Sunday, January 25, 2009

আনন্দ রোজারিও-র কবিতা

ছায়াপাখি

এ গান শুনেছি আমি খরসান হাওয়ার ভিতরে
অনন্ত পাখির প্রায় আমিও জেনেছি-
যে সকল পাতা ঝরে পড়ে
নবীন মুকুল এসে ক্ষত সেরে রাখে তার
তবু কেন মনে পড়ো তুমি হে মুরলী মোহন?
রচো কেন গুপ্ত প্রণয়? নিঝুম মধুক্ষরা দিন?

গাছে গাছে বিলাপের ফুল ফুটে ওঠে
তাই আমি ক্ষীণ স্রোতধারা পার হয়ে যাই
অপার পায়ের নীচে সুরভিত পথরেখা
স্তব্ধপ্রায় মুথাঘাস
রথ চলে গেছে বহু দূর
যে গেছে এ পথে আজ তার কোন নাম নয়-
ধুলি ধুসরিত মায়া পড়ে আছে পথের উপরে

এই পথ হ্রস্ব মনে হয়,যদিও সুদূর

পাখি তুমি কোন গান গাও?
কেন তাকে ফিরে ফিরে ডাকো?
যে যায় লাবণ্য বনে সে কি আর ফিরে আসে?

এই হেতু দুপুরের কোনে কোনে
খরসান হাওয়া ওঠে,বারবার ঝরে পড়ে পাতা

কত হাহাকারে পাখি তুমি নিরাকার ছায়া

২৫ জানুয়ারি/২০০৯

Friday, January 16, 2009

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি



মুক্তিযুদ্ধ: ভাস্বর সেই দিনগুলি
সন্তোষ চৌধুরী

ফেলে আসা দিনগুলির দিকে ফিরে তাকালে সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি যা আমাকে আলোড়িত করে তা মুক্তিযুদ্ধ। নিঃসন্দেহে শুধু আমার জীবনের নয়, সমগ্র বাঙ্গালী জাতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা-সবচেয়ে শ্রেষ্ট ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙ্গালী জাতি তার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অর্জন করেছে নিজের একটি দেশ, নিজের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড- বাংলাদেশ। গর্বিত শির উঁচু করে সে দেশটি আজ পৃথিবীর মানচিত্রে আপন বৈভবে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যৎ সামান্য অবদান রাখার প্রয়াস রেখেছি- সেই স্মৃতিই আমাকে আপ্লুত করে রেখেছে সারাটি জীবন। কতগুলি বছর কেটে গেছে তারপর। কিন্তু সেই জীবন্ত স্মৃতিগুলিকে মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা। সেই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হামলার মুখে দাদা,বৌদি এবং গ্রামের অন্যদের সংগে দুই দিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া, প্রশিক্ষণ নেওয়া, আরো প্রশিক্ষণের জন্য দেরাদুন যাওয়া, জেনারেল ওবানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ, ফিরে এসে বাংলাদেশের ভিতরে অভিযান চালানো, রানীনগরে অপারেশনে অংশ নেওয়া- এসবই আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
একাত্তরে আমি ছিলাম মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে- বি.এস.সি.প্রথম বর্ষের ছাত্র। থাকতাম হোস্টেলে। ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসাবে। মার্চে প্রথম থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছিলাম বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচি নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের পল্টনের জনসভায় যাওয়া প্রস্তুতি নিয়েছিলাম হোস্টেলের ছেলেরা মিলে। কিন্তু যাওয় সম্ভব হয়নি যানবাহনের অভাবে। রাস্তায় তখন কোন যানবাহন চলছিল না।
এরই মধ্যে শুনতে পেলাম আমার বাড়ি নওগাঁ বগুড়ার দিকে হাদানার বাহিনীর তৎপরতার কথা। বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে যাওয়া সহজ ছিল না। অনেক কষ্টে আরিচা গিয়ে সেখান থেকে ফেরি পার হয়ে পরদিন সকালে আমার বাড়ি নওগাঁর ইকড়তারায় পৌঁছাই। তখনও কি জানতাম এ যাত্রায় আর ফেরা হবে না মানিকগঞ্জে। আসলে আমরা কেউ কি কল্পনা করেছিলাম পাকিস্তানীরা আমাদের উপর এমন বর্বর হামলা চালাবে! তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে? কখনও কি ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে আমাদের নিজেদের স্বাধীন বাংলাদেশ?এই অভাবনীয় ঘটনার দিকেই আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ২৫ শে মার্চের রাতে হানাদারদের নৃশংসতা ও সর্বাত্বক হামলায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। তাদের সঙ্গে লড়াই আমাদের অনিবার্য। স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী আমাদের নওগাঁ শহর দখল করে নেয় এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় আত্মরক্ষা করা যাবে না এটা বুঝতে পেরে আমাদের গ্রামের লোকজন সীমান্তের পথ ধরে। আমার সেজদা নওগাঁ জেলা স্কুলের শিক্ষক শ্রী শক্তিপদ চৌধুরী এবং বৌদিও পথে নামেন। আমিও তাদের সংগ নেই।
দুইদিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে আমরা পশ্চিম বাংলার বালুরঘাট শহরের পাশে আমার বড় বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠি। আমার বাবা,মা,ভাই বোন এবং আরো কিছু আত্মীয়স্বজনও এর পরপরই চলে আসেন। আসার পথে দাদের অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। আমার মেজো ভগ্নিপতির ছোট ভাই বিধুভূষণ সরকার ধাসুরহাটের সীমান্ত এলাকায় পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হন। পাক সেনাদের এই হামলায় বিধুভূষণ সরকারের সহযাত্রী আরো অন্তত: চল্লিশজন প্রাণ হারান।
ওপারে গিয়ে চুপ করে থাকার অবকাশ ছিল না। বাংলাদেশের দুঃশ্চিন্তায় আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের সমস্ত মন মানসিকতা জুড়ে বিরাজ করছিল একটাই চিন্তা- বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। হানাদেরদের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হবে। এই চিন্তা থেকেই গ্রামের দুজন বন্ধুকে নিয়ে চলে যাই বাঙ্গালীপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সেখানে নাম লেখাই। সেখানে দিন পনের প্রশিক্ষণের পর আমাকে মনোনীত করা দেরাদুনে প্রশিক্ষণের জন্য। নওগাঁর একজন ছাত্রনেতা মোয়াজ্জেম ভাই আমাকে দেরাদুন পাঠাবার জন্য বাঙ্গালীপুর ক্যাম্প থেকে বালুরঘাট ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মার্শাল মনি ভাই।
তিনদিনের মধ্যে আরো প্রায় ৩০ জন ছেলেকে নিয়ে আসেন মোয়াজ্জেম ভাই। একদিন ভোরে আমাদর সবাইকে একটি ট্রাকে করে জলপাইগুড়ি শহরের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুই সপ্তাহ থাকার পর দুটি ট্রাকে করে ষাট সত্তর জন ছেলেকে প্রথমে বাগডোবরা বিমান বন্দর এবং সেখান থেকে একটি বিশাল রাশিয়ান মালপরিবহন বিমানে শাহারানপুর নেওয়া হয়। এরপর দুইটি ট্রাকে আমাদের দেরাদুন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেরাদুনে প্রশিক্ষণের সময় জানতে পারলাম এটা একটা বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানকার দায়িত্বে আছেন তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক,শেখ ফজলুল হক মনি এবং সিরাজুল আলম খান। সার্বিক তত্বাবধানে আছেন একজন ভারতীয় জেনারেল সুজন সিং ওবান। প্রশিক্ষণ চলাকালে একদিন হঠাৎ করে সিরাজ ভাই বললেন- তুই আমার সঙ্গে আয়। তুই দ্বিতীয় ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তোকে জেনারেল ওবান দেখতে চায়। আমি সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে জেনারেল ওবানের কাছে যাই। ওবান আমাকে দেখে খুব খুশি হন।
দেরাদুন থেকে এক মাসের প্রশিক্ষণ শেষে আমরা জলপাইগুড়ি ফিরে আসি। এই সময় জলপাইগুড়ি ক্যাম্পে সিরাজুল আলম খানএবং আব্দুর রাজ্জাক কেন আমরা মুক্তিযদ্ধ করছি এবং বাংলাদেশ প্রবেশের পর আমাদের করণীয় বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিতেন।
সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর আমাদের বালুরঘাট শহরের সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে এনে রাখা হয়। এখানে সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন মোয়াজ্জেম ভাই। তিনিই আমাদের গ্রুপকে বাংলাদেশে ঢোকার সব ব্যবস্থা করেন।
এখানে একদিন থাকার পর রাত ১১টায় মায়াজ্জেম ভাই আমাদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। দশ বারো মাইল হাঁটার পরে খুবশীর বিলের পাশে একটি বাড়িতে আমরা আশ্রয় নেই। সেখানে সারাদিন থাকার পর রাত দশটায় নৌকাযোগে খুবশীর বিল পার হয়ে দশ বারো মাইল হেঁটে মল্লিকপুর গ্রামে আসি। মল্লিকপুরে সারাদিন থেকে রাতে হেঁটে এবং নৌকাযোগে দুবলাহাটি এলাকার বিল অঞ্চলে আশ্রয় নেই। এখানে তিনদিন থাকার পর আমার নিজ এলাকা তিলকপুর ইউনিয়নে চলে আসি। আমরা কেন এ মুক্তিযুদ্ধ করছি সে বিষয়ে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের উদ্বুদ্ধকরণের দায়িত্ব পালন করি। একই সঙ্গে স্থানীয় যুবক ছেলেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করি।
নভেম্বরের শেষ দিকে আমরা চার পাঁচটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ সম্মিলিতভাবে রানীনগর থানা আক্রমণ করি। সেখানে দুইদিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ফেলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। কয়েকজন পাকসেনা গুরুতরভাবে আহত হয়।আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত এবং একজন আহত হন। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৫ জন রাজাকার আমাদের কাছে আত্মসমর্পন করে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণকাজে আমি কেশবপুর গ্রামে অবস্থান নেই। এমন সময় রেডিওর খবরে জানতে পারলাম ভারত বাংলাদেশকে স্বীকুতি দিয়েছে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল বিজয় আমাদের সন্নিকটে। সত্যি সত্যিই সময় আর বেশি দিন লাগেনি। কদিন পরই ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর তিরানব্বই হাজার সৈন্যযৌথবাহিনীর কাছে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে।
অতঃপর বঙ্গবন্ধুর আহবানে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা স্টেডিয়ামে আমরা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ জমা দেই।

*(মুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ চৌধুরী বর্তমানে নিউ ইয়র্ক,যুক্তরাস্ট্রে বসবাস করছেন।)
**প্রবন্ধের শিরোণামে ক্লিক করুন,জহির রায়হান পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের অমর দলিল স্টপ জেনো সাইড চলচ্চিত্রটি দেখতে পাবেন।
***এর পর ভিডিও স্ক্রিনের উপরে ডান দিকে previous বাটনে ক্লিক করুন। স্টপ জেনোসাইডের পার্ট ২ দেখতে পাবেন।
**** see all ক্লিক করুন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেকগুলো চলচ্চিত্র এখানে পাবেন।

রবীন্দ্র সঙ্গীত

রবীন্দ্রনাথের গান

কেন নয়ন আপনি ভেসে যায় জলে।
কেন মন কেন এমন করে।।
যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে-
মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে।।

চারি দিকে সব মধুর নীরব,
কেন আমারি পরান কেঁদে মরে।
কেন মন কেন এমন কেন রে।।
যেন কাহার বচন দিয়েছে বেদন,
যেন কে ফিরে গিয়েছে অনাদরে-
বাজে তারি অযতন প্রাণের 'পরে।

যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে-
মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে।।

(গীতবিতান/২৪৬ সংখ্যক গান)

Friday, January 9, 2009

তুষার গায়েনের কবিতা

তুষার গায়েনের কবিতা

যে রূপ আমি শুনলাম কানে
মালিনী মাসির হাসি, নিলাজ গুঞ্জন তুলে আনে
আনন্দিত শিহরণ এই ভীত মনে- সরোবরে
ছায়া পড়ে আছে তার এ অমোচনীয় আঠার প্রলেপ
বায়ুযোগে ঢেউ ওঠে গোল হয়ে, সরে যায় দূর
গোলাকার তলে-তবু রূপ তার হাসিতে অনড়
বেড়ালের মতো এই অপরাহ্ণ বেলা!

নিবিড় নৈঃশব্দ চারিদিকে, ফুল ফোটাবার যত
আয়োজন গাঢ় প্ররোচনা করে যায় ঝিঝিঁদেঁর
দল, জোনাকিও জোটে এসে-জ্বলে নেভে ঈর্ষাতুর
দূর তারাদের দেখে। যে গেছে চন্দনবনে-

মাসি তার চোখ বেঁধে রাখো কেন?
সুরভি কি ঢেকে রাখা যায় বলো, আঁচলের তলে?
সখির কাঞ্চনরূপ কালির কলঙ্কে বুঝি মোছে!
হয়েছে হযেছে মাসি, তাকেঁ দূর থেকে ভালবাসি
দেখি নাই যাকে কোনদিন, তবু তার রূপের কীর্তন
তাঁর শুনেছি তো কানে!

