওয়াজ আসে, ‘হ্যাঁ- হ্যাঁ- চাচাজান, তুমি চুপ যাও না কেনে? তুমি কি বাদশা তিতা মিঞার তেকে বেশি বুজো নাকি?’

চুবড়িতে ভরে বাতাসা আর মুড়ি এসেছে। চাষারাই সবাই চাঁদা দেয় এক পয়সা কি দু’পয়সা করে। তিতা মিঞা অনেক লম্বা সময় ধরে কথা কন। তাঁর কথায় চোখে কান্না আসে, আগুন আসে। শরীরের নোমা (রোমকূপ) সব খাড়া হয়ে যায়। এত কথা শুনতি শুনতি খিদেও পায় ম্যালা। তখন এট্টু মুড়ি বাতাসা হলি মন্দ হয় না।

‘আমার তিন কতা মিঞারা। নীলির চাষ করপো না! বন্দোবস্তি (চিরস্থায়ী) মানবো না! লাঙ্গল যার জমি তার! সাহস করি আমার জঙ্গে যে আসতি পারো, আসপা! না আসতি পারলিও আমি কাউরে জোর করবো নানে!’

তিতা মিঞার ডান হাত মোহাম্মদ মাসুম গলা চড়ায়ে হাতের মুঠো পাকায়, ‘বলো মিঞারা! সব্বাই বলো একঠেঁয়… লাঙ্গল যার জমি তার!’

জোয়ান ছেলেরা হুড়মুড় করে মোহাম্মদ মাসুমের দেখাদেখি হাত মুঠো করে। সাজন গাজিও সবার সাথে কেশে গলা ঝাড়ে, ‘লাঙ্গল যার জমি তার!’

২.
‘বাবা সাজন!’

গোলেবকাওলি বিবি সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। গোলেবকাওলি পুঁথির নায়িকার নামেই মা’র নাম এমনটি রেখেছিল নানাজান।

‘তোদের এই তিতা মিঞার নিজির গ্রাম কি বাপ চাঁদপুর গাঁওয়ে?’

‘তুমি তো জানো দিকি!’

‘যা মনে কইরেচিলাম। আমার চাচাতো বোনের নিকে ঐ চাঁদপুর গাঁওয়েই হইচিল। আমার স্যাকুন (তখনো) বাপ শাদি হয়নি তোমার আব্বাজানের সাতে। বছর বারো কি তেরো বয়স হবে আমার স্যাকুন। বুবুর বাসায় একবার বেড়াতি গেইচি। দু’ঘর বাদের বিবি সাহেবা তার এতটুকুনি বচর সাত/আটের এক ছেলেকে কোলে নিয়ি বেড়াতে আসিচে। বলে, ছেলের আমার শুদু ঠাণ্ডা কাশি লাগে। তাই, ওর দাদাজান রোজ নিম পাতা আর শিউলি পাতা থেঁতোয়ে রস খাতি দেয়। ছেলে ঢকঢক তিতা গিলতি পারে। কুনো রা-শব্দ নেইকো। দাদাজান তাই ওর নাম রাখিচে তিতা মিঞা। তা’ শুনে অবদি আমাদের সকলের কী হাসি! মক্তবে তিতা মিঞা নামখানাই ভাল করে মৌলভিরা ডাকে তিতুমির। ভাল নাম আরো কী যেন একটা আচেলো!’

‘মীর নিসার আলি?’

‘হতি পারে বাবা — কতকাল আগের কতা! আমার চাচাতো বুইনেও ওলাওঠা বিবির আছরে মরলো নিঃসন্তান আর দুলাভাই আর একটা শাদি করলো। সেই তেকে ঐ গাঁওয়ে আর কোনো কুটুম্ব-কারবার কি যাওয়া-আসা নেই কো বাপধন!’

গোলেবকাওলি বিবির হাতে তশতরিতে খান কয়েক পিঠা।

‘মাজম আর পাতলা কই?’

‘গেচে ইদিক সিদিক কোতাও। বসো না ক্যানো গো মা?’

‘এই বসি বাবা! ম্যালা কাজ একুনো সারতি বাকি। কিন্তু, একটা কতা বাবা… শুদোবো?’

‘শুদোও না ক্যানো মা?’

‘গরীবের কতা কয় যদি তোমাদের তিতা মিঞা সে ভালো। চাষার জমি চাষা পাবে, লাঙ্গল যার জমি তার… খুবই হক কতা বাবা। কিন্তু, উনি কেমন য্যানো… এই কন পীর ফকিরের মাজারে যাওয়া যাবে না… মানত করা নিষেদ… মেয়েলি গীত, আচার, ব্রত সব বারণ… এত বারণে কেমুন পরান হাঁপায় গো বাপ!’

‘তিনি যে মক্কা থেকে ফিরিচেন মা! মক্কা হতি দেকি আসিচেন যে ইসলাম সেখানে কত কড়া! এই ব্রত, আচার, মাজার, মানত… সব যে হিঁদুদের দেকাদেকি আমরা করি মা!’

‘হতি পারে বাপ। কিন্তু, ওলা বিবির দরগায় মানত করি তোদের তিন/তিনটো ভাইকে যে আমি কলেরা থেকে ফিরোলাম… আহা কত মায়ের ছেলের অসুক করতি পারি, কত মায়ের মেয়ের নিকে দিতি সমস্যা, কত নারীর স্বামী বশে তাকে না… তারা এট্টু দরগায় যাবে নাকো? মানত করবি নাকো? তো বুকি বল পাবে কোত তেকে?’

‘আল্লা বল দেবে মা!’

‘আল্লা দেয় তো বাবা! তবু, মানত কি ব্রত-আচারেরও অনেক গুণ আছে বাপধন। সে তোমরা পুরুষিরা বুজবা না! ভাবো ত’ বেটামানুষ জমি একাই চষে। একাই হাল দেয়। আমরা মেয়েমানুষি যদি ঠিকঠাক ব্রত-আচার না করি, মানত না করি… জমি বেহাল হতি কতক্ষণ? তোমাদের তিতা মিঞাকে… তোমাদের ওস্তাদকে একতা বুজাও… এই দ্যাখো না গত বছর মহররমের সময় তোমাদের ওস্তাদের কথায় তারাগুণিয়া গ্রামের ষোল ঘর মুসলমান দরগায় যে মানত করছিল, সেখানে ঐ যে রজ্জত মল্লিক… দু’বছর আগেও চেলো হিঁদু… জাতে তাঁতী আর নাম চেলো পূজত মল্লিক… তিতা মিঞার কাচেই সে ইসলাম কবুল করিচে… সে যে ঐ মানতের ডালায় লাথি কষালো…সে কি ঠিক করিচে? শরাওলাদের১ এ জন্যিই সবাই ভয় করে আর এজন্যিই সব মুসলমান কিন্তু তোমাদের দলে নেই! ’
সাজন এবার হাসে, ‘তিতা মিঞা এট্টু কড়া বটে মা! উঁচু জেতের হিন্দু, জমিদার আর যত ইংরেজি পড়া ভদ্দরনোক বাঙালী বাবু কি গোরা চামড়া সাহেবরা কেউ তাকে দেকতি পারে না। খান্দানি মুসলমান যে কয় ঘর তারাও গোপনে ঐ জমিদার কৃষ্ণদেব বাবুর সাতে আঁতাত করিচে। গরীব মুসলমান চাষার দাড়িতে আড়াই টাকা কর বসলো কি মিলাদ করতি গেলেও কর দিতি অলো, ধানী জমি নীলির চাষে লাগাও… এসব জুলুম খান্দানি মুসলমান কি বামুন-কায়েত কেউ বোজে না গো মা! কিন্তু, বাঁচতি তো হবে আমাগেরও। বাঁচার রাস্তা আর নাইকো মা এই তিতা মিঞার জঙ্গে যদি শামিল না হই!’

‘কিন্তু, থানা পুলিশ যদি তোমাগের ধরতি আসে তো কী হবেআনে?’

‘গোপনে গোপনে থানা পুলিশ পেচু তো নিয়েইচে মা! কিচু করার নেই কো। বছর শেষে দুটো ভাত দুটো কাপড় তো লাগে বাঁচতি? তাই মোরা তিতা মিঞার দল করি!’

৩.
চাষার বাদশাহ তিতা মিঞা বলেন গোরা সৈন্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, নীলকর আর জমিদার বাবুদের সাথে লড়ার জন্য অনেক দম-শম দরকার। নিত্যি লাঠি খেলা, কুস্তি করে গতর শক্ত করাই শুধু নয়কো। পাঁচ বেলা নামাজ পড়ো। অজু করো। হিন্দুদের মতো ঢং করি কোঁচা দিয়ি ধুতি পরার চেয়ে ধুতিখানা দুই পা পুরো ঢেকে পরা ভালো। মন তখন এক আল্লাহর আসমানের নিচের সব জমিতে চাষার হকের জঙ্গে খাড়া হবে। মন তখন দশ ঝকমারিতে ছুটবে না। সাজন গাজিও তাই মরবি তো মর, পড়বি তো পড় পানরার জোলা পাড়ার মসজিদেই আজ দিন কয়েক হয় দু’ভাই পাতলা আর মাজমকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়তে ছুটছে। সাজনদের নিজেদের গাঁ অবশ্য সোমপুর। সোমপুরের কোল ঘেঁষাঘেঁষি গাঁ মাসিয়া, উত্তরের উত্তরপাড়া আর রামচন্দ্রপুর… কোথাও কোনো মসজিদ নেই। মসজিদ হলো আর সাক্ষাৎ কৃষ্ণদেব রায়ের পান্রা কি পুঁড়া গাঁয়ের পাশে। পুঁড়ার পাশেই সরফরাজপুর জোলা পাড়া। জোলা পাড়ায় থিকথিকে পঞ্চাশ থেকে একশত ঘর মুসলমান বসতি। একশ বছর আগে এখানে নাকি বর্গী… সেই কোন মারাঠা দেশের সৈন্যরা এসে এখানকার একটা মসজিদ ভেঙে দিয়েছিল। তিতা মিঞার যে জেদ! মক্কা আর রায়বেরিলী হয়ে এসে আর কোথাও না… ঠিক এই সরফরাজপুরেই একটা শনের মসজিদ বানিয়েছেন। শুরুতে শিষ্যরাই অনেকে নিষেধ করেছে। তিতা মিঞা কি আর কারো কথা শোনেন?

‘জোরে আজান দিবে মিঞারা! কৃষ্ণদেব রায়কে কীসের ভয়? জমিদার বলি কি সে তোমার দ্বিন, তোমার আখেরাতও কিনি নিয়েচে?’

কিন্তু, এই কৃষ্ণদেব রায়ের ছেলেগুলো ভারি বজ্জাত। জোলারা আজান দেওয়া শুরু করলেই পাশের জমিদার বাড়ি হতে জোর গলায় ভেঙচি, আজানের নকল করে কেমন কেমন শব্দ করা শুরু করে। জোলারা কোনোদিক না তাকিয়ে নামাজ পড়ে চলে। এর ভেতরে অবশ্য একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। গত সোমবার নামাজের সময় বাবু কৃষ্ণদেব রায়ের ছোট ছেলে… পনেরো ষোলর বেশি বয়স না… মসজিদের একদম সামনে এসে আরো দু/তিনটা ছেলের সাথে মিলে ভেঙচি কাটছিল। ঐ দিন আবার দাইম জোলার বাবু কালু জোলার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। কালু জোলা খুব মন দিয়ে সেজদায় ছিলেন। এক পর্যায়ে অসহ্য হয়ে মসজিদের বার হয়ে শুধোলেন, ‘এই খোকা… তুমি শুদু শুদু আমাদের ভেঙচি কাটচো ক্যানো?’

খোকা এ কথার উত্তরে আবার ভেঙচি কাটে।

‘তুমি থামো কলাম! বেয়াদব কুনোখানের!’

খোকা আর তার তিন বন্ধু আরো জোরে ভেঙচি কাটে।

কালু জোলা এমনিতেই রগচটা লোক। এককালে ইছামতীর চরে ডাকাতি করতো। ছোটবেলায় তার বড় বোনকে নাকি ধরে নিয়ে গিয়েছিল দু’জন গোরা সৈন্য। সেই বোনের আর সমাজে ফেরা হয়নি। লোকে কয় এ ঘটনার পর কালু জোলা ডাকাত দলে যোগ দেয়। বনগাঁর পাশে ইছামতীর চর হতে চব্বিশ পরগণার ধার ঘেঁষে সুন্দরবন অবধি তার সাথে ডাকাতি কি ঠগীগিরি করে কেউ পারেনি। কয়েকবার জেলও খেটেছে সে। বৃটিশের ভয়ানক উঁচু লাল লাল ইঁটের আসমান সমান ফাটকের পাঁচিল সে কায়দা করে টপকে পালিয়ে এসেছে আবার জঙ্গলে। তিতা মিঞার সাথে পরিচয় হবার পর সে বদলে অন্য মানুষ। ডাকাত দল ছেড়ে দিয়েছে। এখন আবার সে তাঁতে বসে টুকটাক। হেসে বলে, ‘এই হাতে আর সূতা বুনতি পারি নাকো! মানুষ কাটতি কাটতি আঙ্গুল শক্ত অই গেচে!’ কালু জোলা এখন নিয়ম করে পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। দাড়ি রেখেছে লম্বা। কপালে মোনাজাত কিম্বা ঈশ্বরের কাছে অনুশোচনার গভীর ক্ষতস্থান। ডাকাত দলে থাকার সময় সে নাকি খোদ আল্লাহকেও ভয় করতো না। তিতা মিঞার শিষ্য হবার পর থেকে এখন শুধু আল্লাহকেই যা ভয় পায়। কী জমিদার কী গোরা নীলকর আর কাউকেই সে বিশেষ গণে না।

‘তুমারে থামতে কয়েচি। কতা কি কানে গেচে তোমার?’

‘থামতি অলি তুই থাম! শালা নেড়ের বাচ্চা কোথাকার!’

‘কী কলি? শালা জমিদারের বাচ্চা জমিদার!’ বিস্মিত জোলাদের চোখের সামনে গোঁয়াড়-গোবিন্দ কালু জোলা বা অতীতের কালু ডাকাত সপাট চড় বসায় জমিদার তনয়ের গালে, ‘সাহস বেশি অয়িচে? বৃটিশের দালাল! দালালি করি চাষার জমি বন্দোবস্তি কারবারে নিয়ি মানুষকে গেরাহ্যি করো না?’

