Friday, January 16, 2009

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি



মুক্তিযুদ্ধ: ভাস্বর সেই দিনগুলি
সন্তোষ চৌধুরী

ফেলে আসা দিনগুলির দিকে ফিরে তাকালে সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি যা আমাকে আলোড়িত করে তা মুক্তিযুদ্ধ। নিঃসন্দেহে শুধু আমার জীবনের নয়, সমগ্র বাঙ্গালী জাতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা-সবচেয়ে শ্রেষ্ট ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙ্গালী জাতি তার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অর্জন করেছে নিজের একটি দেশ, নিজের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড- বাংলাদেশ। গর্বিত শির উঁচু করে সে দেশটি আজ পৃথিবীর মানচিত্রে আপন বৈভবে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যৎ সামান্য অবদান রাখার প্রয়াস রেখেছি- সেই স্মৃতিই আমাকে আপ্লুত করে রেখেছে সারাটি জীবন। কতগুলি বছর কেটে গেছে তারপর। কিন্তু সেই জীবন্ত স্মৃতিগুলিকে মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা। সেই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হামলার মুখে দাদা,বৌদি এবং গ্রামের অন্যদের সংগে দুই দিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া, প্রশিক্ষণ নেওয়া, আরো প্রশিক্ষণের জন্য দেরাদুন যাওয়া, জেনারেল ওবানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ, ফিরে এসে বাংলাদেশের ভিতরে অভিযান চালানো, রানীনগরে অপারেশনে অংশ নেওয়া- এসবই আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
একাত্তরে আমি ছিলাম মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে- বি.এস.সি.প্রথম বর্ষের ছাত্র। থাকতাম হোস্টেলে। ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসাবে। মার্চে প্রথম থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছিলাম বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচি নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের পল্টনের জনসভায় যাওয়া প্রস্তুতি নিয়েছিলাম হোস্টেলের ছেলেরা মিলে। কিন্তু যাওয় সম্ভব হয়নি যানবাহনের অভাবে। রাস্তায় তখন কোন যানবাহন চলছিল না।
এরই মধ্যে শুনতে পেলাম আমার বাড়ি নওগাঁ বগুড়ার দিকে হাদানার বাহিনীর তৎপরতার কথা। বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে যাওয়া সহজ ছিল না। অনেক কষ্টে আরিচা গিয়ে সেখান থেকে ফেরি পার হয়ে পরদিন সকালে আমার বাড়ি নওগাঁর ইকড়তারায় পৌঁছাই। তখনও কি জানতাম এ যাত্রায় আর ফেরা হবে না মানিকগঞ্জে। আসলে আমরা কেউ কি কল্পনা করেছিলাম পাকিস্তানীরা আমাদের উপর এমন বর্বর হামলা চালাবে! তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে? কখনও কি ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে আমাদের নিজেদের স্বাধীন বাংলাদেশ?এই অভাবনীয় ঘটনার দিকেই আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ২৫ শে মার্চের রাতে হানাদারদের নৃশংসতা ও সর্বাত্বক হামলায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। তাদের সঙ্গে লড়াই আমাদের অনিবার্য। স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী আমাদের নওগাঁ শহর দখল করে নেয় এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় আত্মরক্ষা করা যাবে না এটা বুঝতে পেরে আমাদের গ্রামের লোকজন সীমান্তের পথ ধরে। আমার সেজদা নওগাঁ জেলা স্কুলের শিক্ষক শ্রী শক্তিপদ চৌধুরী এবং বৌদিও পথে নামেন। আমিও তাদের সংগ নেই।
দুইদিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে আমরা পশ্চিম বাংলার বালুরঘাট শহরের পাশে আমার বড় বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠি। আমার বাবা,মা,ভাই বোন এবং আরো কিছু আত্মীয়স্বজনও এর পরপরই চলে আসেন। আসার পথে দাদের অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। আমার মেজো ভগ্নিপতির ছোট ভাই বিধুভূষণ সরকার ধাসুরহাটের সীমান্ত এলাকায় পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হন। পাক সেনাদের এই হামলায় বিধুভূষণ সরকারের সহযাত্রী আরো অন্তত: চল্লিশজন প্রাণ হারান।
ওপারে গিয়ে চুপ করে থাকার অবকাশ ছিল না। বাংলাদেশের দুঃশ্চিন্তায় আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের সমস্ত মন মানসিকতা জুড়ে বিরাজ করছিল একটাই চিন্তা- বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। হানাদেরদের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হবে। এই চিন্তা থেকেই গ্রামের দুজন বন্ধুকে নিয়ে চলে যাই বাঙ্গালীপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সেখানে নাম লেখাই। সেখানে দিন পনের প্রশিক্ষণের পর আমাকে মনোনীত করা দেরাদুনে প্রশিক্ষণের জন্য। নওগাঁর একজন ছাত্রনেতা মোয়াজ্জেম ভাই আমাকে দেরাদুন পাঠাবার জন্য বাঙ্গালীপুর ক্যাম্প থেকে বালুরঘাট ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মার্শাল মনি ভাই।