Monday, January 5, 2009

তিতা মিঞার জঙ্গনামা

তিতা মিঞার জঙ্গনামা
অদিতি ফাল্গুনী


১.
শ্রী শ্রী এলাহি ভরসা

মোরসেদের বাহুর তলেনাচার সাজন বলে
ফজল কর আজি জেল গপ ফুল।
নামনি হালদারের গাতিমেসে-সোমপুর বসতি
জমা রাখি পাশ আউসে সোমপুর।
বড় ভাই-এর নাম মাজমছোট পাতলা মেজো সাজন
ছোট ভাই গিয়েছে মরে।
সাজন বড় গোনাগারসাত বছর মেয়াদ তার
কয়েদ হ’ল দিনের লড়াই করে।

পাশাপাশি দুই গ্রাম। মেসে আর সোমপুর। লোকে মেসে গাঁ-কে মাসিয়া-ও বলে। সোমপুর সাজন গাইনের বাড়ি। সাজন গাজি বা সাজন গাইন, যে নামেই ডাকো না কেন। সোমপুরের উত্তরে উত্তরপাড়া আর রামচন্দ্রপুর, দক্ষিণে ধরো গে তোমার মাসকাটা খাল, পূর্বে মেসে বা মাসিয়া গ্রাম আর
—————————————————————–
… একুন এই আলীপুর জেলের অন্ধকার দরজা-জানালার শিক গুনতে গুনতে তোমরাই কও, হে এই জঙ্গনামার পাঠকেরা, মুই সাজন গাজি আর কী করতি পারি এই ময়লা খাতাটায় জঙ্গের গানগুলো আর চাষার বাদশা তিতা মিঞার কতা সাজোয়ে-গুচোয়ে রাকা ছাড়া?
—————————————————————-
পশ্চিমে হলো গে সেই মাসকাটা খাল আর তোমার ভড়ভড়িয়ার বিল। রাত জেগে লুকিয়ে লুকিয়ে সাজন গাজি আর তার জোয়ান দুই ভাই নীলের বীজ সিদ্ধ করে। সাত সকালেই কোম্পানির লোক এসে বলবে জমিতে নীল বোনা হয় নাই? বাপ পুরুসউল্লাহ ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে যাবে। কেন যে এত ভয় বুড়োর? আরে, তার তিন জোয়ান ছেলে আছে না? মাজম, সাজন আর পাতলা। পাতলার আসল নাম গোলাব। তবে, মানুষটা সে রোগা-পাতলা বলে সবাই তাকে পাতলা বলেই ডাকে। পাতলার মাথাতেই এলো এই বুদ্ধি। ভোর বেলা জমিদার আর কোম্পানীর লোক এসে যেই না কিনা খোঁজ করবে নীলের বীজ পোঁতা হয়েছে কিনা, রাত জেগে সেদ্ধ করা নীলের বীজ তারা তখন টপাটপ বুনবে ভুঁইয়ে। হে..হে..সেদ্ধ বীজে তো আর চারা গজাবে না। বেলা পড়ে এলে, কোম্পানী আর জমিদারের লোক যখন তাদের ডেরায় ফিরে যাবে, তখন মাজম, সাজন আর পাতলা মিলে সেদ্ধ নীল বুজে তুলে আবার ধানের বীজ বুনবে সে জায়গায়। বছর শেষে আমন ধানের কচি ডগা লকলক করবে ক্ষেতে। তবে, সাজন গাজি কি আর আজকাল চাষ করে? সে যোগ দিয়েছে তিতা মিঞার দলে। তিতা মিঞার দলে বিশেষ কদর সাজন গাজির। কারণ, সাজন গাজিদের বংশ আসলে গায়েনের বংশ। গান বান্ধার বংশ। মুখে মুখে গাজির গীত, মনসামঙ্গল, সত্যপীরের পুঁথি কী না তারা গাইতে পারে! মুখে মুখে গান সাজাতে পারে বটে সাজন গাজি। তিতা মিঞার গৌরব সেসকল গানে। লোকে কয় জমিদার আর কোম্পানীর দিন সামনে আর বেশি দিন না! তিতা মিঞাই নদীয়া, কুষ্টিয়া আর সাতক্ষীরার সব জমির বাদশাহ হতে যাচ্ছে। তিতা মিঞা অবশ্য কন অন্য কথা। তিনি বলেন যে জমির মালিক আল্লাহ। সাত আসমানের নিচে যত জমিন, তার ভাগ নাকি সকল মানুষের সমান। হও তুমি মুসলমান কি হিন্দু। হও উঁচু জেতের হিন্দু কি নিচু জেতের হিন্দু। হও তুমি গোরা সৈন্যের মতো ধলা কি কালা কুষ্টি দেশি মানুষটি। জমির হক সবার সমান। এই এক তিতা মিঞার কথায় দলে দলে নিচু জেতের হিন্দু গত কয় বছরে জাত দিয়ে মুসলমান নাম নিচ্ছে। মুসলমানের ধর্ম নিচ্ছে। না নিয়ে যাবেই বা কই? আশপাশের তল্লাটের পাঁচটা বড় জমিদারির পাঁচ জমিদারই উঁচু জেতের হিন্দু। পুঁড়া গাঁয়ের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় এই পাঁচ জমিদারের ধরো গে নেতা। কৃষ্ণবাবুর অন্য চার সারেঙ্গি হলো তারাগোনিয়ার জমিদার রামনারায়ণ নাগ, নাগরপুরের গৌরপ্রসাদ চৌধুরী বাবু, সরফরাজপুরের জমিদার কালিপ্রসন্ন মুখুজ্যে আর গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়। এছাড়াও কুরগাছির জমিদার এক বিধবা মহিলা। তার গোমস্তাই তার হয়ে নড়াচড়া করে। কোলকাতার এক লাটু বাবু গোমস্তা না কি নাম সে-ও যোগ দিয়েছে এই কৃষ্ণদেবের দলে। কৃষ্ণদেবের দলের কাজ একটাই। মুসলমান আর নিচু জেতের হিন্দু ঠ্যাঙানো। অথচ, জমি চাষ করে কারা? এই তোমার শেখ আর কৈবর্তরাই তো করে! শরিফ কি খানদানি ঘরের মুসলমান বা বামুন-কায়েত কিই বা জানে ফসল ফলানোর বিদ্যের? না তারা পারবে নানে বাপু লাঙ্গলের বাঁট শক্ত মুঠোয় ধরতে কি না পারবে গরুর ন্যাজাখানা মুচড়োতে। এ তল্লাটে তিন পুরুষ আগেও প্রায় সবই ছিল হিন্দু। মানে নিচু জেতের হিন্দু। উঁচু জেতের অত্যাচারে তিন পুরুষেই সব ইসলাম কবুল করেছে। কিন্তু, ইসলাম কবুল করলেই কি আর জেত পেয়েছে তারা? চাষা যে সেই চাষাই। না খান্দানি মুসলমান ঘরে ডাকে না বামুন-কায়েত ছায়া ছোঁয়! তারপর এখন জমানায় আবার দ্যাখো গে নতুন কোম্পানীর শাসন! এখন আর দিল্লীর মোগল বাদশা নয় গো, দরিয়া পারের সাদা খেরেস্তান দেশের শাসক। তিতা মিঞা কন…কী জানি কন…কন যে কাফেরের হাতে কি বিদেশীর হাতে দেশ থাকলে সেই দেশ আর মুসলমানের দেশ থাকে না!

‘বাপ-দাদার পুরনো ধর্ম দিয়ি নতুন দ্বিন কবুল করিচো মিঞারা…কিন্তু, দ্বিনের পতে আসলি সেই দ্বিনের নিয়ম ঠিক-ঠাক মানতি হয়। চেলে-মেয়ের নামই একুনো রাকো দিকি সব হিন্দু নাম…আরবি-ফার্সি এক পাতা পড়া শেকো নি কো! জানো শুদু জমি চষতি! তা’ চাষারা জমি চষপা না ক্যানো? কিন্তু, ফসল কি গোলায় নিতি পারো মিঞারা? নেয় তো জমিদার আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী!’

তিতা মিঞার চোখে জল ছলছল করে। তিতা মিঞার চোখে আগুন ধবধব করে। আর, তখন সাজন গাজি আর তার দলের যত যুবক ছেলে…ধরো গে শাহগাজী চাষার ছেলে নূররাপ, সাতখানের ছেলে বাদল কারিগর, কালুর ছেলে কাইম, দিনাতের ছেলে নাকারি, হানিফের ছেলে মূলুক চাঁদ, বালতোরের ছেলে সাফি কারিগর, সাধুর ছেলে বায়োপার, কুশাইয়ের ছেলে রাফি, বরকতউল্লাহর ছেলে মাংলাই…সবার চোখেই জল ছলছল করে। সবার চোখেই আগুন ধবধব করে।

‘আর নিচু জেতের হিন্দুরা যারা আমার দলে আসিচেন, তাদের আমার নমষ্কার। তাদের আমার সালাম। ইসলাম জাতিভেদ মানে না। তবু, আমি জোর করপো নানে যে আপনারা ইসলাম কবুল করুন! যদি অপমান মুখ বুঁজি সইয়েও আপনারা পিতৃপুরুষের বিশ্বাসে থাকতি চান, আমি কই মুবারক! কিন্তু, বামুন-কায়েত কি কুনোদিন আপনাদের ইট্টুও মর্যাদা দিয়িচে? তাও বড় কতা না দাদারা! জমির ফসল আপনারাও পাতিচেন না, মুসলমান চাষা বা রায়তও পাতিচে না! গোরাদের কোম্পানী সরকার কি বলতিচে? ধানী জমিতে নীলির আবাদ করতি বলতিচে। নীলিতে কি চাষার পেটে ভাত হয় কন দিনি? চাষার এক যম, এক আজরাইল হলো গে এই নীলির চাষ। আর এক যম, আর এক আজরাইল হলো গে চিরস্তায়ী বন্দোবস্ত। এই বাংলায়… এই হিন্দুস্তানে… গোরা বৃটিশ আসার আগে মুসলমান বাদশাহর বাদশাহীতে কন আর হিন্দু রাজার রাজত্বে কন জমি কোন রাজা-বাদশা-জমিদার কি আমিরের গর্ভে চিরস্তায়ি ভাবে বন্দোবস্তি হয়নিকো! জমি চাষাগেরই থাকতো। চাষার কি রায়তের হয়ে জমিদার লাখেরাজ দেখাশুনো করতো। বছর শেষে প্রজারা মানে মানে একটি খাজনা দিতো। আবার চাষাগের খাজনা হতি একটি অঙ্ক জমিদার বাদশাহকে পাঠাতো। জমিদার ককুনো রায়তের মাথায় বাদশাহর বাদশাহ, রাজার রাজা হইয়ি চাপি বসতি পারে নিকো। আজ পারতিচে। বৃটিশ এসে উঁচু জেতের হিন্দুদের চিরস্তায়ি বন্দোবস্ত দিতিচে। আজ মুসলমানের দাড়ি রাকলি কর দিতি হয়। মিলাদ পড়তি গিলি কর দিতি হয়। গোরার দেশের কাপড়ের কল চালাতি হাজারকে হাজারকে জোলার, হাজারকে হাজার তন্তুবায়ের তাঁত বিনাশ হলো। কাজির বিচার বদলে বৃটিশের কোর্ট বসিচে। এ তো গেল মুসলমানের ফরিয়াদ। ছোট জেতের হিন্দুদেরও বলতি গিলি কোন সুক নেই। জমিদার সব ফসল কাড়ি নিতিচি। আজ এই নদে (নদীয়া), কুষ্টে (কুষ্টিয়া), সাতক্ষীরা, যশোর, চব্বিশ পরগণা, খুলনে (খুলনা) কি বারাসতের গাঁও কে গাঁও শুদু অভাব। যমুনা হতি ইছামতীর চরে চরে চাষার জমিতে চাষার ফসলে সবার হক আছে। শুদু চাষার কুনো হক নাই। অথচ, জমি কার? বলো তো মিঞারা?’

‘আল্লাহর!’

তিতা মিঞা যেন ধ্যানস্থ। টান টান বসা অবস্থায় চোখ বোঁজা। ডান হাতের তর্জনী তিনি আকাশের দিকে তুলে দেখান, ‘উপরে আল্লাহর…আসমানে আল্লাহর…আর নিচিতে…জমিনে?’

সবাই চুপ।

‘আরে মিঞারা! যার লাঙ্গল, তারই জমি! লাঙ্গল যার জমি তার! এই কতাটাও কতি পারো না? কী শেকাচ্ছি শুদু শুদু রোজ রোজ?’ তিতা মিঞা গলা চড়ান।

সবাই অপ্রতিভ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। সত্যি সত্যি কি তারা… কিছু গরীব শেখ আর কৈবর্ত… না খান্দানি মুসলমান যে পাতোর পর পাতো আরবি-ফার্সি পরে, চোগা-চাপকান পরে, গজল গেয়ে কি কোর্মা-পোলাও খেয়ে দিন কাটায় না তারা ভট্টাচাজ্জি মশায়দের মতো সদা গঙ্গাজলে নেয়ে কি পূজো-আচ্চা করে পূতঃপবিত্র, অং বং চং নানা সংস্কৃত পুঁথি পড়ে, বারবেলা আর অমাবশ্যা তিথি মেনে কি হাজারো সাধন-ভজনে সুখী ও ফিনফিনে দিন কাটে, সম্বৎসর গোলায় ধান ভরা থাকে তাদের… তারা ছোট জেত… জোলা মুসলমান, নমঃশুদ্দুর, হাইলা চাষা, তন্তুবায় কি কৈবর্ত… লাঙ্গল দরলিই কি জমির হক এত সহজে আসপে আনে?

‘তিতা মিঞা, নীলকর-জমিদার-কোম্পানী… এই তিন বাগের সাতে লড়াই করা কি সোজা কতা? চাষারে কোম্পানী কী কয় কন দিনি? না, তোমার সব ধানী জমির সবচেয়ে ভালো জমিতে নীল বুনো। তারপর জমি মাপ-জোকের সময় গজ-ফিতা দিয়ি কোম্পানীর গোমস্তা কি করবি? না, ধানী জমি কমায়ে নীলির জমির মাপ বাড়াবে। তারোপর নীল জমা দিতি কুঠিতে যাবা তো ওজনে ঠকাপেআনে। আবার কয় নতুন আইন করিচে কী যে নীল চাষের দাদন নিলি সে চাষ করতিই হবে। নীল বদলে ধান রুয়িচো কি জেল-হাজত। এই যে বারঘরিয়া আর হুগলির নীলকুঠির মালিক এসটরম (স্টর্ম) সায়েব আর তার ম্যানেজার পিরো (পিঁরো) সায়েব… এরা গোরা মানুষ… তেনাদের হাতে বন্দুক-কামান… সে কয় কোলকাতার ফোর্টুলিয়াম (ফোর্ট উইলিয়াম) তেকে তাদের ম্যাজিস্ট্রেট, সিপাই, ঘোড়া, লোক-লস্কর কত আসপেআনে… আমরা নেংটি পরা চাষাভূষো কি করে তেনাদের সাতে জঙ্গ করি তো সে আমি বাপু বুজে পাইনে!’ খিজার জোলার বাপ বুড়ো শান্তজান জোলা কথা শেষ করে গামছায় কপালের ঘাম মোছে।

‘আপনার কতা আমি বুয়িচি চাচাজান! কিন্তু, জুলুমের আর বন্দুকের ভয় কি পুরুষ মানুষির ধর্ম? কন দিনি!’

পেছন থেকে যুবক ছেলেদের গলার সমবেত আওয়াজ আসে, ‘হ্যাঁ- হ্যাঁ- চাচাজান, তুমি চুপ যাও না কেনে? তুমি কি বাদশা তিতা মিঞার তেকে বেশি বুজো নাকি?’

চুবড়িতে ভরে বাতাসা আর মুড়ি এসেছে। চাষারাই সবাই চাঁদা দেয় এক পয়সা কি দু’পয়সা করে। তিতা মিঞা অনেক লম্বা সময় ধরে কথা কন। তাঁর কথায় চোখে কান্না আসে, আগুন আসে। শরীরের নোমা (রোমকূপ) সব খাড়া হয়ে যায়। এত কথা শুনতি শুনতি খিদেও পায় ম্যালা। তখন এট্টু মুড়ি বাতাসা হলি মন্দ হয় না।

‘আমার তিন কতা মিঞারা। নীলির চাষ করপো না! বন্দোবস্তি (চিরস্থায়ী) মানবো না! লাঙ্গল যার জমি তার! সাহস করি আমার জঙ্গে যে আসতি পারো, আসপা! না আসতি পারলিও আমি কাউরে জোর করবো নানে!’

তিতা মিঞার ডান হাত মোহাম্মদ মাসুম গলা চড়ায়ে হাতের মুঠো পাকায়, ‘বলো মিঞারা! সব্বাই বলো একঠেঁয়… লাঙ্গল যার জমি তার!’

জোয়ান ছেলেরা হুড়মুড় করে মোহাম্মদ মাসুমের দেখাদেখি হাত মুঠো করে। সাজন গাজিও সবার সাথে কেশে গলা ঝাড়ে, ‘লাঙ্গল যার জমি তার!’