সত্যি বলতে কালু জোলার সাহস দেখে ভয়ে সাজনের প্রায় পেচ্ছাপই পেয়ে গেছিল। কিন্তু, ফলাফল খুব ভাল হলো না। রাত কাবার না হতেই জমিদারের গোমস্তা এসে কালু জোলা, সরফরাজপুরের জোলা পল্লীর সর্দারকে খুঁজে না পেয়ে তার নরম-সরম মেজ ভাইকে ডেকে নিয়ে জমিদারের কুঠিতে নিয়ে যায়। কালু জোলা আবার হুগলি শহরে গেছিল সুতার বন্দোবস্তি কাজে। তারপরের ঘটনা কী দুঃখের! কী লজ্জার! নাপিত জীবনচাঁদ শীলকে দিয়ে কালু জোলার মেজ ভাই গুলখান জোলার দাড়ি প্রথমে পেচ্ছাপে ভিজিয়ে তারপর নাকি কেটে দিয়েছে। জোলারা সেই মঙ্গলবার দুপুরেই গেলো বারাসাত কোর্টে। কে শোনে কার কথা? কোর্টের লোক উল্টো জোলাদের দিল ভাগিয়ে। সেই থেকে পরিস্থিতি থমথমে। গত বুধ আর বৃহস্পতি… দু’দিন আর নামাজ পড়া হয়নি এ মসজিদে। জোলারা ভয়ে ছিল। কালু জোলা আজ বিকেলে হুগলি থেকে ফিরেছে। ফিরেছে এক গা জ্বর নিয়ে। কিন্তু, গত দু’দিন মসজিদে নামাজ পড়া হয়নি শুনে নাকি বকাবকি করেছে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সেই নিজ গাঁয়ের পাড়ার জোয়ানদের দিয়ে আশপাশের যত গাঁয়ের তিতা মিঞার দলের ছেলেদের বলে পাঠিয়েছে যে আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়া অবশ্যই হবে।

‘ভালো কতা। বড় মিঞারা না ডেকে স্যান পাঠালো, কিন্তু, না আছে তিতা মিঞা বাদশাহ। না তার সিপাহসালার মোহাম্মদ মাসুম। না আছে কালু সর্দার। তিনি জ্বরে বিছানা নিইচেন। একুন কী করি মোরা?’ দায়েম ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে সাজনের কানে।

‘তিতা মিঞা বাদশাহ আর মাসুম সাব কলিকাতা শহরে গেচেন,’ বায়োপার ফিসফাস করে। ‘ম্যালা কিতাব কিনতি গিয়িচেন তারা। কুরান-হাদিস-ফিকাহ শাস্তরের কত বই। শরিয়ত শিক্ষার বই। নামাজ স্যান আমাগের নিজিদিরই পড়তি হবেআনে।’

‘আল্লাহ হু আকবর — আল্লাহ হু আকবর — আশাদুল্লাহ — ’ নাকারির আব্বা দিনাত মোয়াজ্জিনের ভূমিকা পালন করতে গলা খাঁকারি দিয়ে কানের দু’পাশে হাত নেয়।

‘থাম শালা নেড়ের বাচ্চারা য্যানো শেয়াল গাইচে!’ ধুপধাপ ঢিল পড়তে থাকে।

কাতার ফেলে সব প্রার্থী শনের মসজিদের ভেতর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। প্রায় তিনশ মশালের লাল আলো জিভ বের করে হাসছে। জমিদার তার পাইক-বরকন্দাজ সবই পাঠিয়েছে। সবার সামনে ষোল বছরের সেদিনকার চড় খাওয়া কিশোর পুত্র।

‘জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দে সব ছোট জেত — জেত দিয়ে মোচনমান হয়িচে — ভেবেচে পিতৃপুরুষির ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে নোতুন জেত পাবে — জেতে উঠবে — যত শ্যাক আর নেড়ে কোথাকার!’ শুভ্র ধূতি আর উত্তরীয় পরনে, কপালে রক্তচন্দন তিলক অপরূপ সুদর্শন কিশোর জমিদারতনয় উদ্দীপ্ত বোধ করতে থাকে যেন সে কোন্ রাজপুতানার বীর সেনাপতি!

দিনাত জোলা জমিদার তনয়ের সামনে দাঁড়ায়, ‘ছোট বাবু! সেদিন কালু জোলা যদি কিচু ভুল করেও তাকে, আমরা মাপ চাইচি। জানেন তো ও আগে ডাকাত দলে চেলো! গরীবের একমাত্র ধর্মস্থান পুড়িয়ে দিয়েন না গো হুজুর মিনতি করি!’

‘চুপ নেড়ে কোতাকার! সেদিন মনে চেলো না? হীরাউল্লা, বেহার গাজী, জান মহম্মদ?’

হীরাউল্লা, বেহার গাজী, জান মহম্মদ… জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর সেরা তিন লাঠিয়াল… তিনজনই ধর্মে মুসলিম তবে লাঠিয়াল বৃত্তির জন্য পুঁড়া আর শরফনগরে প্রায় চার পুরুষ ধরে বিঘা বিশেক করে নিষ্কর জমি ভোগ করে আসছে জমিদার রায় বংশের কাছ হতে… দ্বীনের চেয়েও রোজকার অন্নদাতা প্রভু তাদের কাছে বড় বিবেচনা। তিন লাঠিয়ালের হাতে মশালের গনগনে রক্ত উন্মাদনা!

‘এ নেড়েদের মুখে শুকরের মাংস গুঁজে দাও। যবনরা বুজুক কার সাতে লাগতে আসিচে!’

আগুন আর কর্তিত শুকরের মাংস ও রক্তে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে মসজিদ।

৪.
‘নামাজের জামাতে সেদিন তোমরা ক’জন মরদ কাতারে দাঁড়িয়েচিলে?’ তিতা মিঞার মুখ রুষ্ট।

‘তা’ তিতা মিঞা সব মিলিয়ে জনা সত্তর আশি।’

‘ওরা কতজন ছিল?’

‘সব মিলিয়ে তিনশোর মত!’

‘তবু, আশি জনা মিলি একটু চেষ্টা তো করতি পারতা?’

‘ওদের হাতে মশাল চেলো তিতামিঞা! ইয়া বড় বড় সব রামদা, কুঠার, কৃপাণ হাতে! লাঠি আর বন্দুকও ছিল খান দুয়েক। আর আমরা কিনা ওজু টোজু সেরে হপায় নামাজের কাতারে দাঁড়িয়েচি… লড়াইয়ের প্রস্তুতি কী মন কিছুই চেলো না!’

তিতা মিঞা বড় করে শ্বাস ছাড়েন। তাঁর কপালে ভ্রু-র গভীর কুঞ্চন আর চোখের নিচে অবসাদের কালি।

‘দারুল হরব! দারুল হরব! জমিদারের বড় তিন লাঠিয়ালই কিন্তু ধর্মে মুসলমান। সেই তারাই দুটো ভাতের জন্যি মসজিদির এ হেনস্থা করিচে! অবস্থা অলা সব মুসলমানই হিঁদুদের দলে। আবার জমিদার কি হিঁদুদেরই খুব ভালো চায়? নয় আমাগের এই দেবকি পাঠক… দেবকি আচো নাকি ভায়া… সে কোন ছোট জেতের হিন্দুও না… বামুনের ছেলের দেবোত্তর জমি নীল চাষের জন্যি কোম্পানীর এস্টর্ম সায়েবের হাতে তুলি দিতিচে না কৃষ্ণদেব রায়? আবার তারই মুসলমান লাঠিয়ালরা মসজিদি আগুন দিলো আর শুওরের মাংস ছিটোলো… শোন মিঞারা… একুন আষাঢ়ের শ্যাষ। শ্রাবণ মাস পার হতি দাও। ভাদ্দরও পার হোক। আশ্বিন যকুন যাই যাই করবি, স্যাকুন খোদ পুঁড়ায় বাবু কৃষ্ণদেব রায়ের মন্দিরে আমরা হামলা চালাতি যাব। এই তিনটে মাস সামনে শুদু প্রস্তুতি। জোয়ান চেলে-পিলেরা এ তিন মাস জোর লাটি খেলা, কুস্তি করা… আগে গতরখানা শক্ত-পোক্ত করো। মসজিদে আগুন আর শুওরের রক্ত-মাংস ফেললি আমরাও ওদের মন্দিরে গোরক্ত আর গোমাংস ফেলবো! এ খুব ভিতরের কতা। কতা পেটে রাকতি হবে। নিজির ঘরের বিবিকেও একতা কওয়া যাবে না। মেয়েমানুষ কতা এ কান ও কান হতি হতি দেখা যাবে হিঁদু পাড়ার বউ-বেটিরাও জানি গেইচে আর শেষে জমিদারের পাইক-পেয়াদা কোর্টে কেস দিয়ে সব দিবি সদরে চালান!’

‘বাদশা তিতা মিঞা!’ মাদার কারিগর হাত তোলে।

‘কত কই মিঞারা আমাকে বাদশা ডাকপা না? আল্লাহর দুনিয়ায় কেউই বাদশা নয়কো। ইসলামের পেরতেম যুগে…ছহি ইসলামের যুগে চেলেন আল্লাহর পেয়ারে বান্দা রাসুল ও তাঁর চার খলিফা। খিলাফৎ আর বাদশাহি এক বস্তু নয়। যেদিন তেকে মুসলমানের ভেতর হতি কেউ কেউ বাদশা হলো তো সেদিন তেকেই ইসলামের নাওখানা ডোবা শুরু হলো!’

‘তবু আপনাকে বাদশা ডাকতি সাদ হয় তিতা মিঞা!’

‘ঠিক আচে, মাদার কারিগর! কও তুমি কী কতি চাচ্চিলে?’

‘আমাদের গাঁও মানে সরফরাজপুরের গণ্ডগোল যে শেষ হতিই চায় না। গেল হপ্তাবারে জমিদারের লোকজন দায়েম আর কায়েমকে ডাকি নিইয়ে দাড়ির জন্যি আড়াই টাকা কর চাইলে। ও দু ভায়ের কাচে চেলোই এক টাকা। তাই দিলে। তবু, পার পেলে না! জমিদারের পাইক কইলে কি দেড় টাকা কর বাকি তাকলে তোদের। এম্নিধারা চললি পর গতি কী হয় মোদের?’

তিতা মিঞা সামান্য তিতাই হাসিলেন।

‘ক’টা দিন সবুর সহো জোয়ানেরা! তিনটে মাস গতরখানা পোক্ত করো! জঙ্গে আমরা যাবো ইনশাল্লাহ! অবশ্য তার আগে একবার বৃটিশের আদালতে যাব মোরা। মামলা করবো। জানি উপায় হবে না। উপায় যখন হবে না, তখন জঙ্গের রাস্তাই ধরতি হবে!’

*

নারকেলবাড়িয়ার বৈঠক শেষে এখন যে যার গাঁয়ে ফেরার পালা। আকাশে শুক্লপক্ষ কোজাগরি পূর্ণিমা। বাড়ি ফেরার পথে সাজন গাজির বুকটা কেমন হু হু করে। কেমন এক উত্তেজনার ভেতর সে জড়িয়ে পড়েছে। জড়িয়ে পড়েছে তার মতোই আশপাশের নানা গাঁয়ের জোয়ান ছেলেরা। এই যে দিনের একটা সময় তারা লাঠি খেলছে কী কুস্তি লড়ছে, দিনমান পাঁচ ওয়াক্ত অজু-নামাজ করছে… কিন্তু, সত্যি সত্যি কি জঙ্গে নামবে তারা? নামলে কবে নামবে? কার সাথে জঙ্গ? হ্যাঁ, জমিদার, নীলকর আর গোরা সৈন্য তাদের শত্রু। কিন্তু, মুসলমানও সবাই তাদের দলে নেই। একটু ভাল যাদের অবস্থা তাদের মনেই জমিদারের প্রতি ভয়-ভক্তি বেশি। তারা আবার সাজন গাজিদের নিয়ে ঠাট্টা করে। বলে কি লাঠি দিয়ে বন্দুকের সাথে লড়া যায় না। বাড়ির ভেতর খোদ মা মানত-ব্রত বন্ধ হবার ভয়ে ভয় পায়। মাকে তবু জোর করে হিঁদু বেটিদের মতো শাখা-সিঁদুর ছাড়িয়ে বুরকা পরানোর অভ্যাস চলছে। মা খুব তকরার করে। এয়োতি স্ত্রীলোক শরীরে এয়োতি চিহ্ন না রাখলে সাজনদের বাপেরই ক্ষেতি। সে কি তবে বেধবা হবে? সাজনরা বুঝায় যে এসবই মায়ের কুফরি বিশ্বাস। বাপ পুরুসউল্লাহকে যতই ধুতির কোঁচা ছাড়িয়ে দু’পা ঢেকে ধুতি পরতে বলা হোক, সে বুড়োও তকরার করবে।

‘তিন বেটা মিলে নবাবি করচিস। চাষ-বাস একদিন করিস কী একদিন ঢুঁ ঢুঁ। কী সব লাঠিখেলা আর কুস্তি! তাও যদি জমিদারের কাচারিতে একটা চাকুরি জুটতো তোদের! নীলির জমি বাদ দিয়ি এক বিঘা জমি ভাগে বর্গাদার সামলে ক্ষেতি করা আর ভিটের কাচের সব্জি ক্ষেতের লাউটা-কুমড়োটা হাটে বেচে তোদের সবার মুখে একমুঠো ভাত দিই। এদেশে হিঁদুরা সংখ্যাতে ভারি। হিঁদু জমিদার। হাটে-বাজারে দাড়ি মুয়ে আর কোঁচা খুলে পাখানা ঢেইকে ধুতি পইরে গেলেই তিতা মিঞার লোক ভেবে আমার সওদা-পাতি কেউ কেনপে নানে! তোমরা শখ করি জঙ্গ করো বাবারা! মোর সংসার মুই সামলে নিই আগে! আর সত্যি যেদিন জঙ্গ হবে, জঙ্গে তোমরা জিতলি পর মুই তোমাদের দলে আচি! না জিতলি নাই!’ বুড়ো এরপর এমন বিকট হাসি দেয় যে ঘেন্নায় পিত্তি জ্বলে সাজনের। হোক না জন্মদাতা বাপ। দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষই ভিতুর ডিম কোথাকার! নতুন কিছুর জন্য লড়তে ভারি ভয় তাদের! নদীর উজান যেপানে, তারাও সেইপানে! কুনো মানে হয় এসবের?

‘তুমি সাজন গাজি তো? তিতা মিঞার বাদশাহি দলের গায়েন মহারাজা?’

বাবড়ি চুলের আর কাঁচা-পাকা দাড়ির জোব্বা পরা এই লোকটাকে ইদানিং নারকেলবাড়িয়ার বৈঠকে ক’দিন ধরে সাজন দেখেছে মনে হয় তবে সেইভাবে লক্ষ্য করে নি। লোকটা কি এ অঞ্চলেরই? ওবাব্বা… কতা-বার্তার ঢং-ঢক তো বেশ!

‘আজ্ঞে…থুক্কু! জ্বি, হ্যাঁ…’

‘গান তো ভালোই বান্দো ছোকরা!’

‘আপনি কি ইদিককার মুনিষ্যি?’

‘তোমরা নদের লোক… আমি ধরো গে কুষ্টের… কুষ্টে আর নদে তো একই জেলা… আমি গড়াই নদের পারে হোতা তাকি!’

‘তো ইদিকি যি? কী মনে করি?’

‘তিতা মিঞার নাম-ডাক তো একুন সর্বত্র। তাই দেকতি আলাম স্বচক্ষে!’

সাজন একটু ভাল করে তাকিয়ে দ্যাখে। লোকটার ঢিলা-ঢালা বহুদিনের জোব্বার বাম কাঁধে ঝোলানো ঝোলা হতে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে একখানা একতারা।

‘আপনিও গান-বাজনা করেন নাকি?’

‘গুরু আর দিলে কই তেমুন ক্ষ্যামতা? হতি পারতাম লালন সাঁইয়ের মতো রত্ন একখান!’

‘লালন সাঁই কেগো?’

‘তোমাদের ইদিকে তাঁর নাম একুনো তেমন একটা আসে নি বোদায়। কুষ্টে তে তার পালা লোকে পতঙ্গের মতো শোনে!’

‘নামখানা জানতি পারি আপনার?’

‘কেন নয়? মোর নাম বাবা চেরাগ শাহ!’

‘বুয়িচি। আপনি আউল-বাউল কী কর্তাভজা কেউ হবেন। এই জঙ্গের দলে ক্যানো আসিচেন?’

