Tuesday, February 3, 2009

যেভাবে কবিতা পাঠ আর আলোচনা ঠিক নয়

চঞ্চল আশরাফ

স্কুলের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যখন আমাদের কবিতা পড়ান, তখন তিনি প্রথমে সেটি শব্দ করে পড়ে শোনান, তারপর তা বোঝাতে গিয়ে বারবার ‘কবি বলেছেন’ কথাটি বলেন। পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তি তিনি ব্যাখ্যা করে, শেষে কবিতার মূল কথাটি জানিয়ে দেন বা সেই চেষ্টা করেন। এতেও তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; কবিতার কোন অংশটি গুরুত্বপূর্ণ, তিনি দেখিয়ে দেন এবং কোন প্রশ্ন ও কোন অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা পরীক্ষায় আসতে পারে, এলে উত্তরটি কেমন হবে — তা-ও বাতলে দেন। আমরাও বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করি; কারণ, আমাদের তো পরীক্ষা দিতে হবে, সন্তুষ্ট করতে হবে শিক্ষককে। ফলে, আমাদের কবিতা বোঝা-না-বোঝা একান্তই পরীক্ষাকেন্দ্রিক এবং এই অবস্থা থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী মুক্ত হতে পারে না বা তাদের উত্তরণ ঘটে না; সেই লক্ষ্য বা সচেতনতা তাদের থাকে না। যাদের থাকে না, কবিতা সম্পর্কে তাদের ধারণার পরিবর্তনও ঘটে না। তা না-ঘটুক, শ্রেণিকক্ষে শব্দ করে যা পড়ান শিক্ষক, তা ‘কবিতা’ কি-না, তা বুঝে ওঠার আগেই আমাদের সামনে তিনি এর ব্যাখ্যায়, শব্দার্থে, সারমর্মে মনোযোগী করে তোলেন। পাঠ্যপুস্তকের ওই রচনাটি ‘কবিতা’ কি-না, তা জানার অবশ্য উপায়ও তখন থাকে না। কারণ, শিক্ষকই তো পূর্বনির্ধারিতভাবে, বা, নিয়তির মতোই আমাদের সামনে একে ‘কবিতা’ জেনেই উপস্থিত হয়েছেন। অথবা, তিনি হয়ত ভাবেনও নি ওটা ‘কবিতা’ কি-না, হলে কী-কী শর্ত তাতে রয়েছে। না-ভাবার কারণ হল, পাঠ্যপুস্তক-প্রণেতারাই স্থিরনিশ্চিত করে দিয়েছেন — যা পড়ানো হবে তা-ই কবিতা; এতে কোনও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
‘কবি বলেছেন’ কথাটা স্কুল-কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের শ্রেণীকক্ষে পর্যন্ত আছড়ে পড়েছে। এটি শিক্ষকদের মুদ্রাদোষ হয়ে উঠল কেন? তারা কি জানেন না যে, কবিতার মধ্যেই কবির কথা বলা হয়ে আছে, ‘শ্রেণিকক্ষের কবিতা’য় অন্তত কবির কথা সম্পর্কে কারও দ্বিমত হওয়ার কথা নয়। আমরা এটা কখনও দেখি না, ‘কবিতা’টি সম্পর্কে শিক্ষক নিজের ধারণা ও ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন। তো, সবই যখন ‘কবি বলেন’ তখন আমরা অসহায় বোধ করি অথবা করি না; কারণ আমরা এই মর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি — শ্রেণিকক্ষে কবিতার বক্তব্য নিয়ে শিক্ষকের কিছু বলার নেই, কবিই সব বলবেন; বছরের পর বছর একই কথা বলবেন; শিক্ষকের কাজ কেবল তার স্বরযন্ত্রটি ব্যবহার করা। কিন্তু কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী পাঠক এক সময় জানতে বা বুঝতে পারে, শ্রেণিকক্ষে যে রচনা নিয়ে (সব) শিক্ষক একই কথা বলেন বছরের পর বছর, তা আসলে কবিতাই নয়। কারণ, সেটিই কবিতা, যার ব্যাখ্যা পরিবর্তনশীল এবং পাঠকভেদে ভিন্ন। পাঠ্যবইয়ে স্থান-পাওয়া ‘কবিতা’গুলো ব্যর্থ, কারণ, যে-ব্যাখ্যা নির্ধারণ করা হয় এগুলোর জন্যে, তার বাইরে যাওয়ার যোগ্যতা বা সামর্থ্য এরা বহু আগেই হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চিতভাবেই, রচনাটি বরণ করেছে পদ্যত্ব — কেননা, তার ভাষার মৃত্যু ঘটেছে, বেঁচে আছে কেবল সাহিত্যের ইতিহাসের খুব ক্ষুদ্র ও নিরীহ ইউনিট হিসেবে; যদিও শ্রেণিকক্ষে এর দাপটের সীমা নেই। আমরা ধরে নিতে পারি, একসময় কবিতা হিসেবে এগুলোর প্রকাশ ঘটেছিল, হয়তো এগুলোর ছিল অনেকান্ত পাঠ ও ব্যাখ্যা; ভাষার গতিশীলতার সঙ্গে টিকে থাকতে না-পারায় আজ এই দশা হয়েছে: একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যায় এটি স্থির হয়ে গেছে, সারমর্ম বলে যা বোঝানো হয়, তাতেই থমকে আছে; এমন অবস্থা হয়েছে, ব্যাখ্যা বা সারমর্ম পড়লে কবিতাটি পড়ার আর দরকার হয় না; কবিতাটি একবার পড়লে প্রয়োজনই হয় না এর ব্যাখ্যা বা সারমর্ম খুঁজতে যাওয়ার, কেননা, সবই চূড়ান্ত হয়ে আছে ওই রচনায়, তাতে পাঠকের অংশগ্রহণের যে জায়গাটুকু শুরুতে ছিল, সময় তা কেড়ে নিয়েছে। সময় মানে ভাষার সময়, তার গতিশীলতা, পরিবর্তন। তো, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা ভাষার এই পরিবর্তনের কাছে অসহায়; যদিও তারা জানেন না ভাষার গতিশীলতার কাছে পাঠ্য রচনাটি নিহত হয়েছে; রচনাটি কেবল একটা কাঠামো হয়ে পাঠসূচিতে ঠাঁই নিয়েছে। কাঠামোটি খুব মামুলি ও নিরীহ; কেননা, আর সব পাঠ্য ‘কবিতা’ থেকে একে আলাদা করা যায় না। করা যায়, যখন এর বক্তব্যটি আমরা লক্ষ করি। সেটি অবশ্য ‘কবি’রই বক্তব্য, এতে পাঠকের অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ নেই। ফলে, শিক্ষকেরও উপায় নেই, রচনাটির ব্যাখ্যায় বারবার ‘কবি বলেছেন’ কথাটা বলা ছাড়া!
বোঝা যাচ্ছে, প্রতিটি কবিতাই, এমন-কি একটু আগে যেটি লেখা হয়েছে, ভাষার গতিশীলতার সঙ্গে সেটি একরকম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। চট করে কেন, দশ বছরেও দৌড়টির চেহারা বুঝে ওঠা কঠিন, যেমন সহজ নয় ভাষার গতিশীলতাকে বুঝে ওঠা। ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রগুলো এই কাজে আমাদের সাহায্য করতে পারে। কবিতার ভাষা কেমন করে বদলে যায়, তা বুঝতে সেই সূত্রগুলোর সমর্থন কাজে লাগতে পারে। সে-সব আমরা কম-বেশি জানি। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরের কবিতা প্রতিদিন যত পড়ছি, তত মনে হচ্ছে কবিতার মৃত্যু নিয়ে কবিদের মধ্যে যথেষ্ট উদাসীনতা আছে। কীভাবে কবিতার মৃত্যু ঘটে এবং তা আর্কাইভের খাদ্য হয়ে যায় — বুঝে নিতে পারলে, আমার ধারণা, কবিতার এমন দশা হত না। অবশ্য এ-ও ঠিক, এইসব ভেবেটেবে কবিতা রচিত হতে পারে না, হয়ও নি কোনও কালে। তবু কথাটা এজন্যেই বলা, ভাষার আপেক্ষিকতা ও অনির্ণেয় ভবিতব্য রচনামুহূর্তে যদি কবির সামনে এসে দাঁড়ায় এবং চেতন-অবচেতনের মধ্যে যাতায়াত করতে থাকে, সেই কবিতা কেন সৃষ্টি হবে না যা সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বহুদূর টিকে থাকতে পারে? প্রতিটি কবিতাই তার ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্য থেকে লেখা হচ্ছে; কিন্তু কবির ভাবা দরকার, তার সময়ে কবিতা যেখানে এসে পৌঁছেছে, অন্তত সেই জায়গা থেকে তাকে লিখতে হবে। কোথায় পৌঁছেছে, তা জানতে পারি আলোচনা থেকেই, গ্রন্থালোচনা থেকেও তা জানা কিছুটা সম্ভব কখনও-কখনও; কিন্তু বাংলা ভাষায় গ্রন্থালোচনার অবস্থা বহু আগে থেকেই শোচনীয়। এখন অবশ্য সামান্য উন্নতি হয়েছে: বইয়ের প্রচ্ছদ, মলাট, কাগজ, ছাপা, বাঁধাই নিয়ে কোনও কথা আলোচকদের আর লিখতে দেখা যায় না। যা-ই হোক, কবিতা যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেখান থেকে লিখলে, সমালোচনার ভাষাও তো বদলে যেতে পারে, অন্তত পরিবর্তনের প্রভাবটুকু পড়তে পারে। জীবনানন্দ দাশ ঝরাপালক (১৯২৭) কাব্যগ্রন্থে না-পারলেও ধূসর পাণ্ডুলিপিতে (১৯৩৬) সেটি, মানে বাংলা কবিতা যেখানে পৌঁছেছে, সেখান থেকে শুরু করতে পেরেছিলেন। বইটি প্রকাশের কাল থেকে সত্তর বছরের বেশি সময়ে বাংলা কবিতায় বৈপ্লবিক না-হলেও কিছু লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে; কিন্তু সমালোচনায় তেমন কোনও বদল ঘটে নি। জীবনানন্দের কবিতারও উপযুক্ত পাঠ-বিশ্লেষণ কারও পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর জীবনানন্দ (১৯৮৯) বইটি ছাড়া আর কারও বইয়ের নাম ভাবা যাচ্ছে না; বুদ্ধদেব বসু স্মরণীয় হতে পারেন, তবে তা কেবল এই কবিকে চিনিয়ে দেবার জন্যে; কেননা, জীবনানন্দ সম্পর্কে তিনি যে-আলোচনা হাজির করেছেন, তা উদ্ধৃতিপীড়িত ও বিশেষণনির্ভর। উল্লেখ বাহুল্য নয়, আজও সেই ধারাটি চলছে। এক্ষেত্রে একটা আত্মতৃপ্তি ও সান্ত¡না হয়ত আমাদের আছে। আত্মতৃপ্তিটি জীবনানন্দ বাংলা ভাষার কবি বলে আর সান্ত¡না তাঁর কবিতা এতই আপেক্ষিক ও অনির্ণেয় সমগ্রতা ধারণ করে আছে যে, এর বিশ্লেষণ আজও দুঃসাহসের বিষয়, কঠিন এবং কখনও-কখনও প্রায়-অসম্ভব ব্যাপার।) একটা কথা শুনে আসছি, আগে সৃষ্টি, পরে তত্ত্ব এবং তারপর সেই তত্ত্বের প্রয়োগ। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের মত একজন কবির আগমনের বহু বছর পরও বাংলা ভাষার কবিতার পাঠ ও আলোচনার ধরনটি কেন আগের মতোই রয়ে গেল? সমালোচনার পদ্ধতি ও ধারা কেন বদলায় নি?