২.
‘বাবা সাজন!’

গোলেবকাওলি বিবি সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। গোলেবকাওলি পুঁথির নায়িকার নামেই মা’র নাম এমনটি রেখেছিল নানাজান।

‘তোদের এই তিতা মিঞার নিজির গ্রাম কি বাপ চাঁদপুর গাঁওয়ে?’

‘তুমি তো জানো দিকি!’

‘যা মনে কইরেচিলাম। আমার চাচাতো বোনের নিকে ঐ চাঁদপুর গাঁওয়েই হইচিল। আমার স্যাকুন (তখনো) বাপ শাদি হয়নি তোমার আব্বাজানের সাতে। বছর বারো কি তেরো বয়স হবে আমার স্যাকুন। বুবুর বাসায় একবার বেড়াতি গেইচি। দু’ঘর বাদের বিবি সাহেবা তার এতটুকুনি বচর সাত/আটের এক ছেলেকে কোলে নিয়ি বেড়াতে আসিচে। বলে, ছেলের আমার শুদু ঠাণ্ডা কাশি লাগে। তাই, ওর দাদাজান রোজ নিম পাতা আর শিউলি পাতা থেঁতোয়ে রস খাতি দেয়। ছেলে ঢকঢক তিতা গিলতি পারে। কুনো রা-শব্দ নেইকো। দাদাজান তাই ওর নাম রাখিচে তিতা মিঞা। তা’ শুনে অবদি আমাদের সকলের কী হাসি! মক্তবে তিতা মিঞা নামখানাই ভাল করে মৌলভিরা ডাকে তিতুমির। ভাল নাম আরো কী যেন একটা আচেলো!’

‘মীর নিসার আলি?’

‘হতি পারে বাবা — কতকাল আগের কতা! আমার চাচাতো বুইনেও ওলাওঠা বিবির আছরে মরলো নিঃসন্তান আর দুলাভাই আর একটা শাদি করলো। সেই তেকে ঐ গাঁওয়ে আর কোনো কুটুম্ব-কারবার কি যাওয়া-আসা নেই কো বাপধন!’

গোলেবকাওলি বিবির হাতে তশতরিতে খান কয়েক পিঠা।

‘মাজম আর পাতলা কই?’

‘গেচে ইদিক সিদিক কোতাও। বসো না ক্যানো গো মা?’

‘এই বসি বাবা! ম্যালা কাজ একুনো সারতি বাকি। কিন্তু, একটা কতা বাবা… শুদোবো?’

‘শুদোও না ক্যানো মা?’

‘গরীবের কতা কয় যদি তোমাদের তিতা মিঞা সে ভালো। চাষার জমি চাষা পাবে, লাঙ্গল যার জমি তার… খুবই হক কতা বাবা। কিন্তু, উনি কেমন য্যানো… এই কন পীর ফকিরের মাজারে যাওয়া যাবে না… মানত করা নিষেদ… মেয়েলি গীত, আচার, ব্রত সব বারণ… এত বারণে কেমুন পরান হাঁপায় গো বাপ!’

‘তিনি যে মক্কা থেকে ফিরিচেন মা! মক্কা হতি দেকি আসিচেন যে ইসলাম সেখানে কত কড়া! এই ব্রত, আচার, মাজার, মানত… সব যে হিঁদুদের দেকাদেকি আমরা করি মা!’

‘হতি পারে বাপ। কিন্তু, ওলা বিবির দরগায় মানত করি তোদের তিন/তিনটো ভাইকে যে আমি কলেরা থেকে ফিরোলাম… আহা কত মায়ের ছেলের অসুক করতি পারি, কত মায়ের মেয়ের নিকে দিতি সমস্যা, কত নারীর স্বামী বশে তাকে না… তারা এট্টু দরগায় যাবে নাকো? মানত করবি নাকো? তো বুকি বল পাবে কোত তেকে?’

‘আল্লা বল দেবে মা!’

‘আল্লা দেয় তো বাবা! তবু, মানত কি ব্রত-আচারেরও অনেক গুণ আছে বাপধন। সে তোমরা পুরুষিরা বুজবা না! ভাবো ত’ বেটামানুষ জমি একাই চষে। একাই হাল দেয়। আমরা মেয়েমানুষি যদি ঠিকঠাক ব্রত-আচার না করি, মানত না করি… জমি বেহাল হতি কতক্ষণ? তোমাদের তিতা মিঞাকে… তোমাদের ওস্তাদকে একতা বুজাও… এই দ্যাখো না গত বছর মহররমের সময় তোমাদের ওস্তাদের কথায় তারাগুণিয়া গ্রামের ষোল ঘর মুসলমান দরগায় যে মানত করছিল, সেখানে ঐ যে রজ্জত মল্লিক… দু’বছর আগেও চেলো হিঁদু… জাতে তাঁতী আর নাম চেলো পূজত মল্লিক… তিতা মিঞার কাচেই সে ইসলাম কবুল করিচে… সে যে ঐ মানতের ডালায় লাথি কষালো…সে কি ঠিক করিচে? শরাওলাদের১ এ জন্যিই সবাই ভয় করে আর এজন্যিই সব মুসলমান কিন্তু তোমাদের দলে নেই! ’
সাজন এবার হাসে, ‘তিতা মিঞা এট্টু কড়া বটে মা! উঁচু জেতের হিন্দু, জমিদার আর যত ইংরেজি পড়া ভদ্দরনোক বাঙালী বাবু কি গোরা চামড়া সাহেবরা কেউ তাকে দেকতি পারে না। খান্দানি মুসলমান যে কয় ঘর তারাও গোপনে ঐ জমিদার কৃষ্ণদেব বাবুর সাতে আঁতাত করিচে। গরীব মুসলমান চাষার দাড়িতে আড়াই টাকা কর বসলো কি মিলাদ করতি গেলেও কর দিতি অলো, ধানী জমি নীলির চাষে লাগাও… এসব জুলুম খান্দানি মুসলমান কি বামুন-কায়েত কেউ বোজে না গো মা! কিন্তু, বাঁচতি তো হবে আমাগেরও। বাঁচার রাস্তা আর নাইকো মা এই তিতা মিঞার জঙ্গে যদি শামিল না হই!’

‘কিন্তু, থানা পুলিশ যদি তোমাগের ধরতি আসে তো কী হবেআনে?’

‘গোপনে গোপনে থানা পুলিশ পেচু তো নিয়েইচে মা! কিচু করার নেই কো। বছর শেষে দুটো ভাত দুটো কাপড় তো লাগে বাঁচতি? তাই মোরা তিতা মিঞার দল করি!’

৩.
চাষার বাদশাহ তিতা মিঞা বলেন গোরা সৈন্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, নীলকর আর জমিদার বাবুদের সাথে লড়ার জন্য অনেক দম-শম দরকার। নিত্যি লাঠি খেলা, কুস্তি করে গতর শক্ত করাই শুধু নয়কো। পাঁচ বেলা নামাজ পড়ো। অজু করো। হিন্দুদের মতো ঢং করি কোঁচা দিয়ি ধুতি পরার চেয়ে ধুতিখানা দুই পা পুরো ঢেকে পরা ভালো। মন তখন এক আল্লাহর আসমানের নিচের সব জমিতে চাষার হকের জঙ্গে খাড়া হবে। মন তখন দশ ঝকমারিতে ছুটবে না। সাজন গাজিও তাই মরবি তো মর, পড়বি তো পড় পানরার জোলা পাড়ার মসজিদেই আজ দিন কয়েক হয় দু’ভাই পাতলা আর মাজমকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়তে ছুটছে। সাজনদের নিজেদের গাঁ অবশ্য সোমপুর। সোমপুরের কোল ঘেঁষাঘেঁষি গাঁ মাসিয়া, উত্তরের উত্তরপাড়া আর রামচন্দ্রপুর… কোথাও কোনো মসজিদ নেই। মসজিদ হলো আর সাক্ষাৎ কৃষ্ণদেব রায়ের পান্রা কি পুঁড়া গাঁয়ের পাশে। পুঁড়ার পাশেই সরফরাজপুর জোলা পাড়া। জোলা পাড়ায় থিকথিকে পঞ্চাশ থেকে একশত ঘর মুসলমান বসতি। একশ বছর আগে এখানে নাকি বর্গী… সেই কোন মারাঠা দেশের সৈন্যরা এসে এখানকার একটা মসজিদ ভেঙে দিয়েছিল। তিতা মিঞার যে জেদ! মক্কা আর রায়বেরিলী হয়ে এসে আর কোথাও না… ঠিক এই সরফরাজপুরেই একটা শনের মসজিদ বানিয়েছেন। শুরুতে শিষ্যরাই অনেকে নিষেধ করেছে। তিতা মিঞা কি আর কারো কথা শোনেন?

‘জোরে আজান দিবে মিঞারা! কৃষ্ণদেব রায়কে কীসের ভয়? জমিদার বলি কি সে তোমার দ্বিন, তোমার আখেরাতও কিনি নিয়েচে?’

কিন্তু, এই কৃষ্ণদেব রায়ের ছেলেগুলো ভারি বজ্জাত। জোলারা আজান দেওয়া শুরু করলেই পাশের জমিদার বাড়ি হতে জোর গলায় ভেঙচি, আজানের নকল করে কেমন কেমন শব্দ করা শুরু করে। জোলারা কোনোদিক না তাকিয়ে নামাজ পড়ে চলে। এর ভেতরে অবশ্য একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। গত সোমবার নামাজের সময় বাবু কৃষ্ণদেব রায়ের ছোট ছেলে… পনেরো ষোলর বেশি বয়স না… মসজিদের একদম সামনে এসে আরো দু/তিনটা ছেলের সাথে মিলে ভেঙচি কাটছিল। ঐ দিন আবার দাইম জোলার বাবু কালু জোলার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। কালু জোলা খুব মন দিয়ে সেজদায় ছিলেন। এক পর্যায়ে অসহ্য হয়ে মসজিদের বার হয়ে শুধোলেন, ‘এই খোকা… তুমি শুদু শুদু আমাদের ভেঙচি কাটচো ক্যানো?’

খোকা এ কথার উত্তরে আবার ভেঙচি কাটে।

‘তুমি থামো কলাম! বেয়াদব কুনোখানের!’

খোকা আর তার তিন বন্ধু আরো জোরে ভেঙচি কাটে।

কালু জোলা এমনিতেই রগচটা লোক। এককালে ইছামতীর চরে ডাকাতি করতো। ছোটবেলায় তার বড় বোনকে নাকি ধরে নিয়ে গিয়েছিল দু’জন গোরা সৈন্য। সেই বোনের আর সমাজে ফেরা হয়নি। লোকে কয় এ ঘটনার পর কালু জোলা ডাকাত দলে যোগ দেয়। বনগাঁর পাশে ইছামতীর চর হতে চব্বিশ পরগণার ধার ঘেঁষে সুন্দরবন অবধি তার সাথে ডাকাতি কি ঠগীগিরি করে কেউ পারেনি। কয়েকবার জেলও খেটেছে সে। বৃটিশের ভয়ানক উঁচু লাল লাল ইঁটের আসমান সমান ফাটকের পাঁচিল সে কায়দা করে টপকে পালিয়ে এসেছে আবার জঙ্গলে। তিতা মিঞার সাথে পরিচয় হবার পর সে বদলে অন্য মানুষ। ডাকাত দল ছেড়ে দিয়েছে। এখন আবার সে তাঁতে বসে টুকটাক। হেসে বলে, ‘এই হাতে আর সূতা বুনতি পারি নাকো! মানুষ কাটতি কাটতি আঙ্গুল শক্ত অই গেচে!’ কালু জোলা এখন নিয়ম করে পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। দাড়ি রেখেছে লম্বা। কপালে মোনাজাত কিম্বা ঈশ্বরের কাছে অনুশোচনার গভীর ক্ষতস্থান। ডাকাত দলে থাকার সময় সে নাকি খোদ আল্লাহকেও ভয় করতো না। তিতা মিঞার শিষ্য হবার পর থেকে এখন শুধু আল্লাহকেই যা ভয় পায়। কী জমিদার কী গোরা নীলকর আর কাউকেই সে বিশেষ গণে না।

‘তুমারে থামতে কয়েচি। কতা কি কানে গেচে তোমার?’

‘থামতি অলি তুই থাম! শালা নেড়ের বাচ্চা কোথাকার!’

‘কী কলি? শালা জমিদারের বাচ্চা জমিদার!’ বিস্মিত জোলাদের চোখের সামনে গোঁয়াড়-গোবিন্দ কালু জোলা বা অতীতের কালু ডাকাত সপাট চড় বসায় জমিদার তনয়ের গালে, ‘সাহস বেশি অয়িচে? বৃটিশের দালাল! দালালি করি চাষার জমি বন্দোবস্তি কারবারে নিয়ি মানুষকে গেরাহ্যি করো না?’

সত্যি বলতে কালু জোলার সাহস দেখে ভয়ে সাজনের প্রায় পেচ্ছাপই পেয়ে গেছিল। কিন্তু, ফলাফল খুব ভাল হলো না। রাত কাবার না হতেই জমিদারের গোমস্তা এসে কালু জোলা, সরফরাজপুরের জোলা পল্লীর সর্দারকে খুঁজে না পেয়ে তার নরম-সরম মেজ ভাইকে ডেকে নিয়ে জমিদারের কুঠিতে নিয়ে যায়। কালু জোলা আবার হুগলি শহরে গেছিল সুতার বন্দোবস্তি কাজে। তারপরের ঘটনা কী দুঃখের! কী লজ্জার! নাপিত জীবনচাঁদ শীলকে দিয়ে কালু জোলার মেজ ভাই গুলখান জোলার দাড়ি প্রথমে পেচ্ছাপে ভিজিয়ে তারপর নাকি কেটে দিয়েছে। জোলারা সেই মঙ্গলবার দুপুরেই গেলো বারাসাত কোর্টে। কে শোনে কার কথা? কোর্টের লোক উল্টো জোলাদের দিল ভাগিয়ে। সেই থেকে পরিস্থিতি থমথমে। গত বুধ আর বৃহস্পতি… দু’দিন আর নামাজ পড়া হয়নি এ মসজিদে। জোলারা ভয়ে ছিল। কালু জোলা আজ বিকেলে হুগলি থেকে ফিরেছে। ফিরেছে এক গা জ্বর নিয়ে। কিন্তু, গত দু’দিন মসজিদে নামাজ পড়া হয়নি শুনে নাকি বকাবকি করেছে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সেই নিজ গাঁয়ের পাড়ার জোয়ানদের দিয়ে আশপাশের যত গাঁয়ের তিতা মিঞার দলের ছেলেদের বলে পাঠিয়েছে যে আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়া অবশ্যই হবে।

‘ভালো কতা। বড় মিঞারা না ডেকে স্যান পাঠালো, কিন্তু, না আছে তিতা মিঞা বাদশাহ। না তার সিপাহসালার মোহাম্মদ মাসুম। না আছে কালু সর্দার। তিনি জ্বরে বিছানা নিইচেন। একুন কী করি মোরা?’ দায়েম ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে সাজনের কানে।

‘তিতা মিঞা বাদশাহ আর মাসুম সাব কলিকাতা শহরে গেচেন,’ বায়োপার ফিসফাস করে। ‘ম্যালা কিতাব কিনতি গিয়িচেন তারা। কুরান-হাদিস-ফিকাহ শাস্তরের কত বই। শরিয়ত শিক্ষার বই। নামাজ স্যান আমাগের নিজিদিরই পড়তি হবেআনে।’

‘আল্লাহ হু আকবর — আল্লাহ হু আকবর — আশাদুল্লাহ — ’ নাকারির আব্বা দিনাত মোয়াজ্জিনের ভূমিকা পালন করতে গলা খাঁকারি দিয়ে কানের দু’পাশে হাত নেয়।

‘থাম শালা নেড়ের বাচ্চারা য্যানো শেয়াল গাইচে!’ ধুপধাপ ঢিল পড়তে থাকে।

কাতার ফেলে সব প্রার্থী শনের মসজিদের ভেতর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। প্রায় তিনশ মশালের লাল আলো জিভ বের করে হাসছে। জমিদার তার পাইক-বরকন্দাজ সবই পাঠিয়েছে। সবার সামনে ষোল বছরের সেদিনকার চড় খাওয়া কিশোর পুত্র।

‘জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দে সব ছোট জেত — জেত দিয়ে মোচনমান হয়িচে — ভেবেচে পিতৃপুরুষির ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে নোতুন জেত পাবে — জেতে উঠবে — যত শ্যাক আর নেড়ে কোথাকার!’ শুভ্র ধূতি আর উত্তরীয় পরনে, কপালে রক্তচন্দন তিলক অপরূপ সুদর্শন কিশোর জমিদারতনয় উদ্দীপ্ত বোধ করতে থাকে যেন সে কোন্ রাজপুতানার বীর সেনাপতি!