তিনদিনের মধ্যে আরো প্রায় ৩০ জন ছেলেকে নিয়ে আসেন মোয়াজ্জেম ভাই। একদিন ভোরে আমাদর সবাইকে একটি ট্রাকে করে জলপাইগুড়ি শহরের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুই সপ্তাহ থাকার পর দুটি ট্রাকে করে ষাট সত্তর জন ছেলেকে প্রথমে বাগডোবরা বিমান বন্দর এবং সেখান থেকে একটি বিশাল রাশিয়ান মালপরিবহন বিমানে শাহারানপুর নেওয়া হয়। এরপর দুইটি ট্রাকে আমাদের দেরাদুন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেরাদুনে প্রশিক্ষণের সময় জানতে পারলাম এটা একটা বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানকার দায়িত্বে আছেন তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক,শেখ ফজলুল হক মনি এবং সিরাজুল আলম খান। সার্বিক তত্বাবধানে আছেন একজন ভারতীয় জেনারেল সুজন সিং ওবান। প্রশিক্ষণ চলাকালে একদিন হঠাৎ করে সিরাজ ভাই বললেন- তুই আমার সঙ্গে আয়। তুই দ্বিতীয় ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তোকে জেনারেল ওবান দেখতে চায়। আমি সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে জেনারেল ওবানের কাছে যাই। ওবান আমাকে দেখে খুব খুশি হন।
দেরাদুন থেকে এক মাসের প্রশিক্ষণ শেষে আমরা জলপাইগুড়ি ফিরে আসি। এই সময় জলপাইগুড়ি ক্যাম্পে সিরাজুল আলম খানএবং আব্দুর রাজ্জাক কেন আমরা মুক্তিযদ্ধ করছি এবং বাংলাদেশ প্রবেশের পর আমাদের করণীয় বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিতেন।
সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর আমাদের বালুরঘাট শহরের সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে এনে রাখা হয়। এখানে সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন মোয়াজ্জেম ভাই। তিনিই আমাদের গ্রুপকে বাংলাদেশে ঢোকার সব ব্যবস্থা করেন।
এখানে একদিন থাকার পর রাত ১১টায় মায়াজ্জেম ভাই আমাদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। দশ বারো মাইল হাঁটার পরে খুবশীর বিলের পাশে একটি বাড়িতে আমরা আশ্রয় নেই। সেখানে সারাদিন থাকার পর রাত দশটায় নৌকাযোগে খুবশীর বিল পার হয়ে দশ বারো মাইল হেঁটে মল্লিকপুর গ্রামে আসি। মল্লিকপুরে সারাদিন থেকে রাতে হেঁটে এবং নৌকাযোগে দুবলাহাটি এলাকার বিল অঞ্চলে আশ্রয় নেই। এখানে তিনদিন থাকার পর আমার নিজ এলাকা তিলকপুর ইউনিয়নে চলে আসি। আমরা কেন এ মুক্তিযুদ্ধ করছি সে বিষয়ে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের উদ্বুদ্ধকরণের দায়িত্ব পালন করি। একই সঙ্গে স্থানীয় যুবক ছেলেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করি।
নভেম্বরের শেষ দিকে আমরা চার পাঁচটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ সম্মিলিতভাবে রানীনগর থানা আক্রমণ করি। সেখানে দুইদিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ফেলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। কয়েকজন পাকসেনা গুরুতরভাবে আহত হয়।আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত এবং একজন আহত হন। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৫ জন রাজাকার আমাদের কাছে আত্মসমর্পন করে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণকাজে আমি কেশবপুর গ্রামে অবস্থান নেই। এমন সময় রেডিওর খবরে জানতে পারলাম ভারত বাংলাদেশকে স্বীকুতি দিয়েছে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল বিজয় আমাদের সন্নিকটে। সত্যি সত্যিই সময় আর বেশি দিন লাগেনি। কদিন পরই ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর তিরানব্বই হাজার সৈন্যযৌথবাহিনীর কাছে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে।
অতঃপর বঙ্গবন্ধুর আহবানে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা স্টেডিয়ামে আমরা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ জমা দেই।

*(মুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ চৌধুরী বর্তমানে নিউ ইয়র্ক,যুক্তরাস্ট্রে বসবাস করছেন।)
**প্রবন্ধের শিরোণামে ক্লিক করুন,জহির রায়হান পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের অমর দলিল স্টপ জেনো সাইড চলচ্চিত্রটি দেখতে পাবেন।
***এর পর ভিডিও স্ক্রিনের উপরে ডান দিকে previous বাটনে ক্লিক করুন। স্টপ জেনোসাইডের পার্ট ২ দেখতে পাবেন।
**** see all ক্লিক করুন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেকগুলো চলচ্চিত্র এখানে পাবেন।

No comments:

Post a Comment