‘এই বাবা শুনলাম তিতা মিঞা গরীব চাষাগের বাঁচাতি দল গড়িচেন। নীলকর, জমিদার কী কোম্পানীর সাথে জঙ্গের জন্য আওয়াজ দিতিচেন। তাই তে দেকতি আলাম! তাও প্রায় মাসখানেক হইয়ে আসিচে!’

‘হতি পারে। মাঝখানে আষাঢ় মাসে ঘর-গেরস্থালির কিচু কাজে আটকা পড়িচিলাম। সব জমায়েতে আসা হয়নি।’

‘তোমার গাঁয়ের আর কেউ আসে নি কো আজ?’

‘মোর নিজির ঘরেই ভাই আচে দু’জনা। কিন্তু, ঐ বাড়িতে কামে আটকা পড়িচে। গ্রামে তিতা মিঞার দলের শিষ্য আমরা তিন ভাই বাদে আচে আরো ছয় জনা। চারজনা মুসলমান আর দুইজনা হিন্দু। হিন্দু দু’জন গেল দুই বৈঠকে আসে নিকো। মুসলমান চারজনার আরো তিনজনা আমার সাতেই আসিচে। তিনজনারই আবার এগাঁয়ে কুটুম্ব ঘর আচে। তাই আজ রাতে একেনেই কাবার করবে।’

‘তাই ভাবি যে এ বাপধন দেকি একা একা হাঁটা ধরিচে! ইদিকি আসার পর হতি এক মাস মুয়ে কুলুপ আঁটি শুদু বৈঠক দেকচি, সবেতার কতা শুনচি। আজ মনে হলো কি একটু হাঁটা-চলা করি কী সবার সাতে কতা-বার্তা কই!’

‘থাকা হচ্ছে কুতায়?’

‘তিতা মিঞার ডানহাত যে লোকটা…’

‘মোহাম্মদ মাসুম?’

‘হাঁ… মোহাম্মদ মাসুমের ঘরেই!’

‘ওনাকে বইলে নিয়ে বের হয়িচেন তো?’

‘কী বলাবলি বাপ! মেয়েমানুষ তো নই! তাছাড়া আমার ঘর-সংসার নেই। দু’দিনের অতিথি। দেকতে আসিচি বৈ নয়। সে তারা জানেন। কাজেই, কোনো আটক-নিয়ম তো কিচু নাই।’

‘কেমন বোদাচ্চে?’

‘বসপা নাকি এট্টু বাবা? এট্টু জিরিয়ে নিই! সেই সাথে একটু তাংকু সেবন!’

‘বসতি পারি। তবে, তাংকু সেবনে তিতা মিঞার মানা আচে!’

*

চেরাগ শাহ একথার জবাবে সামান্য হেসে একটা মস্ত পিপুল গাছের নিচে বসে পড়ে। গাছের ডালে ডালে ঝুলছে মাটির ঘোড়া, পুতুল কি এয়োস্ত্রীদের দেওয়া অনেক তাবিজ-কবজ। ক’দিন আগে হিন্দুদের ইতুর ব্রত গেছে।

‘কলেন না তো?’

‘কী কলাম নাকো?’

‘এই আমাদের জঙ্গের প্রস্ততি কেমন লাগচে?’

‘মাত্র মাসখানেক দেখিচি। এ কতায় কী কতা কব?’

‘তবু একটা ভাব হয় না মাসখানেক দেকার পর?’

‘এ ন্যায়ের সাতে অন্যায়ের যুদ্দো। তয় বৃটিশের হাতে এত ক্ষ্যামতা যে শেষপর্যন্ত কে যে জিতবি তা ক্যামনে কই!’

‘আচ্চা, একটা কতা শুদোই। আপনি যে আউলে লোক তো বাদশা তিতা আপনাকে জায়গাই বা দেলেন কেন? মারফতি লোক তার দু’চোকের বিষ!’

‘আল্লাহর আসমানের নিচি সব চাষাকে যে সমান জমি দিতি চায়… তার চেয়ে বড় মারফতি আর কে আচে? ফকির কি আউল-বাউল মুয়ে কন পচন্দ করেন না, আবার তো এক মিস্কিন শাহ আচেও তার দলে। মিস্কিন শাহ নাকি কামানের গোলা মুখ দিয়ে গিলতি পারে। বৃটিশের কামানের পাল্লা দিতি তাকে এনেচেন। পুরা শরিয়তি মানতি গেলি তো ফকির মানা যায় না! সাধক-সাধনা কি ফকিরের কেরামতি মানা যায় না! আমাকে আউল-বাউল জেনেও তো জায়গা দেলেন। আমার মনে হলো কী উনি য্যানো এট্টু ধন্দে আচেন। কুন পতে যাবেন? একদিকে ওনার গুরু শাহ্ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী। সেই গুরু কড়া শরিয়তির পতে হাঁটে। তার কতা মানতি গেলে দুনিয়ায় মুসলমান বাদে সবাই কাফের। সবাই শত্রু। এমন কি মুসলমানের ভেতরেও সবাই খাঁটি মুসলমান নন। তিতা মিঞা গুরুবাক্যও ফেলতি পারেন না। কিন্তু, অন্তরে তার ভিন্ন জেত বলেই যে সমান মার খাওয়া বা সমান মজলুম… তার প্রতি কোনো ঘেন্না নেই!’

‘সে ত তিনি ছোট জেতের হিন্দুদের দলে থাকতি কয়েচেন। তাদের তো বারোতি কননি!’

‘তা না হয় কননি। কিন্তু, তোমাদের দলের যে নিয়ম-কানুন… পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ-রোজা, দাড়ি রাকো রে, মানত-আচার সব বন্দো করো রে… হিন্দু দূরের কতা, সব মুসলমানই কি তার কতা মানতিচে?’

‘অনেকেই মানতিচে। তয় সবাই মানতিচে না যে সে সত্য!’

চেরাগ শাহ হাসে, ‘তা এই তো বাবা… দেকতি এয়েচিলাম তিতা মিঞার জঙ্গের প্র¯ত্ততি! নয়ন জুড়োয়ে দেকলাম। হ্যাঁ, গোরা বৃটিশও তিতা মিঞাকে নিয়ি ভয় পাতিচে, সেটা কিন্তু বড় কতা।’

‘নয়? তিতা মিঞাই আমাদের বাদশাহ!’

‘আচ্চা, তুমি র্ঠিক করি বুকি হাত দিইয়ে কও তো ছোঁড়া… এই জঙ্গে তুমি কেন?’

‘যাতে নীল বুনতি না হয়, য্যানো ভুঁইয়ে ধান বুনতি পারি… য্যানো জমিদারের পেয়াদারা দু’বেলা খাজনার জন্য হামলা না করে, য্যানো আমার দ্বিন আমি পালন করতি পারি! এই যে দেবকি পাঠক তো বামুনের ছেলে হয়েও আমাদের দলে গোপনে আচে। আজো বৈঠকে চেলো। সে মাসিয়া গ্রামের ছেলে। ওদের দেবোত্তর জমিতেও নীল চাষের হুকুমি দিয়িচে কোম্পানী। সে কৃষ্ণদেবের দুয়ারে ধন্না দিয়েও নীলের দাদন হতি জমি ছাড়াতি পারে নিকো! জানেন, আজ কোজাগরি পূর্ণিমা না? দেবকিদের দেবোত্তর জমিতি আগে খোলা মাঠে লক্ষী পূজো হতো। ছোটবেলায় অনেক গিইচি। মাসীমা পূজা শেষ হলি পর প্রসাদ দেতেন। একুন সে জমিও নীলকরের গর্ভে গেইচে। দেবকি আমার চেয়েও তিতা মিঞার বেশি শিষ্য! দেবকি কয় কি কৃষ্ণদেবের হিঁদুয়ানি সব লোক দেকানো। নয় অসহায় বামুনের অল্প-স্বল্প দেবোত্তর সে নীলকর এসটরম সায়েবরে কয়ি বুজি চাড়াতি পারতো না? ’

‘দারুণ। দেকলাম সবই। কুষ্টে গিয়ে তোমাগের জঙ্গের কতা সবারি জানাবো!’

‘ও আপনি তাহলে ম্যালা দিন থাকপেন নাকো?

‘নাগো… আমি ফের আমার দেশ কুষ্টে চলে যাবো। আমাদের নতুন গুরু লালন সাঁইয়ের আখড়ায়! আমি য্যানো কুনো জঙ্গেরই লোক নই আসলে!’

‘লালন লালন করতিচেন বহুক্ষণ। তাঁর গান কীরম? শুনতি পাই?’

চেরাগ শাহ আবার হাসে। প্রথমে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বই পড়ার মতো করে পড়ে,

‘…একটা নারকোলের মালা,
তাতে জল তোলা ফেলা…
করঙ্গ সে –
চৈতে-নিতাই-অদ্বে পাগল হাল ধরেছে,
তোরা কেউ যাসনে সে পাগলের কাছে!’

ধীরে ধীরে ধ্যানস্থ পাঠ হতে হঠাৎই সুরের ঝাঁকি খায় সে আবৃত্তি!

‘তিন পাগলের হলো মেলা নদেয় এসে…
তোরা কেউ যাসনে সে পাগলের কাছে!’

গান শেষ হলে অভিভূতের মতো বসে থাকে সাজন গাজি। তার এই একুশ বছরের জীবনে শৈশবে সে গাজির গীত, নাতে রসুল, মনসা পাঁচালি, কালিকা পুরাণ, পদাবলী কীর্তন, দোভাষী পুঁথিপাঠ… নানা কিছু শুনেছে ও শিখেছে। যেদিন থেকে নিজে পালা গান বাঁধা শুরু করলো, তখন শুরুতে কিছু আল্লা-রসুল বন্দনা, মহেশ্বর-পাবর্তী বন্দনা, ইউসুফ-জোলেখা, রাধা-কেষ্ট পালা রচনা… এসবই করতো। ইদানিং নামাজ-রোজার মাহাত্ম্য, জমিদারের পেয়াদাদের উৎপাত এসব বিষয়েই গান লেখে বেশি। কিন্তু, আজ যে গান শুনলো, তা’ একদমই অন্যরকম।

‘যাই হে! অনেক রাত করিয়ে দেলেম তোমায়!’

‘আপনি মুনিষ্যিটা ম্যালা রহস্য। আসবেন আবার বাবা। আপনার লালন সাঁইয়ের গান ভালো তয় এ গানে জঙ্গ হয় না, অপমানের বদলা নেওয়া যায় না! নমষ্কার… থুক্কু, খোদা হাফেজ!’

চেরাগ শাহর দু’পাশের ঠোঁট আবার হাসির ঢঙে মোচর খায়, ‘আসি গো!’

৫.


‘‘গোলাম মাসুম বলে ভেবে মোক…
পঁচিশ জন লোক সাথে পৌছাল তখন
ফজরেতে কেষ্টদেব পেয়াজদা পাঠাইল
লক্ষিকান্ত আসিয়া যে খাজনা চাইল।
দায়েম বলে খাজনা দেই কোনকালে!”


ভিতরে ভিতরে জ্বলছে সবাই। তিতা মিঞার আন্দাজই ঠিক ছিলো। কোথায় জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তার দলবল নিয়ে তল্লাটের সাত গাঁয়ের ভেতর মুসলমানদের একমাত্র শনের মসজিদ খানা পুড়িয়ে দিল, তা না কৃষ্ণদেবই আগে আগে বারাসত শহরের বাদুড়িয়া থানায় গিয়ে বৃটিশের কাছে গিয়ে মামলা ঠুকেছে যে তিতা মিঞার লোকেরা নাকি তার কোন্ কোন্ পাইক-বরকন্দাজকে ক’দিন আটকে রেখে অত্যাচার করেছে আর নিজেরাই নিজেদের মসজিদ পুড়িয়ে দিয়েছে জমিদারকে হেনস্থা করার জন্য। বারাসত থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তী কৃষ্ণদেবের আত্মীয়। সে তদন্তের নামে কয়েকদিন সরফরাজপুর গ্রামে ঘোরাঘুরি শেষে রিপোর্ট দিল যা তা, ‘…জমিদারকে ফ্যাসাদে ফেলিবার জন্যই তিতুমীরের লোকেরা নামাজ-ঘর পুড়াইয়া দিয়াছিল।… জমিদারের নামে যে অভিযোগ আসিয়াছে তাহার প্রমাণ হইল না।’ মসজিদে আগুন লাগানোর পর ক’দিন জমিদার কোলকাতা শহরে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। তার ক’দিন পরই বারাসতে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে গিয়ে বলেছে ‘আমি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কিছুই জানি না। এই দাঙ্গার সময় আমি কলিকাতায় ছিলাম।’ গোরা ম্যাজিস্ট্রেট সুন্দর কৃষ্ণদেবের কথাই বিশ্বাস করে উভয় পক্ষকেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে পাঁচশ টাকা জরিমানা করলেন। দোষী আর যার উপর দোষ করা হয়েছে তাদের একই শাস্তি। উল্টো তিতা মিঞার লোকজনের কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করা হয়েছে যে তারা আর এলাকায় ঝগড়া-ফ্যাসাদ করবে না। তা গোরা ম্যাজিস্ট্রেট এহেন ধারা ব্যবহার করবে বৈকি! এই গোরার দল প্রায়ই তো জমিদার বাবুর বাড়ি এসে খাওয়া-দাওয়া করে। কৃষ্ণদেব রায়ের নায়েব লক্ষিকান্ত গতকাল ফজরের সময় দায়েম কারিগরের বাসায় পেয়াদা পাঠিয়ে হাঁকাহাঁকি করে নামাজ থেকে টেনে তুলে কাচারি ঘরে নিয়ে গেছে। দাড়ি রাখার জন্য আড়াই টাকা কর ছাড়াও কী কী নাকি অনাদায়ি খাজনা মিলে মোট আটত্রিশ টাকা বাকি আছে তার।

‘এ ঠিক করতিচো না লক্ষিকান্ত বাবু! আল্লার কসম তোমাগের কাচে কোনো খাজনা বাকি নাই আমার। দাড়ি রাকা আমার দ্বীন, আমার ধর্ম। এজন্য তুমি আমার কাচ হতি আটত্রিশ টাকা অনাদায়ের নামে মিথ্যে খাজনা চাইতি পারো না!’

‘ওসব শুনবো নানে! ভাল করি ১৭৯৯ সালের আইনির ৭ নম্বর ধারাটি পড়। খাজনা বকেয়া থাকলি জমিদার যে কুনো সময়, যে কুনো প্রজাকে কয়েদ করতি পারে।’

‘খাজনা বকেয়া আমার নেই কো!’

‘আচে! আমার কাচে সব হিসাব আচে! তারপর ফোর্টুলিয়ম (ফোর্ট উইলিয়াম) হতি গত বছর নতুন আইন করিচে যে নীল চাষের জন্যি দাদন নিলি নীলির চাষ করতিই হবে। না করলি তা বেআইনী! তোরা শালা গেল বছর খরায় জমির বন্ধক ছাড়াতি দাদন নিয়ি টাকা নিস নাই? একুন সব ধান ধান করতিচিস ক্যানো? নীল চাষ করতি হবি! নয় জমিদার বাবু সদরে কেস দিবি তোমাদের নামে!’

‘দাও পাল্লে! মিথ্যি খাজনার টাকা আমি দেব না। টাকা আমার নেইও কো নায়েব মশায়। থাকলি পর আমার দিতি আপত্তি কী? জেলখানায় নিলি খারাপ কী? কদিন বিনে পয়সায় তিন বেলা খেয়ে আসবো পর!’