দিনাত জোলা জমিদার তনয়ের সামনে দাঁড়ায়, ‘ছোট বাবু! সেদিন কালু জোলা যদি কিচু ভুল করেও তাকে, আমরা মাপ চাইচি। জানেন তো ও আগে ডাকাত দলে চেলো! গরীবের একমাত্র ধর্মস্থান পুড়িয়ে দিয়েন না গো হুজুর মিনতি করি!’

‘চুপ নেড়ে কোতাকার! সেদিন মনে চেলো না? হীরাউল্লা, বেহার গাজী, জান মহম্মদ?’

হীরাউল্লা, বেহার গাজী, জান মহম্মদ… জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর সেরা তিন লাঠিয়াল… তিনজনই ধর্মে মুসলিম তবে লাঠিয়াল বৃত্তির জন্য পুঁড়া আর শরফনগরে প্রায় চার পুরুষ ধরে বিঘা বিশেক করে নিষ্কর জমি ভোগ করে আসছে জমিদার রায় বংশের কাছ হতে… দ্বীনের চেয়েও রোজকার অন্নদাতা প্রভু তাদের কাছে বড় বিবেচনা। তিন লাঠিয়ালের হাতে মশালের গনগনে রক্ত উন্মাদনা!

‘এ নেড়েদের মুখে শুকরের মাংস গুঁজে দাও। যবনরা বুজুক কার সাতে লাগতে আসিচে!’

আগুন আর কর্তিত শুকরের মাংস ও রক্তে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে মসজিদ।

৪.
‘নামাজের জামাতে সেদিন তোমরা ক’জন মরদ কাতারে দাঁড়িয়েচিলে?’ তিতা মিঞার মুখ রুষ্ট।

‘তা’ তিতা মিঞা সব মিলিয়ে জনা সত্তর আশি।’

‘ওরা কতজন ছিল?’

‘সব মিলিয়ে তিনশোর মত!’

‘তবু, আশি জনা মিলি একটু চেষ্টা তো করতি পারতা?’

‘ওদের হাতে মশাল চেলো তিতামিঞা! ইয়া বড় বড় সব রামদা, কুঠার, কৃপাণ হাতে! লাঠি আর বন্দুকও ছিল খান দুয়েক। আর আমরা কিনা ওজু টোজু সেরে হপায় নামাজের কাতারে দাঁড়িয়েচি… লড়াইয়ের প্রস্তুতি কী মন কিছুই চেলো না!’

তিতা মিঞা বড় করে শ্বাস ছাড়েন। তাঁর কপালে ভ্রু-র গভীর কুঞ্চন আর চোখের নিচে অবসাদের কালি।

‘দারুল হরব! দারুল হরব! জমিদারের বড় তিন লাঠিয়ালই কিন্তু ধর্মে মুসলমান। সেই তারাই দুটো ভাতের জন্যি মসজিদির এ হেনস্থা করিচে! অবস্থা অলা সব মুসলমানই হিঁদুদের দলে। আবার জমিদার কি হিঁদুদেরই খুব ভালো চায়? নয় আমাগের এই দেবকি পাঠক… দেবকি আচো নাকি ভায়া… সে কোন ছোট জেতের হিন্দুও না… বামুনের ছেলের দেবোত্তর জমি নীল চাষের জন্যি কোম্পানীর এস্টর্ম সায়েবের হাতে তুলি দিতিচে না কৃষ্ণদেব রায়? আবার তারই মুসলমান লাঠিয়ালরা মসজিদি আগুন দিলো আর শুওরের মাংস ছিটোলো… শোন মিঞারা… একুন আষাঢ়ের শ্যাষ। শ্রাবণ মাস পার হতি দাও। ভাদ্দরও পার হোক। আশ্বিন যকুন যাই যাই করবি, স্যাকুন খোদ পুঁড়ায় বাবু কৃষ্ণদেব রায়ের মন্দিরে আমরা হামলা চালাতি যাব। এই তিনটে মাস সামনে শুদু প্রস্তুতি। জোয়ান চেলে-পিলেরা এ তিন মাস জোর লাটি খেলা, কুস্তি করা… আগে গতরখানা শক্ত-পোক্ত করো। মসজিদে আগুন আর শুওরের রক্ত-মাংস ফেললি আমরাও ওদের মন্দিরে গোরক্ত আর গোমাংস ফেলবো! এ খুব ভিতরের কতা। কতা পেটে রাকতি হবে। নিজির ঘরের বিবিকেও একতা কওয়া যাবে না। মেয়েমানুষ কতা এ কান ও কান হতি হতি দেখা যাবে হিঁদু পাড়ার বউ-বেটিরাও জানি গেইচে আর শেষে জমিদারের পাইক-পেয়াদা কোর্টে কেস দিয়ে সব দিবি সদরে চালান!’

‘বাদশা তিতা মিঞা!’ মাদার কারিগর হাত তোলে।

‘কত কই মিঞারা আমাকে বাদশা ডাকপা না? আল্লাহর দুনিয়ায় কেউই বাদশা নয়কো। ইসলামের পেরতেম যুগে…ছহি ইসলামের যুগে চেলেন আল্লাহর পেয়ারে বান্দা রাসুল ও তাঁর চার খলিফা। খিলাফৎ আর বাদশাহি এক বস্তু নয়। যেদিন তেকে মুসলমানের ভেতর হতি কেউ কেউ বাদশা হলো তো সেদিন তেকেই ইসলামের নাওখানা ডোবা শুরু হলো!’

‘তবু আপনাকে বাদশা ডাকতি সাদ হয় তিতা মিঞা!’

‘ঠিক আচে, মাদার কারিগর! কও তুমি কী কতি চাচ্চিলে?’

‘আমাদের গাঁও মানে সরফরাজপুরের গণ্ডগোল যে শেষ হতিই চায় না। গেল হপ্তাবারে জমিদারের লোকজন দায়েম আর কায়েমকে ডাকি নিইয়ে দাড়ির জন্যি আড়াই টাকা কর চাইলে। ও দু ভায়ের কাচে চেলোই এক টাকা। তাই দিলে। তবু, পার পেলে না! জমিদারের পাইক কইলে কি দেড় টাকা কর বাকি তাকলে তোদের। এম্নিধারা চললি পর গতি কী হয় মোদের?’

তিতা মিঞা সামান্য তিতাই হাসিলেন।

‘ক’টা দিন সবুর সহো জোয়ানেরা! তিনটে মাস গতরখানা পোক্ত করো! জঙ্গে আমরা যাবো ইনশাল্লাহ! অবশ্য তার আগে একবার বৃটিশের আদালতে যাব মোরা। মামলা করবো। জানি উপায় হবে না। উপায় যখন হবে না, তখন জঙ্গের রাস্তাই ধরতি হবে!’

*

নারকেলবাড়িয়ার বৈঠক শেষে এখন যে যার গাঁয়ে ফেরার পালা। আকাশে শুক্লপক্ষ কোজাগরি পূর্ণিমা। বাড়ি ফেরার পথে সাজন গাজির বুকটা কেমন হু হু করে। কেমন এক উত্তেজনার ভেতর সে জড়িয়ে পড়েছে। জড়িয়ে পড়েছে তার মতোই আশপাশের নানা গাঁয়ের জোয়ান ছেলেরা। এই যে দিনের একটা সময় তারা লাঠি খেলছে কী কুস্তি লড়ছে, দিনমান পাঁচ ওয়াক্ত অজু-নামাজ করছে… কিন্তু, সত্যি সত্যি কি জঙ্গে নামবে তারা? নামলে কবে নামবে? কার সাথে জঙ্গ? হ্যাঁ, জমিদার, নীলকর আর গোরা সৈন্য তাদের শত্রু। কিন্তু, মুসলমানও সবাই তাদের দলে নেই। একটু ভাল যাদের অবস্থা তাদের মনেই জমিদারের প্রতি ভয়-ভক্তি বেশি। তারা আবার সাজন গাজিদের নিয়ে ঠাট্টা করে। বলে কি লাঠি দিয়ে বন্দুকের সাথে লড়া যায় না। বাড়ির ভেতর খোদ মা মানত-ব্রত বন্ধ হবার ভয়ে ভয় পায়। মাকে তবু জোর করে হিঁদু বেটিদের মতো শাখা-সিঁদুর ছাড়িয়ে বুরকা পরানোর অভ্যাস চলছে। মা খুব তকরার করে। এয়োতি স্ত্রীলোক শরীরে এয়োতি চিহ্ন না রাখলে সাজনদের বাপেরই ক্ষেতি। সে কি তবে বেধবা হবে? সাজনরা বুঝায় যে এসবই মায়ের কুফরি বিশ্বাস। বাপ পুরুসউল্লাহকে যতই ধুতির কোঁচা ছাড়িয়ে দু’পা ঢেকে ধুতি পরতে বলা হোক, সে বুড়োও তকরার করবে।

‘তিন বেটা মিলে নবাবি করচিস। চাষ-বাস একদিন করিস কী একদিন ঢুঁ ঢুঁ। কী সব লাঠিখেলা আর কুস্তি! তাও যদি জমিদারের কাচারিতে একটা চাকুরি জুটতো তোদের! নীলির জমি বাদ দিয়ি এক বিঘা জমি ভাগে বর্গাদার সামলে ক্ষেতি করা আর ভিটের কাচের সব্জি ক্ষেতের লাউটা-কুমড়োটা হাটে বেচে তোদের সবার মুখে একমুঠো ভাত দিই। এদেশে হিঁদুরা সংখ্যাতে ভারি। হিঁদু জমিদার। হাটে-বাজারে দাড়ি মুয়ে আর কোঁচা খুলে পাখানা ঢেইকে ধুতি পইরে গেলেই তিতা মিঞার লোক ভেবে আমার সওদা-পাতি কেউ কেনপে নানে! তোমরা শখ করি জঙ্গ করো বাবারা! মোর সংসার মুই সামলে নিই আগে! আর সত্যি যেদিন জঙ্গ হবে, জঙ্গে তোমরা জিতলি পর মুই তোমাদের দলে আচি! না জিতলি নাই!’ বুড়ো এরপর এমন বিকট হাসি দেয় যে ঘেন্নায় পিত্তি জ্বলে সাজনের। হোক না জন্মদাতা বাপ। দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষই ভিতুর ডিম কোথাকার! নতুন কিছুর জন্য লড়তে ভারি ভয় তাদের! নদীর উজান যেপানে, তারাও সেইপানে! কুনো মানে হয় এসবের?

‘তুমি সাজন গাজি তো? তিতা মিঞার বাদশাহি দলের গায়েন মহারাজা?’

বাবড়ি চুলের আর কাঁচা-পাকা দাড়ির জোব্বা পরা এই লোকটাকে ইদানিং নারকেলবাড়িয়ার বৈঠকে ক’দিন ধরে সাজন দেখেছে মনে হয় তবে সেইভাবে লক্ষ্য করে নি। লোকটা কি এ অঞ্চলেরই? ওবাব্বা… কতা-বার্তার ঢং-ঢক তো বেশ!

‘আজ্ঞে…থুক্কু! জ্বি, হ্যাঁ…’

‘গান তো ভালোই বান্দো ছোকরা!’

‘আপনি কি ইদিককার মুনিষ্যি?’

‘তোমরা নদের লোক… আমি ধরো গে কুষ্টের… কুষ্টে আর নদে তো একই জেলা… আমি গড়াই নদের পারে হোতা তাকি!’

‘তো ইদিকি যি? কী মনে করি?’

‘তিতা মিঞার নাম-ডাক তো একুন সর্বত্র। তাই দেকতি আলাম স্বচক্ষে!’

সাজন একটু ভাল করে তাকিয়ে দ্যাখে। লোকটার ঢিলা-ঢালা বহুদিনের জোব্বার বাম কাঁধে ঝোলানো ঝোলা হতে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে একখানা একতারা।

‘আপনিও গান-বাজনা করেন নাকি?’

‘গুরু আর দিলে কই তেমুন ক্ষ্যামতা? হতি পারতাম লালন সাঁইয়ের মতো রত্ন একখান!’

‘লালন সাঁই কেগো?’

‘তোমাদের ইদিকে তাঁর নাম একুনো তেমন একটা আসে নি বোদায়। কুষ্টে তে তার পালা লোকে পতঙ্গের মতো শোনে!’

‘নামখানা জানতি পারি আপনার?’

‘কেন নয়? মোর নাম বাবা চেরাগ শাহ!’

‘বুয়িচি। আপনি আউল-বাউল কী কর্তাভজা কেউ হবেন। এই জঙ্গের দলে ক্যানো আসিচেন?’

‘এই বাবা শুনলাম তিতা মিঞা গরীব চাষাগের বাঁচাতি দল গড়িচেন। নীলকর, জমিদার কী কোম্পানীর সাথে জঙ্গের জন্য আওয়াজ দিতিচেন। তাই তে দেকতি আলাম! তাও প্রায় মাসখানেক হইয়ে আসিচে!’

‘হতি পারে। মাঝখানে আষাঢ় মাসে ঘর-গেরস্থালির কিচু কাজে আটকা পড়িচিলাম। সব জমায়েতে আসা হয়নি।’

‘তোমার গাঁয়ের আর কেউ আসে নি কো আজ?’