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতে গিয়ে শিক্ষকদের বেশ ‘উহু-আহা’ করতে দেখেছি। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এর সঞ্চার ঘটলে এবং পাঠ-বিশ্লেষণের কোনও পদ্ধতি জানা না-থাকলে সেই ধ্বনি-প্রতিধ্বনির বিস্তার ঘটাই স্বাভাবিক। ফলে, কবিতার সমালোচনায় ‘লাইনটি চমৎকার’, ‘উপমাটি অতুলনীয়’, ‘কবিতাটি অসাধারণ’, ‘হয়ে ওঠে নি’, ‘ছুঁয়ে যায়’ ইত্যাদি উল্লেখের বিচিত্র গৎ তৈরি হয়েছে। বিশেষণ ব্যবহার তো রয়েছে বেশ আগে থেকেই। জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে যখন কোনও আলোচনার বই ছিল না বাংলাদেশে, তখন শুদ্ধতম কবি (১৯৭২) নামে আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি বই বেরোয়। এটি পড়েন নি, এমন লেখকদের এক সময় বেশ বিব্রত হতে দেখেছি সাহিত্যসমাজে। তো, খুব আগ্রহ নিয়ে শুদ্ধতম কবি পড়ে দেখি, জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে বিশ্লেষণের অজুহাতে এতে আছে উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি, ক্যাটালগিংয়ের বিস্তৃত আড়ম্বর আর কবির জন্যে কী বিশেষণ বরাদ্দ হতে পারে, এ-নিয়ে বিশেষ ব্যস্ততা! বুঝতে পারি, বাংলা সাহিত্য-সমালোচনার একটা বড় অর্জন হল কবিদের জন্যে বিশেষণ আবিষ্কার করতে পারা; বুদ্ধদেব বসু এই পথ প্রথমে দেখান, শুদ্ধতম কবি সেটি চওড়া ও লম্বা করেছে। এ-ছাড়া বইটির কোনও অর্জন দেখতে পাওয়া কঠিন। কিন্তু ততদিনে এটিই কবিতা বিশ্লেষণের ‘আদর্শ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ফলে, কোনও কবিতার আলোচনায় উপযুক্ত বিশেষণ খোঁজার কাজটি আলোচকের জন্যে অবধারিত হয়ে আসছে। কিন্তু কবিতা কেন, সাহিত্যের কোনও বর্গের কোনও রচনার আলোচনায় এটি শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও পরিষ্কার ধারণা দিতে পারে না। সাহিত্য-আলোচনার কোনও পদ্ধতিই দীর্ঘকাল চলে না, চলা ঠিকও নয়; সাহিত্যের জন্যে তা অস্বাস্থ্যকর। অথচ দেখা যায়, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আলোচনায় যুগ-যুগ ধরে বলা হচ্ছে, এটি বীর রসের কবিতা; ছন্দ এখনও কবিতার আলোচনার বড় একটা জায়গা দখল করে আছে; কোন শব্দটি বিদেশি বা তৎসম সেই প্রসঙ্গও গুরুত্ব পাচ্ছে; উপমা, অন্ত্যমিল, অনুপ্রাস ইত্যাদি দেখানোর কাজ অন্তত আশি বছর ধরে চলছে। চিত্রকল্প সম্পর্কে এখানকার আলোচকদের আগ্রহ বেশি দিনের নয়, কিন্তু এ-নিয়ে অধিকাংশেরই নেই পূর্ণাঙ্গ ধারণা, একরকম আংশিক, আড়ষ্ট ও ভুল ধারণা ব্যবহৃত হয় চিত্রকল্প-ব্যাখ্যায়। ফলে, ব্যাখ্যাটিও গোলমেলে হয়ে পড়ে। এর জন্যে বইয়ে ও শ্রেণিকক্ষে শেখানো চিত্রকল্পের সংজ্ঞা কেবল নয়, দায়ী সেই সংজ্ঞাটি ঠিক বা পূর্ণাঙ্গ কি-না তা যাচাই করে না-দেখা; চিত্রকল্প নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা বই ও প্রবন্ধগুলো অভ্রান্ত জেনে বিনা প্রশ্নে মস্তিষ্কে স্থান দেওয়া। বলা হয়ে থাকে, ইন্দ্রিয়ঘন বর্ণনাই চিত্রকল্প: রঙ, ঘ্রাণ, স্পর্শানুভূতি, স্বাদ ইত্যাদি প্রকাশ করা বা পাঠকের মধ্যে সঞ্চার করা চিত্রকল্পের কাজ। সংজ্ঞাটি খুব আকর্ষণীয় এবং এতে আকৃষ্ট হয়ে কবিরা তাদের