লক্ষিকান্ত অবশ্য কী মনে করে সেদিন দায়েম কারিগরকে আর কয়েদ খানায় আটক করেনি। তবে, তিতা মিঞার কাছে সেই সন্ধ্যায়ই এসে কেঁদে পড়েছিল।

‘উঁচু জেতের অত্যাচারে আপনার কাছে বছর তিন হয় ইসলাম কবুল করিচি তিতা মিঞা! ছিলাম তšত্তবায়ের ছেলে, জাতে যুগী। কেউ আমার হাতের জল খাতো না। ইসলাম কবুলের পর হলাম গে জোলা। একুনো কেউ আমার ছোঁয়ার জল কী পানি খায় না! সে কেউ আমাকে মান দিলো কি না দিলো সে খোঁজ রাকি নে গো! হাটে গেলে ধূতিখানা এখন তবন্দের মতো করে পরি বলে কতজনা ঠাট্টা করে কী, ‘দায়েম, তোর ঐ অঙ্গখানা বড় হয়ে গেচে নাকি?’ সে-ও কিচু মনে করি নে! কিন্তু, আপনার কতায় দাড়ি রেখে, ধূতিখানা তবন্দের মতো করে পরার দোষে যে আটত্রিশ টাকা খাজনা দিতি হবি! এতো টাকা মুই পাই কনে?’

‘কেন দায়েম? আমি তোমার হাতের পানি খাই নি কো? তোমার সাতে নারকেলবাড়িয়ার মইজুদ্দিন বিশ্বাসের বাড়ি আর সরফরাজপুরে ভোলা জোলার বাড়িতি এক পাত্রে জেয়াফতের খাওয়া খাই নি কো? সত্যকারের ইসলাম জোলা সৈয়দ কিচু মানে নাকো! ও হিঁদুদের সাতে মিশে মিশে বেশরা হবার ফল! আর ধূতি তবন্দের মতো পরার জন্যি যে যা বলে বলুক! ওটাই আমাদের দ্বীন। আমি আজ কৃষ্ণদেব রায়ের কাচে চিটি পাটাবো! জানি সে তার বজ্জাতি এতে থামাবে না। তবু, এরপর আবার আদালতে যাব। ফলাফল হবে না সেও জানি। কিন্তু, এসব চাপান-উতোরের ভেতর হতি আশ্বিন মাসের শেষ অব্দি আমাদের জঙ্গের প্রস্তুতির জন্যি সময় লাগবি। সাজন!’

সাজন গাজি এসে দাঁড়ায়।

‘তুমি তো মিঞা ভাল গান বান্ধো! বাংলাও লিকতি পারো ভালোই। আমি সহি করে দেব। আমি মুখে মুখে মুসাবিদা কচ্চি। তুমি লেকো।’

‘২রা সেপ্টেম্বর, ১৮৩১ সাল,
নারকেলবাড়িয়া, বারাসত মহকুমা, ২৪ পরগণা জেলা।

অত্র অঞ্চলের জমিদার মাননীয় কৃষ্ণদেব রায় মহাশয়,

বিনীত নিবেদন এই যে আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নাই। যদি কেহ আমার বিরুদ্ধে আপনার নিকট কোন মিথ্যা কথা বলিয়া আপনাকে উত্তেজিত করিয়া থাকে, তাহা হইলে আপনার উচিত ছিল সত্যের সন্ধান করিয়া হুকুম জারী করা। আমি দীন ইসলাম জারি করিতেছি। মুসলমানদিগকে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দিতেছি। ইহাতে আপনার অসন্তোষের কি কারণ থাকিতে পারে? ওয়াহাবী ধর্ম নামে দুনিয়ায় কোন ধর্ম নাই। ইসলাম শব্দের অর্থ হইতেছে শান্তি। ইসলামি ধরনের নাম রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছোট করা, ইদুল আজহার কোরবানি করা ও আকীকা কোরবানি করা মুসলমানদিগের উপর আল্লাহর ও আল্লাহর রসুলের আদেশ। আপনার কাছে একান্ত মিনতি যে আপনি ইসলাম ধর্মের আদেশ, বিধি-নিষেধের উপর হস্তক্ষেপ করিবেন না। আমি আশা করি আপনি আমার দলের লোকদের দাড়ি রাখার উপর আড়াই টাকা কর আরোপের হুকুম প্রত্যাহার করিবেন। ফক্ত-

হাকির ও না-চিজ
সৈয়দ নিসার আলি ওরফে তিতুমীর।’

৬.
পুঁড়া গ্রামের জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাগান বাড়িতে আজ বিজয়া দশমীর পরের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রবল উৎসব ও সেই মহালয়া হতে ষষ্ঠী-সপ্তমী-মহাষ্টমী-মহানবমী-দশমী পেরিয়ে গত ক’দিনের আরতি, প্রসাদ ভোগ আর বিসজর্নের শোভাযাত্রার সমস্ত আনন্দ-উল্লাস শেষে এই পুনর্মিলনী অপেক্ষাকৃত নির্দিষ্ট কিছু মানুষের ভেতরের এক ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠান। জলসাঘরে অতিথিদের সবার হাতে হাল্কা বিদেশী মদ্য। সামনে রুপার নানা রেকাবিতে রাখা লুচি, নিরামিষ ও পাঁঠার মাংস, ভুনা খিচুড়ি ও কয়েক রকম সন্দেশ ও দই। এসেছেন বারাসত কোর্টের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার সাহেব, রুদ্রপুর ও মূলনাথ গ্রামের নীলকর ডেভিড অ্যান্ড্রুজ সাহেব, বারঘরিয়া আর হুগলির নীলকুঠির মালিক উইলয়াম স্টর্ম ও তার ম্যানেজার পাইরন সাহেব (গাঁয়ের লোকে ডাকে পিঁরো সায়েব), আলীপুরের সার্কিট কমিশনার ই, আর, বারওয়েল, তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ণ নাগ, নাগরপুরের গৌরপ্রসাদ চৌধুরী বাবু, সরফরাজপুরের জমিদার কালিপ্রসন্ন মুখুজ্যে আর গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়, খাসপুর গ্রামের ইয়ার মোহাম্মদ ও পূর্ব বাংলার সিরাজগঞ্জে ইয়ার মোহাম্মদের চাচাতো বোনের স্বামী সৈয়দ আবুল বাশার সাহেব। ঝাড়লণ্ঠনের সামান্য দূরে বসে এলাহাবাদ হতে আসা বাঈজি ঠুংরি পরিবেশন করছিল, ‘বাজুবন্দ খুল খুল যায়!’ অতিথিদের কারোরই পানাহারে কী বাঈজি পরিবেশিত সঙ্গীতে তেমন মন নেই। সবাই একটা চাপা উত্তেজনায় ভুগছেন।

‘ইহা অতি দুঃখজনক হইলো — ইট ইজ ভেরি আনফর্চ্যুনেট দ্যাট ইন্ডিগো ইজ লুজিং ইটস মার্কেট ক্রেইজ ইন ওয়েস্ট পার্টিক্যুলারলি ইন মার্কেট অফ লন্ডন — স্টিল উই মাস্ট হোল্ড দ্য লিস্ট মার্কেট উই ক্যান — পরিতাপের বিষয় যে পশ্চিমে নীলের যে হঠাৎ বাজারদর উঠিয়াছিল উহা কমিয়া আসিতেছে — তবু, যেটুকু নীলের বাজার আছে তাহাই আমরা ছাড়িতে পারি না!’ ডেভিস অ্যান্ড্রুজ হুইস্কির গ্লাসে বরফ নাড়তে থাকেন।

‘শিওর, দ্য রাইওতস্… দ্য নেটিভ পিজ্যান্টস্ অফেন টেন্ড টু ডিজওবে দ্য ইন্ডিগো প্ল্যান্টারস্… হেই জমিন্দার বাবুস অ্যান্ড সাহিবস… ইউ দ্য হিন্ডু অ্যান্ড মুসলিম ল্যান্ডলর্ডস… ক্যানট ইউ লুক ফর আওয়ার ইন্টারেস্ট? ক্যানট ইউ প্রেস দিজ ফার্মারস্ টু এনশিওর ম্যাক্সিমাইজিং অফ দ্য ইন্ডিগো প্ল্যান্টেশন? হিন্দু ও মুসলিম সকল ভূস্বামীগণকে কহি আপনারা কি আমাদের স্বার্থ রক্ষা করিতে পারেন না? চাষীদের দ্বারা সর্বোচ্চ নীল চাষের ব্যাপারটি কি নিশ্চিত করা যায় না?’ স্টর্ম চামচে করে দই চাখেন।

‘দিজ রাইওতস্… দ্য হ্যাগার্ড পিজ্যান্টস ক্রাই ফর ওনলি প্যাডি… এই চাষাগণ শুধু ‘ধান’ ‘ধান’ বলিয়া ক্রন্দন করে… হোয়াই? হেই বাবুস এণ্ড সাহেবস… উই আর সেটিং আপ কোর্টস অ্যান্ড পুলিশ… লিগ্যাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিক্যুরিটিজ ফর ইওর প্রটেকশান… উই হ্যাভ বেস্টোওড ইউ উইথ দ্য পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট… আমরা আপনাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধা দিয়াছি… দ্যাট সেটেলমেন্ট হ্যাজ টু মেনি ক্লজেজ টু ফোর্স দ্য পিজ্যান্টস্ ফর ইন্ডিগো প্ল্যান্টেশন… ঐ বিধির নানা অনুচ্ছেদে চাষীদের আপনারা নীল চাষে বাধ্য করিতে পারেন!’ পাইরন মাথা নাড়েন।

‘অবস্থা ভাল নয়,’ কৃষ্ণদেব রায়ের বিধবা বড় দিদির সন্তান অতনু দেব রায়চৌধুরী, সদ্যই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও শেক্সপীয়র মুখস্থ বলতে পারেন, মামাকে ইংরেজি ভাষায় সহায়তা দিতে এই আসরে উপস্থিত, ‘কন্ডিশন ইজ নট টু গুড স্যার! হ্যাভ ইউ হার্ড অফ তিতুমীর? এ ফলোয়ার অফ সৈয়দ আহম্মদ শহীদ। দে কল দেমসেলভস্ ওয়াহাবি… হি ইজ ক্রিয়েটিং ক্যাওস এগেইনস্ট অল দ্য ল্যান্ড-ওনিং ক্লাসেস ইন দ্য রিজিওন অ্যান্ড গেদারিং দ্য হ্যাগার্ড পিজ্যান্টস্ এগেইনস্ট দ্য জমিন্দারস অ্যান্ড ইন্ডিগো প্ল্যান্টার্স!’

‘তিতুমির মহম্মদীয় ধর্মের কি? সে কি উগ্র ধর্মবাদী? ইজ হি আ রিলিজিয়াস ফ্যানাটিক?’ আলেকজান্ডার প্রশ্ন করেন।

‘আই এ্যাম অলসো আ মোহামেডান! বাট উই, দোজ ভেরি হ্যান্ডফুল অফ মোহামেডানস্, হু আর ট্রাইং টু ব্রেক রিলিজিয়াস সুপারস্টিশন্স অ্যান্ড গেটিং হায়ার এডুকেশন ইন ইংলিশ… উই এলিট মোহামেডানস নাউ থিঙ্ক ইট প্রপার টু পে ফেইথ অ্যান্ড লয়ালটি টু দ্য ব্রিটিশ রুল!’ ইয়ার মোহাম্মদের চাচাতো বোনের স্বামী ও সিরাজগঞ্জ হতে পাবনা-কুষ্টিয়া অবধি বিস্তীর্ণ জমিদারির মালিক ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন শাস্ত্রে সদ্য স্নাতক সৈয়দ আবুল বাশার বলেন। ভগ্নীপতিকে ইংরেজিতে আলাপচারিতায় সাহায্যের জন্য তার আজকের এই আসরে উপস্থিতি।

‘হোয়াট… হোয়াট ইজ তিতুমীর এ্যাকচুয়ালি ডুয়িং?’

‘হি ইজ পুলিং অল দ্য পিজ্যান্টস্ অ্যান্ড আর্টিসানস পার্টিক্যুলারলি দ্য ওয়েইভারস্… পুওরেস্ট অফ দ্য পুওরস অ্যান্ড দ্য আনটাচেবল কাস্টস বোথ উইদিন দ্য হিন্দুস অ্যান্ড মুসলিমস্ টুগেদার টু স্ট্যান্ড এগেইনস্ট দ্য প্রিভেইলিং সোশ্যাল অর্ডার অ্যান্ড হায়ারার্কি!’ অতনু দেব রায়চৌধুরী উত্তর করেন।

‘গড… হি ইজ অ্যান অ্যানার্কি দেন…!’

‘অতনু, সায়েবকে বলো যে তিতুমীর আর তার দলবল এখন জমি না চষে, তাঁত না বুনে শুদু ধম্মো-কম্মো করচে! মুসলমানদের খেপিয়ে তুলচে দাড়ি রাখার জন্যি!’

‘এই ওবা (ওহাবী)-দের কথা আর বলবেন না! আমরা সিরাজগঞ্জবাসী মুসলমানগণ ওহাবীয়তরূপ ‘ওবা’ (কলেরা) হইতে খোদার ফজলোয় এতদিন নিরাপদে ছিলাম। কিন্তু, প্রায় দুই তিন বৎসর গত হয় আমাদের সিরাজগঞ্জে কয়েকজন ওহাবী মৌলবীর আমদানী হয়েছে মশায়! এরা ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ আর ‘ভেড়ার দলে বাছুর প্রামাণিক’ হতে ওহাবী মতের বিস্তার আর হানিফি মতবাদের বরখেলাফ ও ছুন্নত জামায়েতের আকায়েদের উল্টো আকায়েদ ও মছলা মাছায়েল সব চাষা আর জোলার ভেতর প্রচার করে আশরাফ মুসলমানদের পাল্টা খাড়া করছে!’ সৈয়দ আবুল বাশার হাসিমুখে তামাকের গড়গড়ায় হাত বাড়ান।

‘এই ছোটজেতের ওবারা কুনো ইমাম বা মোজতাহেদের কতা শুনবি না! সবাই এক/একজন মোহাদ্দেজ… মানে মশায় আপনাদের ভেতর যাকে বলে ধম্মোশাস্তরে পণ্ডিত… প্রত্যেকেই পণ্ডিত হইয়ি বসি আচে!’ ইয়ার মোহাম্মদ এক খিলি তবক দেওয়া পান মুখে পোরেন।

‘কিপ দিজ তিতুমীর অ্যান্ড হিজ ফলোয়ার্স উইদিন পার্মানেন্ট ফিয়ার অ্যান্ড টেরর!’ কুঞ্চিত ভ্রু নীলকর ডেভিস অ্যান্ড্রুজ পানপাত্রের শেষ তরলটুকু গলায় ঢালেন।

৭.
পুঁড়া গ্রামের বারোয়ারী তলায় সেদিন সকাল হতেই পূজা আর যাত্রার ধূম। ইংরেজের কালে ইংরেজের ক্যালেন্ডার বলে কথা। আগে গাঁয়ের সবাই বৈশাখ হতে চৈত্র অবধি বারো মাস গণত এক হিসেবে। এ গাঁয়ে জমিদার বাবুর ভাগ্নে অতনু একটা স্কুল খুলে হেডমাস্টার হয়েছে যেখানে ছেলেরা ইংরেজিতে গ্যাট ম্যাট ক্যাট তো শিখছেই নতুন নতুন মাসের নামও বলছে। এই তো এবার দুর্গা মায়ের পূজা শেষ হতে হতে আশ্বিনের তৃতীয় হপ্তা পেরোলো। হিঁদুদের তো পূজার শেষ নেই। এক হপ্তা না যেতে লক্ষী ঠাকুরুণের পূজা শেষ। আরো এক হপ্তা না হতেই শ্যামা মায়ের পূজা শুরু। কাল রাতে শ্যামা পূজা। এ উপলক্ষ্যে বারোয়ারী তলায় সকাল হতে যাত্রা, রামায়ণ গান আর পূজার তোড়জোর।

‘নারায়ে তকবির — আল্লাহু আকবর! নারায়ে তকবির — আল্লাহু আকবর!’