‘মোর নিজির ঘরেই ভাই আচে দু’জনা। কিন্তু, ঐ বাড়িতে কামে আটকা পড়িচে। গ্রামে তিতা মিঞার দলের শিষ্য আমরা তিন ভাই বাদে আচে আরো ছয় জনা। চারজনা মুসলমান আর দুইজনা হিন্দু। হিন্দু দু’জন গেল দুই বৈঠকে আসে নিকো। মুসলমান চারজনার আরো তিনজনা আমার সাতেই আসিচে। তিনজনারই আবার এগাঁয়ে কুটুম্ব ঘর আচে। তাই আজ রাতে একেনেই কাবার করবে।’

‘তাই ভাবি যে এ বাপধন দেকি একা একা হাঁটা ধরিচে! ইদিকি আসার পর হতি এক মাস মুয়ে কুলুপ আঁটি শুদু বৈঠক দেকচি, সবেতার কতা শুনচি। আজ মনে হলো কি একটু হাঁটা-চলা করি কী সবার সাতে কতা-বার্তা কই!’

‘থাকা হচ্ছে কুতায়?’

‘তিতা মিঞার ডানহাত যে লোকটা…’

‘মোহাম্মদ মাসুম?’

‘হাঁ… মোহাম্মদ মাসুমের ঘরেই!’

‘ওনাকে বইলে নিয়ে বের হয়িচেন তো?’

‘কী বলাবলি বাপ! মেয়েমানুষ তো নই! তাছাড়া আমার ঘর-সংসার নেই। দু’দিনের অতিথি। দেকতে আসিচি বৈ নয়। সে তারা জানেন। কাজেই, কোনো আটক-নিয়ম তো কিচু নাই।’

‘কেমন বোদাচ্চে?’

‘বসপা নাকি এট্টু বাবা? এট্টু জিরিয়ে নিই! সেই সাথে একটু তাংকু সেবন!’

‘বসতি পারি। তবে, তাংকু সেবনে তিতা মিঞার মানা আচে!’

*

চেরাগ শাহ একথার জবাবে সামান্য হেসে একটা মস্ত পিপুল গাছের নিচে বসে পড়ে। গাছের ডালে ডালে ঝুলছে মাটির ঘোড়া, পুতুল কি এয়োস্ত্রীদের দেওয়া অনেক তাবিজ-কবজ। ক’দিন আগে হিন্দুদের ইতুর ব্রত গেছে।

‘কলেন না তো?’

‘কী কলাম নাকো?’

‘এই আমাদের জঙ্গের প্রস্ততি কেমন লাগচে?’

‘মাত্র মাসখানেক দেখিচি। এ কতায় কী কতা কব?’

‘তবু একটা ভাব হয় না মাসখানেক দেকার পর?’

‘এ ন্যায়ের সাতে অন্যায়ের যুদ্দো। তয় বৃটিশের হাতে এত ক্ষ্যামতা যে শেষপর্যন্ত কে যে জিতবি তা ক্যামনে কই!’

‘আচ্চা, একটা কতা শুদোই। আপনি যে আউলে লোক তো বাদশা তিতা আপনাকে জায়গাই বা দেলেন কেন? মারফতি লোক তার দু’চোকের বিষ!’

‘আল্লাহর আসমানের নিচি সব চাষাকে যে সমান জমি দিতি চায়… তার চেয়ে বড় মারফতি আর কে আচে? ফকির কি আউল-বাউল মুয়ে কন পচন্দ করেন না, আবার তো এক মিস্কিন শাহ আচেও তার দলে। মিস্কিন শাহ নাকি কামানের গোলা মুখ দিয়ে গিলতি পারে। বৃটিশের কামানের পাল্লা দিতি তাকে এনেচেন। পুরা শরিয়তি মানতি গেলি তো ফকির মানা যায় না! সাধক-সাধনা কি ফকিরের কেরামতি মানা যায় না! আমাকে আউল-বাউল জেনেও তো জায়গা দেলেন। আমার মনে হলো কী উনি য্যানো এট্টু ধন্দে আচেন। কুন পতে যাবেন? একদিকে ওনার গুরু শাহ্ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী। সেই গুরু কড়া শরিয়তির পতে হাঁটে। তার কতা মানতি গেলে দুনিয়ায় মুসলমান বাদে সবাই কাফের। সবাই শত্রু। এমন কি মুসলমানের ভেতরেও সবাই খাঁটি মুসলমান নন। তিতা মিঞা গুরুবাক্যও ফেলতি পারেন না। কিন্তু, অন্তরে তার ভিন্ন জেত বলেই যে সমান মার খাওয়া বা সমান মজলুম… তার প্রতি কোনো ঘেন্না নেই!’

‘সে ত তিনি ছোট জেতের হিন্দুদের দলে থাকতি কয়েচেন। তাদের তো বারোতি কননি!’

‘তা না হয় কননি। কিন্তু, তোমাদের দলের যে নিয়ম-কানুন… পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ-রোজা, দাড়ি রাকো রে, মানত-আচার সব বন্দো করো রে… হিন্দু দূরের কতা, সব মুসলমানই কি তার কতা মানতিচে?’

‘অনেকেই মানতিচে। তয় সবাই মানতিচে না যে সে সত্য!’

চেরাগ শাহ হাসে, ‘তা এই তো বাবা… দেকতি এয়েচিলাম তিতা মিঞার জঙ্গের প্র¯ত্ততি! নয়ন জুড়োয়ে দেকলাম। হ্যাঁ, গোরা বৃটিশও তিতা মিঞাকে নিয়ি ভয় পাতিচে, সেটা কিন্তু বড় কতা।’

‘নয়? তিতা মিঞাই আমাদের বাদশাহ!’

‘আচ্চা, তুমি র্ঠিক করি বুকি হাত দিইয়ে কও তো ছোঁড়া… এই জঙ্গে তুমি কেন?’

‘যাতে নীল বুনতি না হয়, য্যানো ভুঁইয়ে ধান বুনতি পারি… য্যানো জমিদারের পেয়াদারা দু’বেলা খাজনার জন্য হামলা না করে, য্যানো আমার দ্বিন আমি পালন করতি পারি! এই যে দেবকি পাঠক তো বামুনের ছেলে হয়েও আমাদের দলে গোপনে আচে। আজো বৈঠকে চেলো। সে মাসিয়া গ্রামের ছেলে। ওদের দেবোত্তর জমিতেও নীল চাষের হুকুমি দিয়িচে কোম্পানী। সে কৃষ্ণদেবের দুয়ারে ধন্না দিয়েও নীলের দাদন হতি জমি ছাড়াতি পারে নিকো! জানেন, আজ কোজাগরি পূর্ণিমা না? দেবকিদের দেবোত্তর জমিতি আগে খোলা মাঠে লক্ষী পূজো হতো। ছোটবেলায় অনেক গিইচি। মাসীমা পূজা শেষ হলি পর প্রসাদ দেতেন। একুন সে জমিও নীলকরের গর্ভে গেইচে। দেবকি আমার চেয়েও তিতা মিঞার বেশি শিষ্য! দেবকি কয় কি কৃষ্ণদেবের হিঁদুয়ানি সব লোক দেকানো। নয় অসহায় বামুনের অল্প-স্বল্প দেবোত্তর সে নীলকর এসটরম সায়েবরে কয়ি বুজি চাড়াতি পারতো না? ’

‘দারুণ। দেকলাম সবই। কুষ্টে গিয়ে তোমাগের জঙ্গের কতা সবারি জানাবো!’

‘ও আপনি তাহলে ম্যালা দিন থাকপেন নাকো?

‘নাগো… আমি ফের আমার দেশ কুষ্টে চলে যাবো। আমাদের নতুন গুরু লালন সাঁইয়ের আখড়ায়! আমি য্যানো কুনো জঙ্গেরই লোক নই আসলে!’

‘লালন লালন করতিচেন বহুক্ষণ। তাঁর গান কীরম? শুনতি পাই?’

চেরাগ শাহ আবার হাসে। প্রথমে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বই পড়ার মতো করে পড়ে,

‘…একটা নারকোলের মালা,
তাতে জল তোলা ফেলা…
করঙ্গ সে –
চৈতে-নিতাই-অদ্বে পাগল হাল ধরেছে,
তোরা কেউ যাসনে সে পাগলের কাছে!’

ধীরে ধীরে ধ্যানস্থ পাঠ হতে হঠাৎই সুরের ঝাঁকি খায় সে আবৃত্তি!

‘তিন পাগলের হলো মেলা নদেয় এসে…
তোরা কেউ যাসনে সে পাগলের কাছে!’

গান শেষ হলে অভিভূতের মতো বসে থাকে সাজন গাজি। তার এই একুশ বছরের জীবনে শৈশবে সে গাজির গীত, নাতে রসুল, মনসা পাঁচালি, কালিকা পুরাণ, পদাবলী কীর্তন, দোভাষী পুঁথিপাঠ… নানা কিছু শুনেছে ও শিখেছে। যেদিন থেকে নিজে পালা গান বাঁধা শুরু করলো, তখন শুরুতে কিছু আল্লা-রসুল বন্দনা, মহেশ্বর-পাবর্তী বন্দনা, ইউসুফ-জোলেখা, রাধা-কেষ্ট পালা রচনা… এসবই করতো। ইদানিং নামাজ-রোজার মাহাত্ম্য, জমিদারের পেয়াদাদের উৎপাত এসব বিষয়েই গান লেখে বেশি। কিন্তু, আজ যে গান শুনলো, তা’ একদমই অন্যরকম।

‘যাই হে! অনেক রাত করিয়ে দেলেম তোমায়!’

‘আপনি মুনিষ্যিটা ম্যালা রহস্য। আসবেন আবার বাবা। আপনার লালন সাঁইয়ের গান ভালো তয় এ গানে জঙ্গ হয় না, অপমানের বদলা নেওয়া যায় না! নমষ্কার… থুক্কু, খোদা হাফেজ!’

চেরাগ শাহর দু’পাশের ঠোঁট আবার হাসির ঢঙে মোচর খায়, ‘আসি গো!’

৫.


‘‘গোলাম মাসুম বলে ভেবে মোক…
পঁচিশ জন লোক সাথে পৌছাল তখন
ফজরেতে কেষ্টদেব পেয়াজদা পাঠাইল
লক্ষিকান্ত আসিয়া যে খাজনা চাইল।
দায়েম বলে খাজনা দেই কোনকালে!”


ভিতরে ভিতরে জ্বলছে সবাই। তিতা মিঞার আন্দাজই ঠিক ছিলো। কোথায় জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তার দলবল নিয়ে তল্লাটের সাত গাঁয়ের ভেতর মুসলমানদের একমাত্র শনের মসজিদ খানা পুড়িয়ে দিল, তা না কৃষ্ণদেবই আগে আগে বারাসত শহরের বাদুড়িয়া থানায় গিয়ে বৃটিশের কাছে গিয়ে মামলা ঠুকেছে যে তিতা মিঞার লোকেরা নাকি তার কোন্ কোন্ পাইক-বরকন্দাজকে ক’দিন আটকে রেখে অত্যাচার করেছে আর নিজেরাই নিজেদের মসজিদ পুড়িয়ে দিয়েছে জমিদারকে হেনস্থা করার জন্য। বারাসত থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তী কৃষ্ণদেবের আত্মীয়। সে তদন্তের নামে কয়েকদিন সরফরাজপুর গ্রামে ঘোরাঘুরি শেষে রিপোর্ট দিল যা তা, ‘…জমিদারকে ফ্যাসাদে ফেলিবার জন্যই তিতুমীরের লোকেরা নামাজ-ঘর পুড়াইয়া দিয়াছিল।… জমিদারের নামে যে অভিযোগ আসিয়াছে তাহার প্রমাণ হইল না।’ মসজিদে আগুন লাগানোর পর ক’দিন জমিদার কোলকাতা শহরে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। তার ক’দিন পরই বারাসতে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে গিয়ে বলেছে ‘আমি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কিছুই জানি না। এই দাঙ্গার সময় আমি কলিকাতায় ছিলাম।’ গোরা ম্যাজিস্ট্রেট সুন্দর কৃষ্ণদেবের কথাই বিশ্বাস করে উভয় পক্ষকেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে পাঁচশ টাকা জরিমানা করলেন। দোষী আর যার উপর দোষ করা হয়েছে তাদের একই শাস্তি। উল্টো তিতা মিঞার লোকজনের কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করা হয়েছে যে তারা আর এলাকায় ঝগড়া-ফ্যাসাদ করবে না। তা গোরা ম্যাজিস্ট্রেট এহেন ধারা ব্যবহার করবে বৈকি! এই গোরার দল প্রায়ই তো জমিদার বাবুর বাড়ি এসে খাওয়া-দাওয়া করে। কৃষ্ণদেব রায়ের নায়েব লক্ষিকান্ত গতকাল ফজরের সময় দায়েম কারিগরের বাসায় পেয়াদা পাঠিয়ে হাঁকাহাঁকি করে নামাজ থেকে টেনে তুলে কাচারি ঘরে নিয়ে গেছে। দাড়ি রাখার জন্য আড়াই টাকা কর ছাড়াও কী কী নাকি অনাদায়ি খাজনা মিলে মোট আটত্রিশ টাকা বাকি আছে তার।

‘এ ঠিক করতিচো না লক্ষিকান্ত বাবু! আল্লার কসম তোমাগের কাচে কোনো খাজনা বাকি নাই আমার। দাড়ি রাকা আমার দ্বীন, আমার ধর্ম। এজন্য তুমি আমার কাচ হতি আটত্রিশ টাকা অনাদায়ের নামে মিথ্যে খাজনা চাইতি পারো না!’

‘ওসব শুনবো নানে! ভাল করি ১৭৯৯ সালের আইনির ৭ নম্বর ধারাটি পড়। খাজনা বকেয়া থাকলি জমিদার যে কুনো সময়, যে কুনো প্রজাকে কয়েদ করতি পারে।’

‘খাজনা বকেয়া আমার নেই কো!’

‘আচে! আমার কাচে সব হিসাব আচে! তারপর ফোর্টুলিয়ম (ফোর্ট উইলিয়াম) হতি গত বছর নতুন আইন করিচে যে নীল চাষের জন্যি দাদন নিলি নীলির চাষ করতিই হবে। না করলি তা বেআইনী! তোরা শালা গেল বছর খরায় জমির বন্ধক ছাড়াতি দাদন নিয়ি টাকা নিস নাই? একুন সব ধান ধান করতিচিস ক্যানো? নীল চাষ করতি হবি! নয় জমিদার বাবু সদরে কেস দিবি তোমাদের নামে!’

‘দাও পাল্লে! মিথ্যি খাজনার টাকা আমি দেব না। টাকা আমার নেইও কো নায়েব মশায়। থাকলি পর আমার দিতি আপত্তি কী? জেলখানায় নিলি খারাপ কী? কদিন বিনে পয়সায় তিন বেলা খেয়ে আসবো পর!’

লক্ষিকান্ত অবশ্য কী মনে করে সেদিন দায়েম কারিগরকে আর কয়েদ খানায় আটক করেনি। তবে, তিতা মিঞার কাছে সেই সন্ধ্যায়ই এসে কেঁদে পড়েছিল।

‘উঁচু জেতের অত্যাচারে আপনার কাছে বছর তিন হয় ইসলাম কবুল করিচি তিতা মিঞা! ছিলাম তšত্তবায়ের ছেলে, জাতে যুগী। কেউ আমার হাতের জল খাতো না। ইসলাম কবুলের পর হলাম গে জোলা। একুনো কেউ আমার ছোঁয়ার জল কী পানি খায় না! সে কেউ আমাকে মান দিলো কি না দিলো সে খোঁজ রাকি নে গো! হাটে গেলে ধূতিখানা এখন তবন্দের মতো করে পরি বলে কতজনা ঠাট্টা করে কী, ‘দায়েম, তোর ঐ অঙ্গখানা বড় হয়ে গেচে নাকি?’ সে-ও কিচু মনে করি নে! কিন্তু, আপনার কতায় দাড়ি রেখে, ধূতিখানা তবন্দের মতো করে পরার দোষে যে আটত্রিশ টাকা খাজনা দিতি হবি! এতো টাকা মুই পাই কনে?’