রচনায় প্রচুর ‘চিত্রকল্প’ সৃষ্টি করে চলেছেন; আলোচকরাও বেশ ব্যস্ত, কবিতার কোন অংশে পাঠকের ইন্দ্রিয়কে সক্রিয় করে তোলার কাজটি আছে তা খুঁজে বের করতে; কিন্তু এখানকার পণ্ডিতদের মন-গড়া একটা সংজ্ঞা অনুসরণ করে যে কাজটি চলছে, সে-সম্পর্কে কে ভাববে? চিত্রকল্পের ধারণাটি এসেছে পশ্চিম থেকে, প্রথম এটি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন চিত্রকল্পবাদী কবিরা; আর একে কবিতার জন্যে অনিবার্য বলে প্রচার করা হতে থাকে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে, ওই কবিদের হাতেই। এর প্রবক্তা ছিলেন এজরা পাউন্ড, এফ এস ফ্লিন্ট ও টি ই হিউম; একটা ইশতেহার তারা দেন এবং এতে চিত্রকল্পের সংজ্ঞাটিও নির্ধারিত হয়ে যায়: আবেগ ও বুদ্ধিগত জটিলতার তাৎক্ষণিক প্রকাশই চিত্রকল্প। ইন্দ্রিয় এখানে খুব প্রাথমিক একটি বিষয়। মধ্যযুগের গীতিকবিতায়ও ইন্দ্রিয়ঘন বর্ণনা আছে, কিন্তু সে-সব চিত্রকল্প নয়; কারণ, তাতে আবেগ ও বুদ্ধির জটিলতার আনকোরা প্রকাশ নেই। আধুনিক কবিতার ব্যাখ্যায় চিত্রকল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে আছে।
আর ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি কবিতার প্রাথমিক শর্ত মাত্র। এগুলো অপরিহার্য না-ও হতে পারে। আমি মনে করি, একটি ভালো কবিতা প্রচলিত এইসব শর্তকে আড়াল করতে পারে; না-পারলে সেই কবিতা ভালো নয় বা ব্যর্থ; অনেক কবিতা আছে যেগুলো পাঠের সময় এবং পরে ছন্দ আর উপমা জেগে থাকে, ফলে কবিতাটির আসল বা আপাতত অভিপ্রায়টি বোঝা মুশকিল বা সেদিকে পাঠকের মনোযোগ থাকে না। পাঠক নিজের অজান্তেই তখন কবিতা থেকে দূরে সরে যায়। কোনও কবি যদি একে একটা কৌশল বলে দাবি করেন, তা হলে বলব: খুবই বাজে কৌশল এটি; সস্তা ফাঁকিবাজি; এতে কবি অচিরেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়বেন। চিত্রকল্প, অলঙ্কার, ছন্দ এসবের চমৎকারিত্ব দেখানোর মধ্য দিয়ে কবিতার উৎকর্ষের পক্ষে যত সাফাই হোক, কবিতার সংগ্রাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার সংগ্রাম; সমকালোত্তর হয়ে ওঠা তার অভিপ্রায়; নানা তত্ত্ব, সংজ্ঞা ও বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতির ছক বা দাসত্ব থেকে মুক্তি সে চায়। দেখা যায়, কিছু কবিতা সেই লক্ষ্য পূরণ করে, বা, সেই চেষ্টা ওই কবিতাগুলোর প্রতিটি পাঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে, তার ব্যাখ্যায় প্রচলিত ছকের উপাদানগুলো আর কাজে আসে না।
তখন আমাদের সামনে কী করণীয় থাকে? এ-কথা বারবার বলি যে, একটি কবিতা প্রকাশের পর যখন আলোচ্য হয়, দু’টি জিনিশ, প্রধানত, লক্ষ করা দরকার: ১. কবিতা সম্পর্কে কী ধারণা এটি প্রকাশ করতে চাইছে ও ২. জীবন ও জগত নিয়ে কী মনোভাব এতে রয়েছে। উল্লেখ বাহুল্য নয়, এ-দুটোর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায় পূর্বসাধক ও সমকালীনদের থেকে কবি কতটা স্বতন্ত্র বা নতুন; না-কি তিনি প্রতিষ্ঠিত কবিদের সম্প্রসারণকর্মটি কেবল সম্পাদন করে চলেছেন; হয়ে পড়ছেন প্রচলিত ধারার নিরীহ একক মাত্র!
ডিসেম্বর, ২০০৮
chanchalashraf1969@yahoo.com

No comments:

Post a Comment