দূর থেকে প্রায় পাঁচশো মানুষের এক মিছিল আসছে। মিছিলের মানুষগুলোর হাতে খোলা তলোয়ার, লাঠি ও বল্লম। ইতোমধ্যে মিছিলের এই মানুষেরা খোদ কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ির ফটক হয়ে ঘুরে এসেছে। তিতা মিঞার মানুষেরা তরবারি, লাঠি আর বল্লম নিয়ে জমিদার বাড়ির ফটক ঘিরে ধরলেও সেই ফটক ততক্ষণে ভেতর হতে বন্ধ করা হয়ে গেছিল। জমিদার বাড়ির পুরুষ সদস্যরা বাড়ির ছাদ হতে সমানে ইট ফেলতে থাকলে তিতা মিঞার লোকজন জমিদার বাড়ি ছেড়ে গ্রামের বারোয়ারী তলায় আসে। এখানে জমিদারের স্থাপিত মন্দির তাদের লক্ষ্য। তিনমাস জমিদারের পাইক-বরকন্দাজ তাদের শনের মসজিদ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল আর শুকরের মাংস ও রক্ত নিক্ষেপ করেছিল। আজ এই মন্দিরে গো মাংস ও গোরক্ত নিক্ষেপ তাদের জঙ্গের প্রথম লক্ষ্য।

‘ওগো মাগো রক্ষে করো গো — ঠাকুর!’

মুহূর্তে উদ্ভ্রান্ত ছুটতে থাকে শ’য়ে শ’য়ে নারী-শিশু ও এমনকি নিরীহ গৃহস্থ পুরুষেরা যারা এখানে এসেছিল নিছকই উৎসব-অনুষ্ঠানের মজা দেখতে।

‘মরলে শহীদ — জিতলে গাজি!’ দলের সবার সামনে তিতা মিঞার ভরাট গলার ডাক শোনা যায়।

বারোয়ারি তলার পথের ঠিক মুখোমুখিই বাজার। মহেশ ঘোষ তার খান কয়েক গরু এনেছিল বিক্রির জন্য। তিতা মিঞার ভাগ্নে গোলাম মাসুম নাঙা তলোয়ার হাতে ছুটে গেল সেদিকে। তার সাথে সাথে আরো ছুটে গেল মুসদীন মণ্ডল, আল্লাদি মণ্ডল, ন্যায়পাল মণ্ডল, ওজিল, থাণ্ডায়, তোরাবালি, মুলুক চাঁদ, খাওয়াজী, লঙ্গ প্রকাশ রাজিম, নতাওয়াত, ধানু। গোকুল চক্কোত্তি মহেশ ঘোষের হয়ে লড়তে এসেছিল। এতজন মানুষের সামনে বেচারির কিছুই করার থাকে না! উল্টো দায়েম ও কায়েম কারিগর বামুনের কাপড় খুলে ফেলে, ‘শোন চক্কোত্তি, বেশি বাড়াবাড়ি করলে কাল জাত পাল্টে দেব তোমার!’

প্রাণনাথ বাবুর নীলকুঠির স্মিথ সাহেব হাতির পিঠে চড়ে এদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাকে হাতি হতে নামিয়ে পেটানো হলো। বাজারের মুদি দোকানীদের হাত হতে জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হলো। তিতা মিঞা তলোয়ার মাথার উপর তুলে গরু জবাই করলেন। মন্দিরের পুরোহিত অবশ্য বেজায় সাহসী প্রকৃতির মানুষ। ভক্ত শূন্য হয়ে পড়তে থাকা মন্দির প্রাঙ্গনে একাই প্রকাণ্ড খড়গ তুলে ‘জয় মা কালী!’ বলে ধেয়ে আসেন পুরোহিত। পুরোহিতের খড়গের অব্যর্থ তিন/চারটা ধাক্কায় ছিটকে পড়লো বিচু কারিগর, আকিল মোহাম্মদ আর বাখতুরের মুণ্ডু। ততক্ষণে ওজিল, থাণ্ডায়, তোরাবালি আর গোলাম মাসুম চারদিক হতে ঘিরে ধরেছে পুরোহিতকে। পুরোহিতের মাথা ছিটকে পড়লো গোলাম মাসুমের তলোয়ারের এক কোপে। গরুটি চার খণ্ড করে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো মন্দিরের চার দেয়ালে আর তার রক্তও ছিটিয়ে দেওয়া হলো মন্দিরের মেঝেতে আর দেয়ালে।


… লাউঘাটিতে ছিলো নামে সাকের সর্দার।
মোমিন পৌঁছিল গিয়া পায় সমাচার।
গোরু জাব কোরে খানা তৈয়ার করিল।
আছুদা করিয়া খানা সবে খেলাইলো।
খানা খেয়ে মোমিনেরা আছুল বসিয়া।
হরিদেব দেবরায় খবর পাইয়া।।
তিন চারি শত লোক সঙ্গে লিয়া তারা।
লড়িতে আইলো গিধি করিয়া পৈতারা।।
… … …
জখোন থাকিলো তারা মার মার বলি।
মেঘের বেজলি জেনো কর্ণে লাগে তালি।।
এসে চারিদিকে ঘেরে মমিন সবারে।


৮.
ফৌজদারি নথি ৬৭
(১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর ফোর্ট উইলিয়ামস্থ বিচার বিভাগীয় উপ-সচিব মান্যবর আই, থমসনকে ১৮ বা ২৪ পরগণা ডিভিশনের সার্কিট কমিশনার ই. আর. বারওয়েল কর্তৃক লিখিত)।

মহোদয়,
আপনার আধা-সরকারি চিঠির (আগের দিনের তারিখ সম্বলিত) সূত্রে যথাবিহিত সম্মানপূর্বক লিখছি যে আমি বারাসতের যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চিঠি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে গোলযোগের স্থান পরিদর্শন করা হয়; এর পরই আজ সকালে আমি ব্যক্তিগত ভাবে ঐ স্থান পরিদর্শন করি। মি. স্টর্মের মফস্বল এজেন্টের পাঠানো রিপোর্ট ও মি. আলেকজান্ডারের পুলিশ বা কর্মকর্তার পাঠানো রিপোর্টের যথার্থতা যাচাই করার জন্য আমি তা করি। এটা দুঃখজনক যে মি. স্টর্মের এজেন্ট কর্তৃক প্রেরিত রিপোর্ট ও অন্যান্য রিপোর্টগুলো অনুযায়ী দেখা যায় যে এলাকায় আইনবিরোধী কার্যকলাপ বাড়ছে। অন্য রিপোর্টগুলো প্রেরণ করেছিল বশিরহাট ও কলিঙ্গ থানার দারোগা বা পুলিশ। এইগুলোতে দেখা যায় যে দুষ্কৃতিকারীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে এবং এরা মহম্মদীয় ধর্মের একটি সম্প্রদায় হিসাবে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে আমার মতে এদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল লুটতরাজ। এই দলটির নেতৃত্বে ছিল ‘তিতুমীর’ ও ‘গোলাম মাসুম’ নামের দুই ব্যক্তি। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি। অপর ব্যক্তি কতিপয় লোক দ্বারা বেদম প্রহারে আহত হয়ে বারাসত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল।

অফিসিয়েটিং ম্যাজিস্ট্রেট মি.আলেকজান্ডার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জন বরকন্দাজ, ৩ জন জমাদারকে বশিরহাট থানার শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু আমি দুষ্কৃতিকারীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সামরিক বাহিনী প্রেরণের চিন্তা করি। এই উদ্দেশ্যে সময়ের বিষয়টি চিন্তা করে কলিকাতা সিলিফিয়ার একটি ছোট দল বশির হাটে পাঠানোর চিন্তা করি। এই দলে ছিল জমাদার ও পঁচিশজন সিপাহী। এই দলটি প্রয়োজনে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। আমি বিশ্বাস করি যে ভাইস-প্রেসিডেন্ট-ইন-কাউন্সিল আমার পদক্ষেপ অনুমোদন করবেন।

আলীপুর আপনার অনুগত,
কমিশনার অফিস স্বাক্ষর/ ই.আর.বারওয়েল।
১৪ নভেম্বর, ১৮৩১। সার্কিট কমিশনার।

চিঠি লেখা শেষ করে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন বারওয়েল। গত এক সপ্তাহে ২৪ পরগণার বারাসাতের গ্রামগুলোয় কিছু ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে। ৬ই নভেম্বর এই তল্লাটের সবচেয়ে ডাকসাইটে জমিদার খোদ কৃষ্ণদেব রায়ের গ্রামে জমিদার স্থাপিত মন্দিরে ওয়াহাবি নেতা তিতুমীর ও তার দলের লোকেরা গোহত্যা করে মন্দিরের চার দিকে গরুর চার অংশ ঝুলিয়ে রেখেছে ও মন্দিরের দেয়াল ও মেঝেতে গোরক্ত নিক্ষেপ করেছে। বৃটিশ স্মিথকে তারা পিটিয়েছে। বাজারের দোকানীদের কাছ থেকে খাবার কেড়ে খেয়েছে। তিন মাস আগে তাদের মসজিদে আগুন ধরানো ও শূকরের মাংস ছড়ানোর ফলাফল এটি। এটুকু হলেও চলতো। পরের দিন সাতই নভেম্বরই পুঁড়া বাজার হতে খানিক দূরের লাউঘাটিতে তারা আবার তিনটি গরু জবাই করেছে এবং সাকের সর্দার নামে তিতুমীরের এক শিষ্য সেই গরুর মাংস রান্না করেছে। গোবরা-গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদার রতিকান্ত রায়ের ছেলে হরিদেব আর দেবনাথ রায় হিন্দু রায়তদের নিয়ে এসে গরু কোরবানির কাজে বাধা দেবার সময় দেবনাথ রায় মারা যায়। দেবনাথ রায়কে তিতুমীরের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে অবশ্য সাহস দিয়েছিল খাসপুর গ্রামের ইয়ার মোহাম্মদ আর তল্লাটের বড় নীলকর ডেভিস অ্যান্ড্রুজ। ডেভিস অ্যান্ড্রুজ প্রায় দুইশো লাঠিয়াল, সড়কিঅলা আর বন্দুকঅলা পাইক পাঠিয়েছিলেন। কোলকাতা থেকে জমিদার লাটু বাবু দেবনাথ রায়ের বন্ধু কালীপ্রসন্ন মুখার্জিকে পাঠিয়েছিলেন দুইশো হাবসি সৈন্য যাতে তিতা মিঞার দল হাবসিদের দেখেই ভয় মানে। কিসের কী? ডেভিস অ্যান্ড্রুজ, দেবনাথ রায়, কালীপ্রসন্ন কি ইয়ার মোহাম্মদ সবাই মিলে পারল না ক’জন চাষাভূষাকে হারাতে! তিতা মিঞারা প্রায় পাঁচশ লাঠিয়াল শুধু লাঠি আর তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করেই নাকি জিতে গেছে। বড় জটিল এই ভারতবর্ষের বিশেষতঃ বাংলার মানুষের রাজনীতি, ধর্ম আর ভূমিকে কেন্দ্র করে হানাহানির ব্যকরণ বোঝা। বারওয়েল বয়সে তরুণ। ছাত্রজীবনে দুরূহ মেধার স্বীকৃতি হিসেবে খুব অল্প বয়সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে আলীপুরের সার্কিট কমিশনার হয়ে এসেছেন। সপ্তাহ দুই কি তিন আগে বারাসতের প্রতাপশালী হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়িতে একটি নিমন্ত্রণে আমন্ত্রিত হয়ে প্রথম তিনি তিতুমীরের দল ও আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পান। বাংলার এক গ্রামীণ মধ্যবিত্ত তবে উচ্চবংশীয় সৈয়দ পরিবারের মুসলিম সন্তান তিতুমীর ইংরেজি না জানলেও বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষা নাকি লিখতে-পড়তে পারেন। প্রথম যৌবনে কৃষিকাজ করে শরীর শক্ত-পোক্ত হওয়ার পর এক হিন্দু জমিদারের লাঠিয়ালগিরির কাজ নিয়েছিলেন। সেই লাঠিয়ালগিরি করতে গিয়েই একবার এক মামলায় বেশ কয়েক বছর জেল খাটতে হয়। জেলখানা হতে বের হবার পর… অন্য লাঠিয়ালদের মতো আবারো পুরনো প্রভুর খাঁচায় ফিরে না গিয়ে… তার ভেতর আগুন ছিল নিশ্চিত… নিজেকে নিয়ে হয়তো তার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল… মক্কা চলে গেছিলেন হজ্ব করতে… সেখানে উত্তর ভারতের সৈয়দ আহম্মদ শহীদের ‘তরিকা-ই-মুহম্মদীয়া’ আন্দোলনের প্রভাবে এসে তিনি শরিয়তি ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে নিজ গ্রামে ফেরেন। ভারতের বিশেষতঃ বাংলা অঞ্চলের বিপুল মানুষ গত কয়েক শতকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম ও অস্পৃশ্যতাই মূলতঃ এই বঞ্চিত মানুষদের পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে বহু দূর আরবের ধর্মগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু, পিতৃপুরুষের ধর্মের সংস্কৃতিগত প্রচুর প্রভাব আজো এই অঞ্চলের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ফেলতে পারে নি। তুরস্ক ও পারস্যদেশ হতে প্রচুর সূফী সাধকেরা এসেছিলেন এই এলাকায় ইসলাম ধর্মপ্রচারের কাজে। সূফীবাদ ও এই অঞ্চলের অতীত হিন্দু ও বৌদ্ধ ঐতিহ্য মিলে মিশে এখানকার মুসলমানরা যে ধর্মটি পালন করে, তা মূল ইসলাম হতে যোজন যোজন দূরবর্তী। তিতুমীরের আন্দোলনটাও ঠিক এ জায়গাতেই। আজো এখানকার অন্ত্যজ শ্রেণীর হিন্দু হতে ধর্মান্তরিত মুসলিমরা নাকি হিন্দু নাম রাখে, হিন্দুদের মতো ধূতি ও শাড়ি পরে, বিবাহিতা মুসলিম রমণীগণ হিন্দু মেয়েদের মতোই শাঁখা-সিঁদুর পরে, হিন্দুদের মন্দিরে অর্ঘ্য বা বলি দেবার মতো এরাও পীরের নানা থানে বলি দেয়, মানত করে। তিতুমীর এখন এলাকার মুসলিমদের আরবি ফারসি নাম রাখতে বলছেন, ধূতিটা অন্যভাবে পরতে বলছেন, মেয়েদের শাঁখা-সিঁদুর খুলিয়ে নিয়ে বোরখা পরতে বলছেন, হিন্দু জমিদারদের প্রশ্ন করছেন কেন গোহত্যা নিষিদ্ধ হবে, কেন মুসলিমরা তাদের ধর্মে বৈধ খাবার খেতে পারবে না? গত কয়েক বছরে চাষী ও জেলে সম্প্রদায়ের প্রচুর হিন্দু উচ্চবর্ণের অত্যাচারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তিতুমীরের দলে যোগ দিয়েছে। অনেকে আবার ধর্ম না বদলেই তিতুমীরের সাথে আছে। সবচেয়ে যেটা ভয়ানক সেটা হলো উচ্চবিত্ত মুসলিমরা তিতুমীরের দলে নেই আবার নিম্নবিত্ত হিন্দুরা জমিদারদের সাথে নেই! তাহলে এটাকে ঠিক ধর্মীয় লড়াইও বলা যাবে না। আপাতঃ দৃষ্টিতে দেখলে ধর্মীয় লড়াই বলেই মনে হবে যদিও। এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষগুলোই… যাদের নিচুজাত করে রাখা হয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী… অসম্ভব বেদনা নিয়ে যারা পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করেছে… ইসলাম তাই না চাইতেও এখানে হয়ে উঠেছে শোষিতের ধর্ম আর হিন্দু ধর্ম মূলতঃ এখানে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের ধর্ম। ধনবান আর বিত্তহীনের লড়াইটা এই অঞ্চলে কীভাবে যেন সাম্প্রদায়িক একটা যুদ্ধের চেহারা নিচ্ছে! ইউরোপে যেমন ক্যাথলিক ধর্ম শেষের দিকে হয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্ষমতাশালী সামন্তপ্রভু, রাজা-রাজড়া আর পুরোহিতদের ধর্ম আর প্রটেস্ট্যান্টদের ধর্ম হয়ে উঠেছিল ভূমিদাস, কয়লা খনির শ্রমিক কি বাজারের ক্ষুদে ফেরিওয়ালার ধর্ম… এখানেও ঠিক তেমন একটা ব্যাপার চলছে!… আর বারওয়েল নিজে? ইংল্যান্ডের খুব কমোনার পরিবারের সন্তান তিনি। বাবার বাবা ছিল ভূমিদাস। বাবা কীভাবে কীভাবে খুদে দোকানদারির কাজ জুটিয়ে সংসারের চেহারা একটু স্বচ্ছলতর করেছেন। তার ছেলে হয়ে বারওয়েল পরীক্ষায় লর্ড ব্যারনদের সন্তানদের হারিয়েছেন। এই বাংলার না খাওয়া হাড্ডিসার কৃষক আর তাঁতীদের দুঃখ তাই কোথাও তাকে স্পর্শ করে। কিন্তু, জমিদাররাই এদেশে বৃটিশের বন্ধু। তাই, খুব ঠাণ্ডা মাথায় সরকারী সমস্ত কর্তব্য কর্ম আর নথিপত্রে তাকে জমিদার ও নীলকরদের পক্ষই নিতে হবে বৈকি। সেই সরকারী নথিপত্রের ভাষায় নিজের অন্তরের একটি শব্দও তিনি লিখবেন না। নীলকর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও জমিদারদের দৃষ্টিভঙ্গি হতেই তিনি ব্যবহার করবেন প্রতিটি শব্দ।