‘কেন দায়েম? আমি তোমার হাতের পানি খাই নি কো? তোমার সাতে নারকেলবাড়িয়ার মইজুদ্দিন বিশ্বাসের বাড়ি আর সরফরাজপুরে ভোলা জোলার বাড়িতি এক পাত্রে জেয়াফতের খাওয়া খাই নি কো? সত্যকারের ইসলাম জোলা সৈয়দ কিচু মানে নাকো! ও হিঁদুদের সাতে মিশে মিশে বেশরা হবার ফল! আর ধূতি তবন্দের মতো পরার জন্যি যে যা বলে বলুক! ওটাই আমাদের দ্বীন। আমি আজ কৃষ্ণদেব রায়ের কাচে চিটি পাটাবো! জানি সে তার বজ্জাতি এতে থামাবে না। তবু, এরপর আবার আদালতে যাব। ফলাফল হবে না সেও জানি। কিন্তু, এসব চাপান-উতোরের ভেতর হতি আশ্বিন মাসের শেষ অব্দি আমাদের জঙ্গের প্রস্তুতির জন্যি সময় লাগবি। সাজন!’

সাজন গাজি এসে দাঁড়ায়।

‘তুমি তো মিঞা ভাল গান বান্ধো! বাংলাও লিকতি পারো ভালোই। আমি সহি করে দেব। আমি মুখে মুখে মুসাবিদা কচ্চি। তুমি লেকো।’

‘২রা সেপ্টেম্বর, ১৮৩১ সাল,
নারকেলবাড়িয়া, বারাসত মহকুমা, ২৪ পরগণা জেলা।

অত্র অঞ্চলের জমিদার মাননীয় কৃষ্ণদেব রায় মহাশয়,

বিনীত নিবেদন এই যে আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নাই। যদি কেহ আমার বিরুদ্ধে আপনার নিকট কোন মিথ্যা কথা বলিয়া আপনাকে উত্তেজিত করিয়া থাকে, তাহা হইলে আপনার উচিত ছিল সত্যের সন্ধান করিয়া হুকুম জারী করা। আমি দীন ইসলাম জারি করিতেছি। মুসলমানদিগকে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দিতেছি। ইহাতে আপনার অসন্তোষের কি কারণ থাকিতে পারে? ওয়াহাবী ধর্ম নামে দুনিয়ায় কোন ধর্ম নাই। ইসলাম শব্দের অর্থ হইতেছে শান্তি। ইসলামি ধরনের নাম রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছোট করা, ইদুল আজহার কোরবানি করা ও আকীকা কোরবানি করা মুসলমানদিগের উপর আল্লাহর ও আল্লাহর রসুলের আদেশ। আপনার কাছে একান্ত মিনতি যে আপনি ইসলাম ধর্মের আদেশ, বিধি-নিষেধের উপর হস্তক্ষেপ করিবেন না। আমি আশা করি আপনি আমার দলের লোকদের দাড়ি রাখার উপর আড়াই টাকা কর আরোপের হুকুম প্রত্যাহার করিবেন। ফক্ত-

হাকির ও না-চিজ
সৈয়দ নিসার আলি ওরফে তিতুমীর।’

৬.
পুঁড়া গ্রামের জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাগান বাড়িতে আজ বিজয়া দশমীর পরের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রবল উৎসব ও সেই মহালয়া হতে ষষ্ঠী-সপ্তমী-মহাষ্টমী-মহানবমী-দশমী পেরিয়ে গত ক’দিনের আরতি, প্রসাদ ভোগ আর বিসজর্নের শোভাযাত্রার সমস্ত আনন্দ-উল্লাস শেষে এই পুনর্মিলনী অপেক্ষাকৃত নির্দিষ্ট কিছু মানুষের ভেতরের এক ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠান। জলসাঘরে অতিথিদের সবার হাতে হাল্কা বিদেশী মদ্য। সামনে রুপার নানা রেকাবিতে রাখা লুচি, নিরামিষ ও পাঁঠার মাংস, ভুনা খিচুড়ি ও কয়েক রকম সন্দেশ ও দই। এসেছেন বারাসত কোর্টের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার সাহেব, রুদ্রপুর ও মূলনাথ গ্রামের নীলকর ডেভিড অ্যান্ড্রুজ সাহেব, বারঘরিয়া আর হুগলির নীলকুঠির মালিক উইলয়াম স্টর্ম ও তার ম্যানেজার পাইরন সাহেব (গাঁয়ের লোকে ডাকে পিঁরো সায়েব), আলীপুরের সার্কিট কমিশনার ই, আর, বারওয়েল, তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ণ নাগ, নাগরপুরের গৌরপ্রসাদ চৌধুরী বাবু, সরফরাজপুরের জমিদার কালিপ্রসন্ন মুখুজ্যে আর গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়, খাসপুর গ্রামের ইয়ার মোহাম্মদ ও পূর্ব বাংলার সিরাজগঞ্জে ইয়ার মোহাম্মদের চাচাতো বোনের স্বামী সৈয়দ আবুল বাশার সাহেব। ঝাড়লণ্ঠনের সামান্য দূরে বসে এলাহাবাদ হতে আসা বাঈজি ঠুংরি পরিবেশন করছিল, ‘বাজুবন্দ খুল খুল যায়!’ অতিথিদের কারোরই পানাহারে কী বাঈজি পরিবেশিত সঙ্গীতে তেমন মন নেই। সবাই একটা চাপা উত্তেজনায় ভুগছেন।

‘ইহা অতি দুঃখজনক হইলো — ইট ইজ ভেরি আনফর্চ্যুনেট দ্যাট ইন্ডিগো ইজ লুজিং ইটস মার্কেট ক্রেইজ ইন ওয়েস্ট পার্টিক্যুলারলি ইন মার্কেট অফ লন্ডন — স্টিল উই মাস্ট হোল্ড দ্য লিস্ট মার্কেট উই ক্যান — পরিতাপের বিষয় যে পশ্চিমে নীলের যে হঠাৎ বাজারদর উঠিয়াছিল উহা কমিয়া আসিতেছে — তবু, যেটুকু নীলের বাজার আছে তাহাই আমরা ছাড়িতে পারি না!’ ডেভিস অ্যান্ড্রুজ হুইস্কির গ্লাসে বরফ নাড়তে থাকেন।

‘শিওর, দ্য রাইওতস্… দ্য নেটিভ পিজ্যান্টস্ অফেন টেন্ড টু ডিজওবে দ্য ইন্ডিগো প্ল্যান্টারস্… হেই জমিন্দার বাবুস অ্যান্ড সাহিবস… ইউ দ্য হিন্ডু অ্যান্ড মুসলিম ল্যান্ডলর্ডস… ক্যানট ইউ লুক ফর আওয়ার ইন্টারেস্ট? ক্যানট ইউ প্রেস দিজ ফার্মারস্ টু এনশিওর ম্যাক্সিমাইজিং অফ দ্য ইন্ডিগো প্ল্যান্টেশন? হিন্দু ও মুসলিম সকল ভূস্বামীগণকে কহি আপনারা কি আমাদের স্বার্থ রক্ষা করিতে পারেন না? চাষীদের দ্বারা সর্বোচ্চ নীল চাষের ব্যাপারটি কি নিশ্চিত করা যায় না?’ স্টর্ম চামচে করে দই চাখেন।

‘দিজ রাইওতস্… দ্য হ্যাগার্ড পিজ্যান্টস ক্রাই ফর ওনলি প্যাডি… এই চাষাগণ শুধু ‘ধান’ ‘ধান’ বলিয়া ক্রন্দন করে… হোয়াই? হেই বাবুস এণ্ড সাহেবস… উই আর সেটিং আপ কোর্টস অ্যান্ড পুলিশ… লিগ্যাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিক্যুরিটিজ ফর ইওর প্রটেকশান… উই হ্যাভ বেস্টোওড ইউ উইথ দ্য পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট… আমরা আপনাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধা দিয়াছি… দ্যাট সেটেলমেন্ট হ্যাজ টু মেনি ক্লজেজ টু ফোর্স দ্য পিজ্যান্টস্ ফর ইন্ডিগো প্ল্যান্টেশন… ঐ বিধির নানা অনুচ্ছেদে চাষীদের আপনারা নীল চাষে বাধ্য করিতে পারেন!’ পাইরন মাথা নাড়েন।

‘অবস্থা ভাল নয়,’ কৃষ্ণদেব রায়ের বিধবা বড় দিদির সন্তান অতনু দেব রায়চৌধুরী, সদ্যই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও শেক্সপীয়র মুখস্থ বলতে পারেন, মামাকে ইংরেজি ভাষায় সহায়তা দিতে এই আসরে উপস্থিত, ‘কন্ডিশন ইজ নট টু গুড স্যার! হ্যাভ ইউ হার্ড অফ তিতুমীর? এ ফলোয়ার অফ সৈয়দ আহম্মদ শহীদ। দে কল দেমসেলভস্ ওয়াহাবি… হি ইজ ক্রিয়েটিং ক্যাওস এগেইনস্ট অল দ্য ল্যান্ড-ওনিং ক্লাসেস ইন দ্য রিজিওন অ্যান্ড গেদারিং দ্য হ্যাগার্ড পিজ্যান্টস্ এগেইনস্ট দ্য জমিন্দারস অ্যান্ড ইন্ডিগো প্ল্যান্টার্স!’

‘তিতুমির মহম্মদীয় ধর্মের কি? সে কি উগ্র ধর্মবাদী? ইজ হি আ রিলিজিয়াস ফ্যানাটিক?’ আলেকজান্ডার প্রশ্ন করেন।

‘আই এ্যাম অলসো আ মোহামেডান! বাট উই, দোজ ভেরি হ্যান্ডফুল অফ মোহামেডানস্, হু আর ট্রাইং টু ব্রেক রিলিজিয়াস সুপারস্টিশন্স অ্যান্ড গেটিং হায়ার এডুকেশন ইন ইংলিশ… উই এলিট মোহামেডানস নাউ থিঙ্ক ইট প্রপার টু পে ফেইথ অ্যান্ড লয়ালটি টু দ্য ব্রিটিশ রুল!’ ইয়ার মোহাম্মদের চাচাতো বোনের স্বামী ও সিরাজগঞ্জ হতে পাবনা-কুষ্টিয়া অবধি বিস্তীর্ণ জমিদারির মালিক ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন শাস্ত্রে সদ্য স্নাতক সৈয়দ আবুল বাশার বলেন। ভগ্নীপতিকে ইংরেজিতে আলাপচারিতায় সাহায্যের জন্য তার আজকের এই আসরে উপস্থিতি।

‘হোয়াট… হোয়াট ইজ তিতুমীর এ্যাকচুয়ালি ডুয়িং?’

‘হি ইজ পুলিং অল দ্য পিজ্যান্টস্ অ্যান্ড আর্টিসানস পার্টিক্যুলারলি দ্য ওয়েইভারস্… পুওরেস্ট অফ দ্য পুওরস অ্যান্ড দ্য আনটাচেবল কাস্টস বোথ উইদিন দ্য হিন্দুস অ্যান্ড মুসলিমস্ টুগেদার টু স্ট্যান্ড এগেইনস্ট দ্য প্রিভেইলিং সোশ্যাল অর্ডার অ্যান্ড হায়ারার্কি!’ অতনু দেব রায়চৌধুরী উত্তর করেন।

‘গড… হি ইজ অ্যান অ্যানার্কি দেন…!’

‘অতনু, সায়েবকে বলো যে তিতুমীর আর তার দলবল এখন জমি না চষে, তাঁত না বুনে শুদু ধম্মো-কম্মো করচে! মুসলমানদের খেপিয়ে তুলচে দাড়ি রাখার জন্যি!’

‘এই ওবা (ওহাবী)-দের কথা আর বলবেন না! আমরা সিরাজগঞ্জবাসী মুসলমানগণ ওহাবীয়তরূপ ‘ওবা’ (কলেরা) হইতে খোদার ফজলোয় এতদিন নিরাপদে ছিলাম। কিন্তু, প্রায় দুই তিন বৎসর গত হয় আমাদের সিরাজগঞ্জে কয়েকজন ওহাবী মৌলবীর আমদানী হয়েছে মশায়! এরা ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ আর ‘ভেড়ার দলে বাছুর প্রামাণিক’ হতে ওহাবী মতের বিস্তার আর হানিফি মতবাদের বরখেলাফ ও ছুন্নত জামায়েতের আকায়েদের উল্টো আকায়েদ ও মছলা মাছায়েল সব চাষা আর জোলার ভেতর প্রচার করে আশরাফ মুসলমানদের পাল্টা খাড়া করছে!’ সৈয়দ আবুল বাশার হাসিমুখে তামাকের গড়গড়ায় হাত বাড়ান।

‘এই ছোটজেতের ওবারা কুনো ইমাম বা মোজতাহেদের কতা শুনবি না! সবাই এক/একজন মোহাদ্দেজ… মানে মশায় আপনাদের ভেতর যাকে বলে ধম্মোশাস্তরে পণ্ডিত… প্রত্যেকেই পণ্ডিত হইয়ি বসি আচে!’ ইয়ার মোহাম্মদ এক খিলি তবক দেওয়া পান মুখে পোরেন।

‘কিপ দিজ তিতুমীর অ্যান্ড হিজ ফলোয়ার্স উইদিন পার্মানেন্ট ফিয়ার অ্যান্ড টেরর!’ কুঞ্চিত ভ্রু নীলকর ডেভিস অ্যান্ড্রুজ পানপাত্রের শেষ তরলটুকু গলায় ঢালেন।

৭.
পুঁড়া গ্রামের বারোয়ারী তলায় সেদিন সকাল হতেই পূজা আর যাত্রার ধূম। ইংরেজের কালে ইংরেজের ক্যালেন্ডার বলে কথা। আগে গাঁয়ের সবাই বৈশাখ হতে চৈত্র অবধি বারো মাস গণত এক হিসেবে। এ গাঁয়ে জমিদার বাবুর ভাগ্নে অতনু একটা স্কুল খুলে হেডমাস্টার হয়েছে যেখানে ছেলেরা ইংরেজিতে গ্যাট ম্যাট ক্যাট তো শিখছেই নতুন নতুন মাসের নামও বলছে। এই তো এবার দুর্গা মায়ের পূজা শেষ হতে হতে আশ্বিনের তৃতীয় হপ্তা পেরোলো। হিঁদুদের তো পূজার শেষ নেই। এক হপ্তা না যেতে লক্ষী ঠাকুরুণের পূজা শেষ। আরো এক হপ্তা না হতেই শ্যামা মায়ের পূজা শুরু। কাল রাতে শ্যামা পূজা। এ উপলক্ষ্যে বারোয়ারী তলায় সকাল হতে যাত্রা, রামায়ণ গান আর পূজার তোড়জোর।

‘নারায়ে তকবির — আল্লাহু আকবর! নারায়ে তকবির — আল্লাহু আকবর!’