৯.
“রাজার বেটা মোহন লাল, সঙ্গে চলে ভেড়ার পাল’’

পৃথিবীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ এ সব কিছুর ভেতর হতেও শুধুমাত্র শিশুরাই আনন্দ তৈরি করে নিতে জানে। নয়তো তল্লাটের সব বয়ষ্ক নর-নারী যখন বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, তিতা মিঞার লোকজনের ভয়ে খোদ জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তল্লাট ছেড়ে ভেগেছে… শুধু উঁচু জাতের বামুন-কায়েত জমিদার নয়, তিতা মিঞার লোকজন গত পাঁচ/ছয়দিনে রুদ্রপুর ও মূলনাথ গ্রামের নীলকর ডেভিড অ্যান্ড্রুজ সাহেব, বারঘরিয়া আর হুগলির নীলকুঠির মালিক উইলয়াম স্টর্ম ও তার ম্যানেজার পাইরন সাহেবকেও কুঠি ছাড়া করেছে… সাহেবরা সব ভয়ে এদিক ওদিক দৌড় দিয়েছে… এরই ভেতর কি হিন্দু কি মুসলিম শুধু নাবালক শিশুরাই বাবা-মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে তিতা মিঞার লোকদের পিছু পিছু দৌড়ে চলেছে! ঐ তো তিতা মিঞার লোকজন বারঘরের নীল কুঠিতে গিয়ে গা ঢাকা দেওয়া কুঠিয়াল স্মিথ সাহেবের এক পাল ভেড়া নিয়ে ফিরছে আর বাচ্চারা পিছ পিছ হাত তালি দিয়ে ছুটছে ঠাকুরদাদার থলে হতে ছড়া আওড়াতে আওড়াতে, ‘রাজার বেটা মোহন লাল, সঙ্গে চলে ভেড়ার পাল!’ বারঘরের নীল কুঠিতে হঠাৎই বাতাস এসেছে আর বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তিতা মিঞার লোকজনের ভেঙে ফেলা নীলের বাক্স হতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া নীল।

‘আমি নীল মাখপো!’

‘না-না — আমি-আমি!’

বাচ্চারা গায়ে নীল মেখে হুটোপুটি করে যেন ফিরে চৈত্র মাসের দোল উৎসব এসেছে।

‘এ খোকা-খুকিরা তো ভারি যন্ত্রণা করে!’ তিতা মিঞার দলের শরাঅলারা একটু ধমক দিলেও শিশুদের তারা তেমন কিছু বলে না।

‘ইয়ার মোহাম্মদ বাসায় আছো?’

খাসপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত ইয়ার মোহাম্মদ, তারা বিশুদ্ধ চুঘতাই তুর্কি বংশোদ্ভূত, আজো সবার গায়ের রং ধবধবে ফর্সা ও চোখের মণি প্রায় নীল, কোনো এক জেদের বশেই পালান নি! সত্যিকারের মুসলমান তো এ এলাকার একজনও না! খেতে না পেরে কি উঁচু জাতের সাথে টিঁকতে না পেরে এরা মুসলমান হয়েছে। এদের সাথে খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা করা যায় নাকি? বরং জাতের হিন্দু পেলে মেলা-মেশা করা যায়। ভাল ইয়ার মোহাম্মদদের পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিয়েও হয় দূরে দূরে। এলাহাবাদ, লক্ষৌ, কাশ্মীর কি নিদেনপক্ষে বিহারের কমে তাদের বিয়ে হয় না। অনেক সময় বর্ণহিন্দুদের মতোই খান্দান মিলাতে না পারলে পরিবারের কন্যারা জীবন ভর অবিবাহিত থেকে যায় তবু খান্দানহীন বিয়ে এ বাড়ির মেয়েদের হয় না। একটা কথা অনেকেই জানে না। হানাফি সুন্নী বিয়ের আইনে বিয়ের যে আটটি শর্তের কথা বলা হয়েছে তার ভেতর ধর্মের মিলের আগেও বলা হয়েছে বংশের মিলের কথা। দ্বিতীয় শর্তে ধর্মের কথা বা একই ধর্মাবলম্বী হবার কথা বলা হয়েছে। এম্নিতে কোরাণের আয়াত যদিও আছে যে অবিশ্বাসী (অমুসলিম) রাজপুত্র বা রাজকন্যার চেয়ে বিশ্বাসী (মুসলিম) ক্রিতদাস বা ক্রিতদাসী বিয়ে করা ভালো, কিন্তু ফিকাহ শাস্ত্রের বড় এলেমরা একটি বৈধ সুন্নী ও হানাফি মজহাবের বিয়েতে ভুলে কিম্বা অভুলে হোক, ধর্মের ঐক্যের আগেও বংশের ঐক্যের কথা বলেছেন। খান্দান কি যে সে জিনিস? ইয়ার মোহাম্মদের এক অপরূপা সুন্দরী বোন আজীবন বিয়ে না হয়েই কিছুদিন আগে মরেছে। তার দুই কন্যার বড়টি বিধবা ও ছোটটিও অবিশ্বাস্য সুন্দরী তবে অবিবাহিতা। পরিবারে স্ত্রী-কন্যা সবাই উর্দু ও ফার্সি ভাষী। ইয়ার মোহাম্মদ সহ পরিবারের অল্প কয়েকজন হাতে গোনা পুরুষ সদস্য যাদের কিনা হাটে-বাজারে, কোর্টে-কাচারিতে প্রায়ই দৌড়াতে হয় তারাই শুধু বাংলাটা সড়গড় বলতে ও পড়তে পারেন। তিন পুরুষ আগে দিল্লী হতে ইয়ার মোহাম্মদের অমাত্য পূর্বপুরুষ কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে প্রাণ হাতে পালিয়ে এতদূর এসেছিলেন। সাথে সামান্য যা সম্পদ আনতে পেরেছিলেন সেই সম্পদ ও উচ্চ বংশীয় মেধা ও চাতুর্যের জোরে এই বাংলাতেও অগাধ সম্পদ ক্রয় করতে তাদের দেরি হয় নি। পরিবারে মেয়ে কি মা-দাদিমারাও আজো সালোয়ার-কামিজ পরে। হিন্দুদের দেখাদেখি বাঙালী মুসলমান মেয়েরাও শাড়ি পরে দেখে তাদের ভারি আশ্চর্য লাগে। এজন্যই তারা এখানকার মুসলমানদের মুসলমান মনে করেন না। ইয়ার মোহাম্মদ স্থির গাম্ভীর্যে নিজের হাতেই ফটক খুললেন।

‘কী চাও তোমরা?’

‘আপনার দুই সুন্দরী কইন্যে আচে না? একটি বেধবা আর একটি মেয়েকে খান্দানের নামে আবিয়াতো রেকেচেন! ওদের শরিয়ত মোতাবেক সাদি দিতে চাই মোদের দলের কালু আর মহিবুল্লাহর সাতে। ওদের বয়স প্রায় তিরিশ, একুনো সাদি হয় নি তাই!’

‘বেত্তমিজ! বাহার যাও! আভি নিকালো!’ ইয়ার মোহাম্মদ হিতাহিত জ্ঞান হারান।

‘তুমি চুপ করো কৃষ্ণদেবের দালাল কোতাকার! নীলকরের দালাল!’ গোলাম মাসুম তার কাদা-মাটিতে ধান চাষ করা হাতে ঠাস করে একটা চড় কষালো চুঘতাই তুর্কি ইয়ার মোহাম্মদের গালে।

এর পরের ঘটনাগুলো খুবই সংক্ষিপ্ত। মুসদীন মণ্ডল, আল্লাদি মণ্ডল, ন্যায়পাল মণ্ডল, ওজিল, থাণ্ডায়, তোরাবালি, মুলুক চাঁদ, খাওয়াজী, লঙ্গ প্রকাশ রাজিম, নতাওয়াত, ধানু, রাহমত, বাদাল, পাচু, সৈয়দ নিসরা কলি সবাই মিলে শক্তভাবে ইয়ার মোহাম্মদ আর বাড়ির অন্য পুরুষদের হাত পা বেঁধে বাড়ির ভেতর থেকে টেনে আনলেন দুই কন্যা বিধবা মাহতাব আর কুমারী খুরমাকে। ফকির কোরবান শাহ তিতা মিঞার দলে তো আগে থেকেই ছিলেন। তিনিই বিয়ে পড়ানোর তোড়জোর করলেন। অপরূপ সুন্দরী মেয়ে দুটো ভয়ানক কান্নাকাটি আর চিৎকার করছিল।

‘মুজকো ছোড় দো তুমলোগ! তুম ডাকু ঔর বুরা আদমি হো!’

অমন নীলাভ চোখের প্রায় শ্বেতাঙ্গিনী দুই তরুণীর পক্ষে গাট্টাগোট্টা, বেঁটে ও কালো আর হতকুচ্ছিত কালু আর মহিবুল্লার সাথে বিয়ের কথা ভাবাও ভয়ঙ্কর ব্যাপার বৈকি। ফকির কোরবান শাহ ওদিকে তার মতো বিয়ে পড়িয়ে চলেন, ‘চব্বিশ পরগণার বারাসাতের শরিফপুর মৌজার খাসপুর গ্রামের ইয়ার মোহাম্মদের কন্যা মোসাম্মাৎ খুরমা, আপনি কি কালু মণ্ডল, পিতা- মাদার মণ্ডল, গ্রাম- সরফরাজপুর, মহকুমা- বারাসাত, জেলা- চব্বিশ পরগণাকে পাঁচ টাকা দেনমোহরে নিকাহ করিতে কবুল?’

‘ইয়া আল্লাহ্!’ দুই তরুণীই মূর্চ্ছা যায়। তাদের খান্দানে লাখ টাকা দেনমোহরের কমে কখনো কারো নিকাহ হবার কথা তারা শোনেই নি!

১০.

‘এলাহি ভাবিয়া বাঁশের বানাইল কেল্লা।
ঘাস বাশ দিয়া তবে বানাইল ছেল্লা।।
তাহার ভিতরে জমা সকলে রহিলো।
বেদিন দেখিয়া মোনে সঙ্কট জানিলো।।’’


তল্লাটের একটি গ্রামের বাঁশঝাড়ে আর কোনো বাঁশ নেই কো! তিতা মিঞার লোকজন পুঁড়া আর লাউঘাটিতে জঙ্গ জেতার পর গত ক’দিন বাঁশ কেটে কেটে নারকেলবাড়িয়ায় এক এ্যায়সা বাঁশের কেল্লা বানিয়েছে। এই বাঁশের কেল্লার ভেতর ছোট ছোট অগুনতি ঘর। কোনো ঘরে তলোয়ার, বর্শা, সড়কি, বাঁশের ছোটবড় লাঠি আবার কোনো ঘরে কাঁচা বেল আর ইটের স্তূপ। কেল্লা বানানো শেষ হবার পর তিতা মিঞা তার সাকরেদদের নিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। নামাজ আদায় শেষে তিতা মিঞা দুই হাত তুলে বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদার রসুলুল্লাহ! ভাইয়েরা আমার! আমরা গরীব মানুষ। চাষী-গেরস্থ-জোলা-নিকিরি! ইংরাজের মতো ফোর্টুলিয়ম (ফোর্ট উইলিয়াম) আমাদের নেই কো! আমাদের গরীবের আচে শুদু এই বাঁশের কেল্লা। কিন্তু, আল্লাহ ও পয়গম্বর চাহেন তো এই বাঁশের কেল্লাই হারিয়ে দেবে ইংরাজের কেল্লা ফোর্টুলিয়মকে! কন দিকি সবাই, লাঙ্গল যার…’

‘জমি তার!’