দূর থেকে প্রায় পাঁচশো মানুষের এক মিছিল আসছে। মিছিলের মানুষগুলোর হাতে খোলা তলোয়ার, লাঠি ও বল্লম। ইতোমধ্যে মিছিলের এই মানুষেরা খোদ কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ির ফটক হয়ে ঘুরে এসেছে। তিতা মিঞার মানুষেরা তরবারি, লাঠি আর বল্লম নিয়ে জমিদার বাড়ির ফটক ঘিরে ধরলেও সেই ফটক ততক্ষণে ভেতর হতে বন্ধ করা হয়ে গেছিল। জমিদার বাড়ির পুরুষ সদস্যরা বাড়ির ছাদ হতে সমানে ইট ফেলতে থাকলে তিতা মিঞার লোকজন জমিদার বাড়ি ছেড়ে গ্রামের বারোয়ারী তলায় আসে। এখানে জমিদারের স্থাপিত মন্দির তাদের লক্ষ্য। তিনমাস জমিদারের পাইক-বরকন্দাজ তাদের শনের মসজিদ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল আর শুকরের মাংস ও রক্ত নিক্ষেপ করেছিল। আজ এই মন্দিরে গো মাংস ও গোরক্ত নিক্ষেপ তাদের জঙ্গের প্রথম লক্ষ্য।

‘ওগো মাগো রক্ষে করো গো — ঠাকুর!’

মুহূর্তে উদ্ভ্রান্ত ছুটতে থাকে শ’য়ে শ’য়ে নারী-শিশু ও এমনকি নিরীহ গৃহস্থ পুরুষেরা যারা এখানে এসেছিল নিছকই উৎসব-অনুষ্ঠানের মজা দেখতে।

‘মরলে শহীদ — জিতলে গাজি!’ দলের সবার সামনে তিতা মিঞার ভরাট গলার ডাক শোনা যায়।

বারোয়ারি তলার পথের ঠিক মুখোমুখিই বাজার। মহেশ ঘোষ তার খান কয়েক গরু এনেছিল বিক্রির জন্য। তিতা মিঞার ভাগ্নে গোলাম মাসুম নাঙা তলোয়ার হাতে ছুটে গেল সেদিকে। তার সাথে সাথে আরো ছুটে গেল মুসদীন মণ্ডল, আল্লাদি মণ্ডল, ন্যায়পাল মণ্ডল, ওজিল, থাণ্ডায়, তোরাবালি, মুলুক চাঁদ, খাওয়াজী, লঙ্গ প্রকাশ রাজিম, নতাওয়াত, ধানু। গোকুল চক্কোত্তি মহেশ ঘোষের হয়ে লড়তে এসেছিল। এতজন মানুষের সামনে বেচারির কিছুই করার থাকে না! উল্টো দায়েম ও কায়েম কারিগর বামুনের কাপড় খুলে ফেলে, ‘শোন চক্কোত্তি, বেশি বাড়াবাড়ি করলে কাল জাত পাল্টে দেব তোমার!’

প্রাণনাথ বাবুর নীলকুঠির স্মিথ সাহেব হাতির পিঠে চড়ে এদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাকে হাতি হতে নামিয়ে পেটানো হলো। বাজারের মুদি দোকানীদের হাত হতে জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হলো। তিতা মিঞা তলোয়ার মাথার উপর তুলে গরু জবাই করলেন। মন্দিরের পুরোহিত অবশ্য বেজায় সাহসী প্রকৃতির মানুষ। ভক্ত শূন্য হয়ে পড়তে থাকা মন্দির প্রাঙ্গনে একাই প্রকাণ্ড খড়গ তুলে ‘জয় মা কালী!’ বলে ধেয়ে আসেন পুরোহিত। পুরোহিতের খড়গের অব্যর্থ তিন/চারটা ধাক্কায় ছিটকে পড়লো বিচু কারিগর, আকিল মোহাম্মদ আর বাখতুরের মুণ্ডু। ততক্ষণে ওজিল, থাণ্ডায়, তোরাবালি আর গোলাম মাসুম চারদিক হতে ঘিরে ধরেছে পুরোহিতকে। পুরোহিতের মাথা ছিটকে পড়লো গোলাম মাসুমের তলোয়ারের এক কোপে। গরুটি চার খণ্ড করে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো মন্দিরের চার দেয়ালে আর তার রক্তও ছিটিয়ে দেওয়া হলো মন্দিরের মেঝেতে আর দেয়ালে।


… লাউঘাটিতে ছিলো নামে সাকের সর্দার।
মোমিন পৌঁছিল গিয়া পায় সমাচার।
গোরু জাব কোরে খানা তৈয়ার করিল।
আছুদা করিয়া খানা সবে খেলাইলো।
খানা খেয়ে মোমিনেরা আছুল বসিয়া।
হরিদেব দেবরায় খবর পাইয়া।।
তিন চারি শত লোক সঙ্গে লিয়া তারা।
লড়িতে আইলো গিধি করিয়া পৈতারা।।
… … …
জখোন থাকিলো তারা মার মার বলি।
মেঘের বেজলি জেনো কর্ণে লাগে তালি।।
এসে চারিদিকে ঘেরে মমিন সবারে।


৮.
ফৌজদারি নথি ৬৭
(১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর ফোর্ট উইলিয়ামস্থ বিচার বিভাগীয় উপ-সচিব মান্যবর আই, থমসনকে ১৮ বা ২৪ পরগণা ডিভিশনের সার্কিট কমিশনার ই. আর. বারওয়েল কর্তৃক লিখিত)।

মহোদয়,
আপনার আধা-সরকারি চিঠির (আগের দিনের তারিখ সম্বলিত) সূত্রে যথাবিহিত সম্মানপূর্বক লিখছি যে আমি বারাসতের যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চিঠি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে গোলযোগের স্থান পরিদর্শন করা হয়; এর পরই আজ সকালে আমি ব্যক্তিগত ভাবে ঐ স্থান পরিদর্শন করি। মি. স্টর্মের মফস্বল এজেন্টের পাঠানো রিপোর্ট ও মি. আলেকজান্ডারের পুলিশ বা কর্মকর্তার পাঠানো রিপোর্টের যথার্থতা যাচাই করার জন্য আমি তা করি। এটা দুঃখজনক যে মি. স্টর্মের এজেন্ট কর্তৃক প্রেরিত রিপোর্ট ও অন্যান্য রিপোর্টগুলো অনুযায়ী দেখা যায় যে এলাকায় আইনবিরোধী কার্যকলাপ বাড়ছে। অন্য রিপোর্টগুলো প্রেরণ করেছিল বশিরহাট ও কলিঙ্গ থানার দারোগা বা পুলিশ। এইগুলোতে দেখা যায় যে দুষ্কৃতিকারীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে এবং এরা মহম্মদীয় ধর্মের একটি সম্প্রদায় হিসাবে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে আমার মতে এদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল লুটতরাজ। এই দলটির নেতৃত্বে ছিল ‘তিতুমীর’ ও ‘গোলাম মাসুম’ নামের দুই ব্যক্তি। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি। অপর ব্যক্তি কতিপয় লোক দ্বারা বেদম প্রহারে আহত হয়ে বারাসত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল।

অফিসিয়েটিং ম্যাজিস্ট্রেট মি.আলেকজান্ডার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জন বরকন্দাজ, ৩ জন জমাদারকে বশিরহাট থানার শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু আমি দুষ্কৃতিকারীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সামরিক বাহিনী প্রেরণের চিন্তা করি। এই উদ্দেশ্যে সময়ের বিষয়টি চিন্তা করে কলিকাতা সিলিফিয়ার একটি ছোট দল বশির হাটে পাঠানোর চিন্তা করি। এই দলে ছিল জমাদার ও পঁচিশজন সিপাহী। এই দলটি প্রয়োজনে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। আমি বিশ্বাস করি যে ভাইস-প্রেসিডেন্ট-ইন-কাউন্সিল আমার পদক্ষেপ অনুমোদন করবেন।

আলীপুর আপনার অনুগত,
কমিশনার অফিস স্বাক্ষর/ ই.আর.বারওয়েল।
১৪ নভেম্বর, ১৮৩১। সার্কিট কমিশনার।

চিঠি লেখা শেষ করে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন বারওয়েল। গত এক সপ্তাহে ২৪ পরগণার বারাসাতের গ্রামগুলোয় কিছু ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে। ৬ই নভেম্বর এই তল্লাটের সবচেয়ে ডাকসাইটে জমিদার খোদ কৃষ্ণদেব রায়ের গ্রামে জমিদার স্থাপিত মন্দিরে ওয়াহাবি নেতা তিতুমীর ও তার দলের লোকেরা গোহত্যা করে মন্দিরের চার দিকে গরুর চার অংশ ঝুলিয়ে রেখেছে ও মন্দিরের দেয়াল ও মেঝেতে গোরক্ত নিক্ষেপ করেছে। বৃটিশ স্মিথকে তারা পিটিয়েছে। বাজারের দোকানীদের কাছ থেকে খাবার কেড়ে খেয়েছে। তিন মাস আগে তাদের মসজিদে আগুন ধরানো ও শূকরের মাংস ছড়ানোর ফলাফল এটি। এটুকু হলেও চলতো। পরের দিন সাতই নভেম্বরই পুঁড়া বাজার হতে খানিক দূরের লাউঘাটিতে তারা আবার তিনটি গরু জবাই করেছে এবং সাকের সর্দার নামে তিতুমীরের এক শিষ্য সেই গরুর মাংস রান্না করেছে। গোবরা-গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদার রতিকান্ত রায়ের ছেলে হরিদেব আর দেবনাথ রায় হিন্দু রায়তদের নিয়ে এসে গরু কোরবানির কাজে বাধা দেবার সময় দেবনাথ রায় মারা যায়। দেবনাথ রায়কে তিতুমীরের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে অবশ্য সাহস দিয়েছিল খাসপুর গ্রামের ইয়ার মোহাম্মদ আর তল্লাটের বড় নীলকর ডেভিস অ্যান্ড্রুজ। ডেভিস অ্যান্ড্রুজ প্রায় দুইশো লাঠিয়াল, সড়কিঅলা আর বন্দুকঅলা পাইক পাঠিয়েছিলেন। কোলকাতা থেকে জমিদার লাটু বাবু দেবনাথ রায়ের বন্ধু কালীপ্রসন্ন মুখার্জিকে পাঠিয়েছিলেন দুইশো হাবসি সৈন্য যাতে তিতা মিঞার দল হাবসিদের দেখেই ভয় মানে। কিসের কী? ডেভিস অ্যান্ড্রুজ, দেবনাথ রায়, কালীপ্রসন্ন কি ইয়ার মোহাম্মদ সবাই মিলে পারল না ক’জন চাষাভূষাকে হারাতে! তিতা মিঞারা প্রায় পাঁচশ লাঠিয়াল শুধু লাঠি আর তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করেই নাকি জিতে গেছে। বড় জটিল এই ভারতবর্ষের বিশেষতঃ বাংলার মানুষের রাজনীতি, ধর্ম আর ভূমিকে কেন্দ্র করে হানাহানির ব্যকরণ বোঝা। বারওয়েল বয়সে তরুণ। ছাত্রজীবনে দুরূহ মেধার স্বীকৃতি হিসেবে খুব অল্প বয়সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে আলীপুরের সার্কিট কমিশনার হয়ে এসেছেন। সপ্তাহ দুই কি তিন আগে বারাসতের প্রতাপশালী হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়িতে একটি নিমন্ত্রণে আমন্ত্রিত হয়ে প্রথম তিনি তিতুমীরের দল ও আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পান। বাংলার এক গ্রামীণ মধ্যবিত্ত তবে উচ্চবংশীয় সৈয়দ পরিবারের মুসলিম সন্তান তিতুমীর ইংরেজি না জানলেও বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষা নাকি লিখতে-পড়তে পারেন। প্রথম যৌবনে কৃষিকাজ করে শরীর শক্ত-পোক্ত হওয়ার পর এক হিন্দু জমিদারের লাঠিয়ালগিরির কাজ নিয়েছিলেন। সেই লাঠিয়ালগিরি করতে গিয়েই একবার এক মামলায় বেশ কয়েক বছর জেল খাটতে হয়। জেলখানা হতে বের হবার পর… অন্য লাঠিয়ালদের মতো আবারো পুরনো প্রভুর খাঁচায় ফিরে না গিয়ে… তার ভেতর আগুন ছিল নিশ্চিত… নিজেকে নিয়ে হয়তো তার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল… মক্কা চলে গেছিলেন হজ্ব করতে… সেখানে উত্তর ভারতের সৈয়দ আহম্মদ শহীদের ‘তরিকা-ই-মুহম্মদীয়া’ আন্দোলনের প্রভাবে এসে তিনি শরিয়তি ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে নিজ গ্রামে ফেরেন। ভারতের বিশেষতঃ বাংলা অঞ্চলের বিপুল মানুষ গত কয়েক শতকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম ও অস্পৃশ্যতাই মূলতঃ এই বঞ্চিত মানুষদের পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে বহু দূর আরবের ধর্মগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু, পিতৃপুরুষের ধর্মের সংস্কৃতিগত প্রচুর প্রভাব আজো এই অঞ্চলের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ফেলতে পারে নি। তুরস্ক ও পারস্যদেশ হতে প্রচুর সূফী সাধকেরা এসেছিলেন এই এলাকায় ইসলাম ধর্মপ্রচারের কাজে। সূফীবাদ ও এই অঞ্চলের অতীত হিন্দু ও বৌদ্ধ ঐতিহ্য মিলে মিশে এখানকার মুসলমানরা যে ধর্মটি পালন করে, তা মূল ইসলাম হতে যোজন যোজন দূরবর্তী। তিতুমীরের আন্দোলনটাও ঠিক এ জায়গাতেই। আজো এখানকার অন্ত্যজ শ্রেণীর হিন্দু হতে ধর্মান্তরিত মুসলিমরা নাকি হিন্দু নাম রাখে, হিন্দুদের মতো ধূতি ও শাড়ি পরে, বিবাহিতা মুসলিম রমণীগণ হিন্দু মেয়েদের মতোই শাঁখা-সিঁদুর পরে, হিন্দুদের মন্দিরে অর্ঘ্য বা বলি দেবার মতো এরাও পীরের নানা থানে বলি দেয়, মানত করে। তিতুমীর এখন এলাকার মুসলিমদের আরবি ফারসি নাম রাখতে বলছেন, ধূতিটা অন্যভাবে পরতে বলছেন, মেয়েদের শাঁখা-সিঁদুর খুলিয়ে নিয়ে বোরখা পরতে বলছেন, হিন্দু জমিদারদের প্রশ্ন করছেন কেন গোহত্যা নিষিদ্ধ হবে, কেন মুসলিমরা তাদের ধর্মে বৈধ খাবার খেতে পারবে না? গত কয়েক বছরে চাষী ও জেলে সম্প্রদায়ের প্রচুর হিন্দু উচ্চবর্ণের অত্যাচারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তিতুমীরের দলে যোগ দিয়েছে। অনেকে আবার ধর্ম না বদলেই তিতুমীরের সাথে আছে। সবচেয়ে যেটা ভয়ানক সেটা হলো উচ্চবিত্ত মুসলিমরা তিতুমীরের দলে নেই আবার নিম্নবিত্ত হিন্দুরা জমিদারদের সাথে নেই! তাহলে এটাকে ঠিক ধর্মীয় লড়াইও বলা যাবে না। আপাতঃ দৃষ্টিতে দেখলে ধর্মীয় লড়াই বলেই মনে হবে যদিও। এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষগুলোই… যাদের নিচুজাত করে রাখা হয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী… অসম্ভব বেদনা নিয়ে যারা পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করেছে… ইসলাম তাই না চাইতেও এখানে হয়ে উঠেছে শোষিতের ধর্ম আর হিন্দু ধর্ম মূলতঃ এখানে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের ধর্ম। ধনবান আর বিত্তহীনের লড়াইটা এই অঞ্চলে কীভাবে যেন সাম্প্রদায়িক একটা যুদ্ধের চেহারা নিচ্ছে! ইউরোপে যেমন ক্যাথলিক ধর্ম শেষের দিকে হয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্ষমতাশালী সামন্তপ্রভু, রাজা-রাজড়া আর পুরোহিতদের ধর্ম আর প্রটেস্ট্যান্টদের ধর্ম হয়ে উঠেছিল ভূমিদাস, কয়লা খনির শ্রমিক কি বাজারের ক্ষুদে ফেরিওয়ালার ধর্ম… এখানেও ঠিক তেমন একটা ব্যাপার চলছে!… আর বারওয়েল নিজে? ইংল্যান্ডের খুব কমোনার পরিবারের সন্তান তিনি। বাবার বাবা ছিল ভূমিদাস। বাবা কীভাবে কীভাবে খুদে দোকানদারির কাজ জুটিয়ে সংসারের চেহারা একটু স্বচ্ছলতর করেছেন। তার ছেলে হয়ে বারওয়েল পরীক্ষায় লর্ড ব্যারনদের সন্তানদের হারিয়েছেন। এই বাংলার না খাওয়া হাড্ডিসার কৃষক আর তাঁতীদের দুঃখ তাই কোথাও তাকে স্পর্শ করে। কিন্তু, জমিদাররাই এদেশে বৃটিশের বন্ধু। তাই, খুব ঠাণ্ডা মাথায় সরকারী সমস্ত কর্তব্য কর্ম আর নথিপত্রে তাকে জমিদার ও নীলকরদের পক্ষই নিতে হবে বৈকি। সেই সরকারী নথিপত্রের ভাষায় নিজের অন্তরের একটি শব্দও তিনি লিখবেন না। নীলকর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও জমিদারদের দৃষ্টিভঙ্গি হতেই তিনি ব্যবহার করবেন প্রতিটি শব্দ।