*

আসলে দুনিয়াটা যেন এতদিনে সত্যি সত্যিই দু’ভাগ হয়ে যেতে চাইছে। এমনি প্রবল এক জঙ্গ চারদিকে। এমন জঙ্গ এতদিন শুধু পুঁথি-কিতাবেই শোনা গেছে। কারবালার জঙ্গ বা হিঁদুদের রামায়ণ-মহাভারতের যুদ্ধ। কে জিতবে? তিতা মিঞাই তো জিতছে। গেল আশ্বিনের শেষ সপ্তাহ ধরে তিতা মিঞা নাকি তার দলের সব লোকজনকে নিয়ে ‘মৌত কা খানা’ খেয়েছে। মৃত্যুর খাওয়া। এই খাওয়ার পর যে জঙ্গ, সে জঙ্গে তারা জিততেও পারে আবার হারতেও পারে। তা জিতছে বৈকি তিতা মিঞা। জিতেছে পুঁড়া গ্রামের মন্দির দখলের যুদ্ধে। তার পরদিন লাউঘাটির যুদ্ধেও তারা জিতেছে। গতকাল সাত সকালে খান্দানি ইয়ার মোহাম্মদের বাড়ির দুই মেয়েকে তিতা মিঞার সঙ্গীরা বিয়ে করেছে। উঁচু জাত হিন্দুর জমিদারের মন্দির, আশরাফ মুসলমানের মেয়ে কি গোরা নীলকরের নীল কুঠির বস্তা বস্তা নীল… সব কিছুই তিতা মিঞার লোকজন তছনছ করে দিচ্ছে! তিতা মিঞার দল এখন জমিদার কৃষ্ণদেবের আত্মীয় দারোগা রামরাম চক্রবর্ত্তীকে খুঁজছে যে কিনা সরফরাজপুরের শণের মসজিদ পোড়ানোর পর উল্টো মুসলমানদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। চাষীদের কাছ থেকে ফসলের একটা অংশ খাজনা নিচ্ছে তিতা মিঞা। কিম্বা, বলা ভালো চাষীরা নিজে থেকেই তাকে খাজনা দিচ্ছে। পৃথিবীতে তরিকা-ই-মহম্মদীয়া বা মহম্মদের তরিকা প্রতিষ্ঠা হতে খুব বেশি দেরি নেই যখন জমিনে চাষীরাই বাদশাহি করবে। আর আজ নাকি খোদ ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার সাহেব আসছেন নারকেলবাড়িয়াতে। গতকালই নারকেলবাড়িয়া আসার পথে বাউগণ্ডিতে যশোর লবণ আড়তে দাঁড়িয়ে থাকা ১৮ জন সেপাই আর বশিরহাট হতে তিন জন জমাদার আর ৩০ জন বরকন্দাজ আলেকজান্ডার সাহেবের সাথে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু, কই? আলেকজান্ডার তো তিতা মিঞার সামনে এসে মেনি বিড়ালটা হয়ে গেল। নারকেলবাড়িয়ার মাঠে তিতা মিঞারা জনা পাঁচশ মুনিষ্যি সেই অস্ত্র বলতে যা লাঠি, তরবারি আর বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল। আলেকজান্ডার প্রথমে ভাবলো কী যে হোক তার দলে সব মিলিয়ে জনা পঞ্চাশ মাত্র সেপাই, তাদের সবার আছে বন্দুক। আর, এদের হাতে লাঠি-সড়কি ছাড়া কিছুই নেই। তাই একটু ভাব নিলেন। বললেন বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ করতে। ফাঁকা আওয়াজে তিতা মিঞার সিপাহি-লস্করদের আণ্ডাটা হোল! উল্টো তারা লাঠি বাজিয়ে সিপাইদের কইলো জঙ্গে নামতে। এবার সিপাইরা বন্দুকে গুলি ভরতে যেই না গেল, তার আগেই লাঠি সোটা নিয়ে পাঁচশ শরাওয়ালা পঞ্চাশ জন সিপাইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দশ জনা সেপাই, তিন জনা বরকন্দাজ আর এক জনা জমাদার সাথে সাথে নিকেশ হয়ে গেল! একজন হাবিলদার জখম হোল কি যেন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো! দারোগা রামরাম চক্রবর্ত্তীকে বাঁশের কেল্লায় নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। এভাবেই তিতা মিঞা এক/একটা জঙ্গে জেতে আর সাজন গাজির গানের খাতা ভারি হতে থাকে,

পয়ারে লিখেছে তায়কেষ্টদেবের আব্র“ জায়
পুড়োর বাজার সব লেচ্ছে লুটে।
কাধে সব গরাণের কোড়াদৌড়ায় যেন থানের ঘোড়া
কায়েত বাওন সব পালাল ছুটে।।

কালীবাবু আবজেরেআলিজিন্দা২ সাহেবেরে
হাজার টাকা নজর গিয়ে দিল।
…বারাসাতের মেজেস্টে৩হুকুম দেছে পলটানে
প্রোছে টোটাতে বারুদ।
পায়জামা পিন্দিল তায়লাল কুর্ত্তি টোপ মাথায়
খাড়া হইল যন যোমের দূত।।

আক্কেল মোল্লা দেউলে ছিলনারকেলবেড়ে খবর দিল
হজরতের কচ্চেন সোমাচার।
পলটান আসিতেছে তাতেআলিজিন্দা সাহেব সাতে
কালীবাবু রসদ দিচ্ছে তার।।
হজরত হুকুম করেছোট বড় সাহেব তরে
পলটান আর আসতেছে জমিদার।
দিনের লড়াই করবাচ কিংবা মর
আমরা সবে কি করেছি তার।।

তিন লড়াই হল জিতসরাঅওলা আনন্দিত
নারিকেলবেড়ে হইল কারবালা।
বেদেপোতায় প’ল রোতলহুতে পড়িল সোত
তামাসা দেখিল খোদাতলা।।

১১.
ফৌজদারি নথি ৮৪
বনগাঁওয়ের ৭/৮ মাইল উত্তরে অবস্থিত মোলনাথ ফ্যাক্টরি থেকে নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ই, পি. স্মিথ এর লিখিত চিঠি। ১৭ নভেম্বর, ১৮৩১।

মহোদয়,

যথাবিহীত সম্মানের সাথে জানাচ্ছি যে মি. ডেভিড এণ্ড্রুজ ও তাঁর দল আমার সাথে হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে এই স্থানে পৌঁছেছি। বারগুরিয়া থেকে অলৌকিকভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে আমরা এসেছি। দুষ্কৃতিকারী গণ বারগুরিয়া ফ্যাক্টরি তছনচ করে। এছাড়া মি. এণ্ড্রুজ-এর একটি হাতি, আসবাবপত্র, তৈজসপত্রসহ একটি পানসি নৌকা, কিছু নগদ টাকা, ২টি বজরা, ১টি বাবুর্চীদের নৌকা, ডিঙ্গি, আমার পাল্কী এবং আমার অধিকাংশ আমলা পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে।

আজ সকালে যখন আমরা পান্সি ত্যাগ করি তখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী নয় এবং যথেষ্ট অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত নয়। কিন্তুউ, আমাদের এই তথ্য ছিল ভ্রমাত্মক। আমরা হাতিতে চড়ে ১২ থেকে ১৪ জন ডবল ব্যারেল বন্দুকধারী নিয়ে রওয়ানা হই। আমরা প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জন লোক দলে টানতে পেরেছিলাম। এরপর আমরা নারকেলবাড়িয়ার দিকে ফ্যাক্টরি থেকে দেড় মাইল পর্যন্ত অগ্রসর হই। কিন্তু আমরা প্রতিপক্ষের শক্তি অনেক বেশি বলে ধারণা করি। এরা আক্রমণের জন্য বেশ সংঘবদ্ধ মনে হয়। আমাদের শক্তি যথেষ্ট নয় মনে হওয়ায় আমরা যখন ফিরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করি, তখন বিদ্রোহীরা অত্যন্ত দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। এরা আমাদের দুইজন অনুসারীকে হত্যা করে কারণ এরা দৌড়াতে পারে নি। আমরা পানসিতে চড়ার সাথে সাথেই এরা তীরে লাইনবন্দি হয়ে আমাদের হত্যা করার চেষ্টা করতে থাকে। আমরা পানসি থেকে গুলি ছুঁড়লেও আশ্চর্যজনকভাবে এদের কোন ক্ষতি হয় নি। মাথা নিচু করে এরা গুলি এড়িয়ে নর্তন কুর্দন করতে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে মি. এণ্ড্রুজ জনগণকে গুলিবিদ্ধ করেন। তাঁর পোশাকের ধরন দেখে মনে হয় যে একজন সর্দার। এছাড়াও কয়েকজন গুলিতে আহত হয়। আমাদের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে। বিদ্রোহীরা নৌকাযোগে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। আমরা অপর তীরে নেমে দৌড়াতে থাকি। সৌভাগ্যবশত আমাদের হাতিগুলি পেয়ে যাই। এতে করে আমরা নিশ্চিত কচুকাটা হওয়া থেকে পরিত্রাণ পাই। পালিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের ফৌজদারি নাজিরকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয়। আমি এখনো আমাদের পথের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারি নি।

আমি ঘটনার সময় প্রত্যক্ষ করি যে বিদ্রোহী দলে কমপক্ষে ১০০০ থেকে ১৫০০ জন লোক রয়েছে। এরা সকলেই আশেপাশের গ্রামের সাথে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। আমি দ্বিধা না করে সরকারের কাছে আবেদন করছি যে এখনই যেন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিদ্রোহীদের ইছামতি নদীর সীমানার মধ্যেই প্রতিরোধ করা হয়। মি. এণ্ড্রুজের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিদ্রোহীরা বিশেষভাবে সক্রিয়। এই জেলার সম্পদ ও লোকজনের নিরাপত্তার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার যাতে এরা সদর স্টেশনের দিকে এগোতে না পারে।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ব্যারাকপুরের কমাণ্ডিং অফিসারের কাছে সরাসরি রিক্যুইজিশন পাঠাই একদল শক্তিশালী সৈন্য পাঠানোর জন্য। এই স্থানের ৭/৮ মাইল দক্ষিণে বনগাঁওয়ের দিকে যশোরের রাস্তায় সাথে সাথেই অগ্রসর হওয়ার জন্য আবেদন করি। বনগাঁও হল ইছামতি নদীর তীরে। কলিকাতা থেকে দেরীতে আসা একজন ফ্যাক্টরি কর্মীর কাছ থেকে এখনই জানতে পারলাম যে একজন কমিশনারের সাথে একটি সামরিক বাহিনীর দল কলিকাতা বা দমদম থেকে আসছে। এই দলটির প্রয়োজনীয়তা এখনই সবচেয়ে বেশি। এই দলটি উভয় দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়তা এখনই সবচেয়ে বেশি। কারণ ইতিমধ্যেই বিদ্রোহীরা দুইবার বেসামরিক শক্তিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। তাছাড়া বিদ্রোহীরা মি. এণ্ড্রুজের নৌকা দখল করে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে আছে।

বেসামরিক শক্তি সম্পূর্ণভাবে বিশৃংখল হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় আশেপাশের কোনো দারোগাই তাদের কর্মস্থলে নেই। এখন এই আতঙ্ক এলাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে লুট ও দুষ্কৃতিকারীদের জন্য পুরো এলাকাটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।

আমি আগামীকাল কৃষ্ণনগর পৌঁছার চিন্তা করছি। এই স্থান থেকেই আমি আমার দলের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারব। মি. এণ্ড্রুজ তাঁর সুবিধা অনুযায়ী যত শীঘ্র সম্ভব কলিকাতা যাওয়ার বিষয়ে ভাবছেন। কলিকাতায় তিনি ভাইস-প্রেসিডেন্ট-ইন কাউন্সিলের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবৃতি দেবেন। মি. এণ্ড্রুজ, মাদারল্যান্ড, ফ্যাকেন্ডি, গার্ডেন এবং হল সাথে সাথে যে সাহায্য করেছেন তাঁর জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং মি. এণ্ড্রুজের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাঁর জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।

আপনার বিশ্বাস ভাজন
স্বাক্ষর/ ই.পি.স্মিথ
ম্যাজিস্ট্রেট।

১২.
ফৌজদারি নথি ৬৯
(ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন-কাউন্সিলের কার্যবিবরণীর অংশবিশেষ। সামরিক বিভাগ, ১৬ নভেম্বর, ১৮৩১ নম্বর ২৩৯)।

সমীপে
ডেপুটি এডজুট্যান্ট জেনারেল, সামরিক বাহিনী,
সামরিক বিভাগ

মহোদয়,

সরকারের নিকট এই মর্মে নির্ভরযোগ্য সংবাদ এসেছে যে বারাসত ম্যাজিস্ট্রেসির অঞ্চলে একদল গোঁড়া ধর্মান্ধ জনসাধারণের উপর অত্যাচার করছে। স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন এদের দমন করার জন্য যে বাহিনী প্রেরণ করেছিল তা উক্ত বিদ্রোহীরা প্রতিরোধ করেছে। আমি ভাইস-প্রেসিডেন্ট-ইন-কাউন্সিলের নির্দেশে আপনাকে অনুরোধ করছি যে আপনি যাতে প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের জি ও সিকে সরকারের নির্দেশ জানিয়ে দেন। যাতে এই নির্দেশ হলে তিনি ব্যারাকপুর থেকে এক ব্যাটালিয়ন স্থানীয় পদাতিক সৈন্য, দুটি ৬ পাউণ্ডী কামান, দমদম থেকে প্রয়োজনীয় গোলন্দাজসহ একজন ফিল্ড অফিসারকে বারাসতে পাঠাতে পারেন। অনারেবল ভাইস প্রেসিডেন্টের এসকর্ট থেকে হাল্কা ঘোড়সোয়ার বাহিনীর ১২ জন সৈন্য এবং একজন হাবিলদার এদের সাথে যোগ দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

২. অফিসার কমান্ডিং এর সাথে ম্যাজিস্ট্রেট মিলিত হবেন। বারাসতে তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে এদেরকে তত্ত্বাবধান করবেন। দুষ্কৃতিকারীদের পরাজিত করে এবং প্রতিরোধ ধ্বংস করে জনগণের মাঝে শান্তিশৃংখলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কমান্ডিং অফিসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

৩. শেষে বলা হচ্ছে যে, প্রয়োজনে অধিক গোলাবারুদ ও কামান সরবরাহে পরিবহনের ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়া অধিক সাহায্য পাঠানো হবে।

৪. সৈন্যদলের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সব ধরনের সহায়তা ও রসদ সরবরাহ পরিচালনা করবেন।

১৬ নভেম্বর, ১৮৩১

আপনার বিশ্বস্ত
স্বাক্ষর/ ডব্লিউ কেইস মেল্ট কোল
সচিব/ সামরিক বিভাগ।

১৩.
একথা এখন মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে তিতা মিঞাকে হারানো গোরা সৈন্যেরও কম্মো না। তার দলের মিস্কিন শাহ ফকির নাকি কামানের গোলা মুখে মুখে গিলে খেয়ে ফেলতে পারে। এজন্যই কোম্পানীর সৈন্য আর গোরা নীলকররা এই নিয়ে তিনটা রণ… তিনটা জঙ্গে তিতা মিঞার দলবলের কাছে হেরে গেছে! বাপ রে, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দ্দি খাঁর নাতি সিরাজউদ্দৌলা যে গোরাদের সাথে ঘোড়া আর কামান নিয়ে লড়াই করেও হেরে গেছে, সেই গোরারা কিনা তিতা মিঞার দলের লাঠি-সড়কির সাথে কামান-বন্দুক নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চাষী আর তাঁতীদের বাদশাহী নদীয়া, বারাসত আর চব্বিশ পরগণায় প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। এই বাদশাহীর বাদশা তিতা মিঞা আর উজীর হলেন রুদ্রপুরের জোলা মইজুদ্দীন ও জমাদার হলো বাকের মণ্ডল। গরিব রায়তরা কেউ আর পাঁচ গাঁয়ের কোনো জমিদারকেই খাজনা দিচ্ছে না। হিঁদু জমিদারদের ভেতর মনোহর রায় একটু অন্য রকমের মানুষ। তিনি নীল চাষ করেন না। কাউকে দিয়ে নীল চাষ করানো পছন্দও করেন না। তিনি নিজে স্বয়ং তিতা মিঞার দলে যোগ দিয়েছেন। বৃটিশের উপর তেনার ম্যালা রাগ। রানাঘাটের পালচৌধুরী, ম্যাজিস্ট্রেট, জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় আর প্রাণনাথ চৌধুরীকে পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে, ‘দীন মহম্মদ বলে নতুন ধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে, কোম্পানির শাসন শেষ, তিতা মিঞার লোকেরাই মালগুজারি নেবে। রাজ্য এখন দীন মহম্মদদের। সময় মত রসদ দিলে তোমাদের শিরোপা দেওয়া হবে আর তিন মাসের খাজনা মকুব। তা না হলে তোমার কাছে ফৌজ গিয়ে লড়াই করবে।’ এই তো গত পরশু মাজেস্টে (ম্যাজিস্ট্রেট) স্মিথ সাহেব বনগাঁও হতে সাত/আট ক্রোশ উত্তরে মোলনাথ নীলকুঠি থেকে দেড় মাইল দূরে নারকেলবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে নদীতে পানসি চড়ে যখন রওনা করেন, তিতা মিঞার দল ইছামতী নদীর পার হতেই তাদের ধাওয়া করলো। স্মিথ সায়েবের সঙ্গের দু’শো/তিনশো মানুষের কাছে ছিল প্রায় খান চোদ্দ দোনলা বন্দুক। স্মিথ সাহেব, নীলকর ডেভিস অ্যান্ড্রুজ আর আরো দু’জন সাহেব ছাড়া বাকি সাহেব আর কিছু হিন্দুস্থানী সেপাই হাতির পিঠে আর পায়ে হাঁটা দিয়ে নারকেলবাড়িয়ার দিকে আসছিলো তিতা মিঞার দলকে ঠ্যাঙাতে! হায় কে কাকে ঠেঙ্গায়? উল্টো স্মিথ সায়েব আর তার সাথের ডেভিস অ্যান্ড্রুজ সায়েব নৌকা হতে তীরে দাঁড়ানো তিতা মিঞার লোকদের দিকে গুলি ছুঁড়লেও তারা মাথা নিচু করে লাফ দেয় আর গুলি সব ফস্কায়। আসলে তো ফকির মিস্কিন শাহ তার কেরামতি দিয়ে সব গুলি খেয়ে ফেলেন। রাণী ভিক্টোরিয়ার গুলি। এরপরে কিনা তিতা মিঞার লোকজন তীর হতে থান থান ইট আর কাঁচা বেল নৌকায় চড়া সাহেবদের উদ্দেশ্যে এমন ভাবে ছুঁড়তে লাগলো যে সাহেবরা যে যেভাবে পারে প্রাণে পালিয়ে বাঁচলো। সাহেবদের হাতি, পানসি নৌকা, সেপাইদের ফেলানো অস্ত্র-শস্ত্র সব তিতা মিঞার মুনিষ্যিদের হস্তগত হলো।

‘সাহেবের বাচা ভার, বে একতার কল্লে কাজে কাজে।
… … …
জানে বাচ যদি, সাহেব পালাও হাতি চোড়ে।।’

গর্ভনর জেনারেল স্বয়ং অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। পরপর দু’বার বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট এসে ক’জন গ্রাম্য লাঠি-সড়কিঅলার কাছে মার খেয়ে ফিরে যাবে, এর থেকে অসম্ভব অবাক করা আর কিছু হতে পারে না! ১৬ নভেম্বরই বারাসতে একটি ফিল্ড ব্যাটালিয়ন জমায়েত হয়েছে। মেজর স্কট হার্ডিং নেতৃত্ব দিচ্ছেন একাদশ স্থানীয় পদাতিক সৈন্যদলকে। ক্যাপ্টেন মাদারল্যান্ড অশ্বারোহী রক্ষী দল ও লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড গোলন্দাজ বাহিনীর দায়িত্বে। ১৮ নভেম্বর শুক্রবার রাতেই মি. আলেকজান্ডার ক্যাপ্টেন মাদারল্যান্ডের দেহরক্ষী দল ও একটি ক্যাভালরি বা অশ্বারোহী দল বাঁশের কেল্লার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই অশ্বারোহী দল রাতভর ভারি ভারি কামান বাঁশের কেল্লার কাছে টেনে নিয়ে গেছে। শনিবার সকাল নাগাদ বৃটিশ পদাতিক বাহিনীও পৌঁছে গেছে। মেজর স্কট হার্ডিং আর ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার বাঁশের কেল্লার সামনে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছেন। মেজর স্কট পকেট হতে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের করে জোরে পাঠ করলেন, ‘মহাশয়, ভারতবাসীর মহামান্য গভর্নর-জেনারেল আপনাকে সদলবলে গ্রেপ্তার করিবার জন্য পরোয়ানা দিয়াছেন। আপনি স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হইবেন কিনা জানিতে চাই!’

উত্তর এল না। মেজর হার্ডিং পতাকা নাড়লেন, ‘ফায়ার!’

…বাঁশের কেল্লার ভেতর হতে ততক্ষণে বৃষ্টিধারার মতো ইট, বেল ও তীর ছুঁড়ে আসছে। প্রশিক্ষিত সৈন্যদের রীতিমতো ভয় লাগছে।

মেজর হার্ডিং কর্কশ কণ্ঠে হেঁকে ওঠেন, ‘নো মার্সি সোলজারস্! নো পিটি, নো কন্সিডারেশন! ডেস্ট্রয় দিজ ডার্টি রায়তস!’ পকেট হতে রুমাল বের করে শ্বেত কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নেন তিনি। উফ, কী ভয়ানক নোংরা এই বাংলার চাষীরা! গত দুটো যুদ্ধে কোম্পানীর সৈন্যরা পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারার ভয়ে দয়া করতে যেয়েই ফাঁদে পড়েছে। এদের সাথে আর কোনো বিবেচনা নয়। আর দয়া-মায়া-ক্ষমা নয়। রক্তে ভেসে যাক, ভিজে উঠুক এ এলাকার মাটি। বৃটিশের পতাকা কিছুতেই নমিত হতে দেওয়া চলবে না।

দুম দুম শব্দ করে বিষ্ফোরিত হয়ে উঠলো কামান!

…তখন তিতা মিঞা… তিনি তাঁর বাঁশের কেল্লায় ধ্যানস্থ… তিনি কহিলেন, ‘তা চাষারা জমি চষপা না ক্যানো? কিন্তু, ফসল কি গোলায় নিতি পারো মিঞারা? নেয় তো জমিদার আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী!’ তিতা মিঞার চোখে ইছামতীর জল ছলছল করে। তিতা মিঞার চোখে খরার সূর্যেও আগুন ধবধব করে। আর, তখন বাঁশের কেল্লার ভেতরে সাজন গাজি আর তার দলের যত যুবক ছেলে… ধরো গে শাহগাজী চাষার ছেলে নূররাপ, সাতখানের ছেলে বাদল কারিগর, কালুর ছেলে কাইম, দিনাতের ছেলে নাকারি, হানিফের ছেলে মূলুক চাঁদ, বালতোরের ছেলে সাফি কারিগর, সাধুর ছেলে বায়োপার, কুশাইয়ের ছেলে রাফি, বরকতউল্লাহর ছেলে মাংলাই… সবার চোখেই জল ছলছল করে। সবার চোখেই আগুন ধবধব করে।

‘আজ এই নদে (নদীয়া), কুষ্টে (কুষ্টিয়া), সাতক্ষীরা, যশোর, চব্বিশ পরগণা, খুলনে (খুলনা) কি বারাসতের গাঁও কে গাঁও শুদু অভাব। যমুনা হতি ইছামতীর চরে চরে চাষার জমিতে চাষার ফসলে সবার হক আছে। শুদু চাষার কুনো হক নাই। অথচ, জমি কার?’

‘উপরে আল্লাহর আর নিচিতে চাষার!’

‘লাঙ্গল যার জমি তার! নীলির চাষ চলবি না — চিরস্থায়ী বাতিল করো — লাঙ্গল যার জমি তার! আজ যদি আমরা মারাও যাই কুনো ভয় নাই! মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি!’

শোন ছেপাই করি মানাজঙ্গেতে দিওনা হানা
জান মান করিয়ে সমার্পণ।

ভাই বন্ধু মেয়ে ছেলেসব মোরা এসেছি ফেলে
ঠিক করেছি কেবলই মরণ।।

ষোল টাকায় চাকরি করেএসেছ সব বন্দুক ধরে
খোয়ালি সব আখের আকরাত।

মেছের আলি ফকির ভারিদিন এছলাম করে জারি
তারে মারিবে কাফের কোন জাত।।

১৪.

ফৌজদারি নথি ৭৭

সমীপে

মান্যবর আই. থমসন
ডেপুটি সেক্রেটারি,
বিচার বিভাগ
ফোর্ট উইলিয়াম।
২০ নভেম্বর, ১৮৩১।

মহোদয়,
যথাবিহিত সম্মানের সাথে জানাচ্ছি যে আজ সকাল সাতটার সময় আমি বারাসতের অফিসিয়েটিং ডব্লিউ. এস. আলেকজান্ডারের একটি চিঠি পেয়েছি। উক্ত চিঠির একটি অনুলিপি ভাইস-প্রেসিডেন্ট-ইন-কাউন্সিলকে অবহিত করার জন্য প্রেরিত হল। এই চিঠিতে নারকেলবাড়িয়ার প্রতিপক্ষের পরাজয়ের সংবাদ রয়েছে। উক্ত স্থানে দুষ্কৃতিকারীগণ প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছে। তা সত্ত্বেও তাদের নেতা তিতুমীরসহ আরো ৫০ জন নিহত হন। এছাড়াও ৩০ জন আহত ও ২৫ জনকে বন্দি করা হয়।

২. আমার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেরিত বাহিনীর রসদের জন্য সরকারের সামরিক সচিব কর্নেল কেউজমেন্ট ব্যারাকপুরের কমান্ডিং অফিসারকে নির্দেশ দেন। ঐ স্থান থেকে প্রাপ্ত রসদ বারাসতে প্রেরণের কথা বলা হয় এবং আমি আরো রসদ সংগ্রহ ও প্রেরণের জন্য বারাসত যাওয়ার প্রস্তাব করছি।

৩. যশোরের ম্যাজিস্ট্রেট যাতে তাঁর আয়ত্তাধীন এলাকা থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রেরণ করে এবং তদারকির জন্য ঘটনাস্থলে যায় সে সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

৪. নিহতদের মরদেহ আমার মতে কোনো বাছবিচার না করে পুড়িয়ে ফেলা অথবা যা উত্তম বলে বিবেচিত হয় তা করা প্রয়োজন। এছাড়া বাঁশের কেল্লায় প্রাপ্ত সম্পদ নৌপথে বাওগণ্ডুতে নিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। এতে প্রাপ্ত সম্পদগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং প্রকৃত মালিককে ফেরত দেয়া যাবে।

আলীপুর আপনার অনুগত
কমিশনার অফিস ই, আর, বারওয়েল
২০ নভেম্বর, ১৮৩১। সার্কিট কমিশনার।

গোরা সৈন্যরা নারকেল বাড়িয়ার জঙ্গে চাষার বাদশাহ তিতা মিঞাকে গুলি করে মেরে ফেরেছিল। গোরারা তিতা মিঞার লাশটা পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলেছিল যাতে তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে ছোটজেতের মানুষদের আর কখনো আসমানের নিচে চাষার বাদশাহি গড়ার সাধ না হয়! এমন সাধের বাঁশের কেল্লা গোলায় গোলায় ভেঙে পড়েছিল। তিতা মিঞার ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হলো যে জায়গায় তাকে নাকি গাঁয়ের মানুষ এখন ‘ফাঁসতলা’ বলে ডাকে! ডাকতেও পারে। আলীপুরের জেলে বসে সাজন গাজি অত ডাক কি শুনতে পায়? বামুনের ছেলে হয়েও যে দেবকি পাঠক বাঁশের কেল্লার আখেরি জঙ্গ পর্যন্ত তিতা মিঞার দলে ছিল, মামলা চলার সময়েই সে পাগল হয়ে গেছিল। আহা দেবকির বড় সাধ ছিল যে তার পৈতৃক দেবোত্তর সম্পত্তিতে নীল চাষ তিতা মিঞা ঠেকাবেন। তাই তো বামুনের ছেলে মন্দিরে গোরক্ত ছিটানোর পরও তিতা মিঞার দল ছাড়ে নি! পাগল হবার পর মারাও গেল! তিতা মিঞার দুই ছেলের ভেতর বড় ছেলের জঙ্গে ডান হাত কাটা গেছিল আর ছোট ছেলে একদমই নাবালক ছিল বলে দু’জনই ছাড়া পেয়েছিল। বাঁশের কেল্লার সিথানে পতপত করে ওড়া কোরআনের আয়াত লেখা সবুজ পতাকাটাও বৃটিশ নিয়ে গেছে। মোট পঞ্চাশ জন সাথী মারা গেছিল সেই জঙ্গে আর সাজনদের মতো প্রায় সাড়ে তিনশো জনাকে কোমরে-পায়ে লোহার শেকল বেঁধে চব্বিশ পরগণা হতে সুন্দরবন পার করে আলীপুরের জেলে এনে পোরা হয়। দৈনিক বরাদ্দ মাত্র দুবেলা এক ছটাক করে চাল। সাজনের ছোট ভাই পাতলা বড় ভাগ্যবান। নারকেলবাড়িয়ার শেষ জঙ্গে চাষার বাদশাহ তিতা মিঞার সাথে আরো যে উনপঞ্চাশজনা মারা গিয়ে ভেস্ত নসীব হয়েছে, সে তাদের একজন। কিন্তু, সাজন তো মরলো না। সে বড় গোনাগার। দ্বিনের লড়াইয়ে তার হলো সাত বছর জেল খাটার সাজা। মা গোলেবকাওলি বিবি বহুদূর পর্যন্ত সাজনের পিছ পিছ কাঁদতে কাঁদতে আর বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এসেছিল।

‘তুমি যাও দিকি মা — অকুন যাও — আমারে যাতি দাও!’

‘পাতলা কই মরি গেলো — তুই কোতা যাস — ও সেপাই, মোর পুত্তুররে চাড়ি দাও!’

‘যা দিকি তুই মা বিটি কুনকানের! যা মা — আমার দ্বিনির লড়াইয়ে — জমির লড়াইয়ে সাজা হয়িচে — এতে কোন গোনা নাই!’

…একুন এই আলীপুর জেলের অন্ধকার দরজা-জানালার শিক গুনতে গুনতে তোমরাই কও, হে এই জঙ্গনামার পাঠকেরা, মুই সাজন গাজি আর কী করতি পারি এই ময়লা খাতাটায় জঙ্গের গানগুলো আর চাষার বাদশা তিতা মিঞার কতা সাজোয়ে-গুচোয়ে রাকা ছাড়া?

রচনা: আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০০৮

তথ্যনির্দেশ


০১. তিতুমির ও তার শিষ্যরা ইসলামের কঠোর শরিয়তি বা শরিয়তপন্থী সংস্কারকে মান্য করেছিল বলে এলাকার লৌকিক ইসলামপন্থীরা তাদের ‘শরাওয়ালা’ (বানানভেদে ‘সরাঅলা’ বা ‘সরাওয়ালা’) বলেও ডাকতো।

০২. তিতুমীরের সহযোদ্ধা ও গ্রামীণ গান রচয়িতা সাজন গাজির গানের খাতায় ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার সাহেবকে আলিজিন্দা সাহেব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

০৩. বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট।


a_falgun@yahoo.com