৯.
“রাজার বেটা মোহন লাল, সঙ্গে চলে ভেড়ার পাল’’

পৃথিবীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ এ সব কিছুর ভেতর হতেও শুধুমাত্র শিশুরাই আনন্দ তৈরি করে নিতে জানে। নয়তো তল্লাটের সব বয়ষ্ক নর-নারী যখন বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, তিতা মিঞার লোকজনের ভয়ে খোদ জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তল্লাট ছেড়ে ভেগেছে… শুধু উঁচু জাতের বামুন-কায়েত জমিদার নয়, তিতা মিঞার লোকজন গত পাঁচ/ছয়দিনে রুদ্রপুর ও মূলনাথ গ্রামের নীলকর ডেভিড অ্যান্ড্রুজ সাহেব, বারঘরিয়া আর হুগলির নীলকুঠির মালিক উইলয়াম স্টর্ম ও তার ম্যানেজার পাইরন সাহেবকেও কুঠি ছাড়া করেছে… সাহেবরা সব ভয়ে এদিক ওদিক দৌড় দিয়েছে… এরই ভেতর কি হিন্দু কি মুসলিম শুধু নাবালক শিশুরাই বাবা-মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে তিতা মিঞার লোকদের পিছু পিছু দৌড়ে চলেছে! ঐ তো তিতা মিঞার লোকজন বারঘরের নীল কুঠিতে গিয়ে গা ঢাকা দেওয়া কুঠিয়াল স্মিথ সাহেবের এক পাল ভেড়া নিয়ে ফিরছে আর বাচ্চারা পিছ পিছ হাত তালি দিয়ে ছুটছে ঠাকুরদাদার থলে হতে ছড়া আওড়াতে আওড়াতে, ‘রাজার বেটা মোহন লাল, সঙ্গে চলে ভেড়ার পাল!’ বারঘরের নীল কুঠিতে হঠাৎই বাতাস এসেছে আর বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তিতা মিঞার লোকজনের ভেঙে ফেলা নীলের বাক্স হতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া নীল।

‘আমি নীল মাখপো!’

‘না-না — আমি-আমি!’

বাচ্চারা গায়ে নীল মেখে হুটোপুটি করে যেন ফিরে চৈত্র মাসের দোল উৎসব এসেছে।

‘এ খোকা-খুকিরা তো ভারি যন্ত্রণা করে!’ তিতা মিঞার দলের শরাঅলারা একটু ধমক দিলেও শিশুদের তারা তেমন কিছু বলে না।

‘ইয়ার মোহাম্মদ বাসায় আছো?’

খাসপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত ইয়ার মোহাম্মদ, তারা বিশুদ্ধ চুঘতাই তুর্কি বংশোদ্ভূত, আজো সবার গায়ের রং ধবধবে ফর্সা ও চোখের মণি প্রায় নীল, কোনো এক জেদের বশেই পালান নি! সত্যিকারের মুসলমান তো এ এলাকার একজনও না! খেতে না পেরে কি উঁচু জাতের সাথে টিঁকতে না পেরে এরা মুসলমান হয়েছে। এদের সাথে খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা করা যায় নাকি? বরং জাতের হিন্দু পেলে মেলা-মেশা করা যায়। ভাল ইয়ার মোহাম্মদদের পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিয়েও হয় দূরে দূরে। এলাহাবাদ, লক্ষৌ, কাশ্মীর কি নিদেনপক্ষে বিহারের কমে তাদের বিয়ে হয় না। অনেক সময় বর্ণহিন্দুদের মতোই খান্দান মিলাতে না পারলে পরিবারের কন্যারা জীবন ভর অবিবাহিত থেকে যায় তবু খান্দানহীন বিয়ে এ বাড়ির মেয়েদের হয় না। একটা কথা অনেকেই জানে না। হানাফি সুন্নী বিয়ের আইনে বিয়ের যে আটটি শর্তের কথা বলা হয়েছে তার ভেতর ধর্মের মিলের আগেও বলা হয়েছে বংশের মিলের কথা। দ্বিতীয় শর্তে ধর্মের কথা বা একই ধর্মাবলম্বী হবার কথা বলা হয়েছে। এম্নিতে কোরাণের আয়াত যদিও আছে যে অবিশ্বাসী (অমুসলিম) রাজপুত্র বা রাজকন্যার চেয়ে বিশ্বাসী (মুসলিম) ক্রিতদাস বা ক্রিতদাসী বিয়ে করা ভালো, কিন্তু ফিকাহ শাস্ত্রের বড় এলেমরা একটি বৈধ সুন্নী ও হানাফি মজহাবের বিয়েতে ভুলে কিম্বা অভুলে হোক, ধর্মের ঐক্যের আগেও বংশের ঐক্যের কথা বলেছেন। খান্দান কি যে সে জিনিস? ইয়ার মোহাম্মদের এক অপরূপা সুন্দরী বোন আজীবন বিয়ে না হয়েই কিছুদিন আগে মরেছে। তার দুই কন্যার বড়টি বিধবা ও ছোটটিও অবিশ্বাস্য সুন্দরী তবে অবিবাহিতা। পরিবারে স্ত্রী-কন্যা সবাই উর্দু ও ফার্সি ভাষী। ইয়ার মোহাম্মদ সহ পরিবারের অল্প কয়েকজন হাতে গোনা পুরুষ সদস্য যাদের কিনা হাটে-বাজারে, কোর্টে-কাচারিতে প্রায়ই দৌড়াতে হয় তারাই শুধু বাংলাটা সড়গড় বলতে ও পড়তে পারেন। তিন পুরুষ আগে দিল্লী হতে ইয়ার মোহাম্মদের অমাত্য পূর্বপুরুষ কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে প্রাণ হাতে পালিয়ে এতদূর এসেছিলেন। সাথে সামান্য যা সম্পদ আনতে পেরেছিলেন সেই সম্পদ ও উচ্চ বংশীয় মেধা ও চাতুর্যের জোরে এই বাংলাতেও অগাধ সম্পদ ক্রয় করতে তাদের দেরি হয় নি। পরিবারে মেয়ে কি মা-দাদিমারাও আজো সালোয়ার-কামিজ পরে। হিন্দুদের দেখাদেখি বাঙালী মুসলমান মেয়েরাও শাড়ি পরে দেখে তাদের ভারি আশ্চর্য লাগে। এজন্যই তারা এখানকার মুসলমানদের মুসলমান মনে করেন না। ইয়ার মোহাম্মদ স্থির গাম্ভীর্যে নিজের হাতেই ফটক খুললেন।

‘কী চাও তোমরা?’

‘আপনার দুই সুন্দরী কইন্যে আচে না? একটি বেধবা আর একটি মেয়েকে খান্দানের নামে আবিয়াতো রেকেচেন! ওদের শরিয়ত মোতাবেক সাদি দিতে চাই মোদের দলের কালু আর মহিবুল্লাহর সাতে। ওদের বয়স প্রায় তিরিশ, একুনো সাদি হয় নি তাই!’

‘বেত্তমিজ! বাহার যাও! আভি নিকালো!’ ইয়ার মোহাম্মদ হিতাহিত জ্ঞান হারান।

‘তুমি চুপ করো কৃষ্ণদেবের দালাল কোতাকার! নীলকরের দালাল!’ গোলাম মাসুম তার কাদা-মাটিতে ধান চাষ করা হাতে ঠাস করে একটা চড় কষালো চুঘতাই তুর্কি ইয়ার মোহাম্মদের গালে।

এর পরের ঘটনাগুলো খুবই সংক্ষিপ্ত। মুসদীন মণ্ডল, আল্লাদি মণ্ডল, ন্যায়পাল মণ্ডল, ওজিল, থাণ্ডায়, তোরাবালি, মুলুক চাঁদ, খাওয়াজী, লঙ্গ প্রকাশ রাজিম, নতাওয়াত, ধানু, রাহমত, বাদাল, পাচু, সৈয়দ নিসরা কলি সবাই মিলে শক্তভাবে ইয়ার মোহাম্মদ আর বাড়ির অন্য পুরুষদের হাত পা বেঁধে বাড়ির ভেতর থেকে টেনে আনলেন দুই কন্যা বিধবা মাহতাব আর কুমারী খুরমাকে। ফকির কোরবান শাহ তিতা মিঞার দলে তো আগে থেকেই ছিলেন। তিনিই বিয়ে পড়ানোর তোড়জোর করলেন। অপরূপ সুন্দরী মেয়ে দুটো ভয়ানক কান্নাকাটি আর চিৎকার করছিল।

‘মুজকো ছোড় দো তুমলোগ! তুম ডাকু ঔর বুরা আদমি হো!’

অমন নীলাভ চোখের প্রায় শ্বেতাঙ্গিনী দুই তরুণীর পক্ষে গাট্টাগোট্টা, বেঁটে ও কালো আর হতকুচ্ছিত কালু আর মহিবুল্লার সাথে বিয়ের কথা ভাবাও ভয়ঙ্কর ব্যাপার বৈকি। ফকির কোরবান শাহ ওদিকে তার মতো বিয়ে পড়িয়ে চলেন, ‘চব্বিশ পরগণার বারাসাতের শরিফপুর মৌজার খাসপুর গ্রামের ইয়ার মোহাম্মদের কন্যা মোসাম্মাৎ খুরমা, আপনি কি কালু মণ্ডল, পিতা- মাদার মণ্ডল, গ্রাম- সরফরাজপুর, মহকুমা- বারাসাত, জেলা- চব্বিশ পরগণাকে পাঁচ টাকা দেনমোহরে নিকাহ করিতে কবুল?’

‘ইয়া আল্লাহ্!’ দুই তরুণীই মূর্চ্ছা যায়। তাদের খান্দানে লাখ টাকা দেনমোহরের কমে কখনো কারো নিকাহ হবার কথা তারা শোনেই নি!

১০.

‘এলাহি ভাবিয়া বাঁশের বানাইল কেল্লা।
ঘাস বাশ দিয়া তবে বানাইল ছেল্লা।।
তাহার ভিতরে জমা সকলে রহিলো।
বেদিন দেখিয়া মোনে সঙ্কট জানিলো।।’’


তল্লাটের একটি গ্রামের বাঁশঝাড়ে আর কোনো বাঁশ নেই কো! তিতা মিঞার লোকজন পুঁড়া আর লাউঘাটিতে জঙ্গ জেতার পর গত ক’দিন বাঁশ কেটে কেটে নারকেলবাড়িয়ায় এক এ্যায়সা বাঁশের কেল্লা বানিয়েছে। এই বাঁশের কেল্লার ভেতর ছোট ছোট অগুনতি ঘর। কোনো ঘরে তলোয়ার, বর্শা, সড়কি, বাঁশের ছোটবড় লাঠি আবার কোনো ঘরে কাঁচা বেল আর ইটের স্তূপ। কেল্লা বানানো শেষ হবার পর তিতা মিঞা তার সাকরেদদের নিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। নামাজ আদায় শেষে তিতা মিঞা দুই হাত তুলে বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদার রসুলুল্লাহ! ভাইয়েরা আমার! আমরা গরীব মানুষ। চাষী-গেরস্থ-জোলা-নিকিরি! ইংরাজের মতো ফোর্টুলিয়ম (ফোর্ট উইলিয়াম) আমাদের নেই কো! আমাদের গরীবের আচে শুদু এই বাঁশের কেল্লা। কিন্তু, আল্লাহ ও পয়গম্বর চাহেন তো এই বাঁশের কেল্লাই হারিয়ে দেবে ইংরাজের কেল্লা ফোর্টুলিয়মকে! কন দিকি সবাই, লাঙ্গল যার…’

‘জমি তার!’

*

আসলে দুনিয়াটা যেন এতদিনে সত্যি সত্যিই দু’ভাগ হয়ে যেতে চাইছে। এমনি প্রবল এক জঙ্গ চারদিকে। এমন জঙ্গ এতদিন শুধু পুঁথি-কিতাবেই শোনা গেছে। কারবালার জঙ্গ বা হিঁদুদের রামায়ণ-মহাভারতের যুদ্ধ। কে জিতবে? তিতা মিঞাই তো জিতছে। গেল আশ্বিনের শেষ সপ্তাহ ধরে তিতা মিঞা নাকি তার দলের সব লোকজনকে নিয়ে ‘মৌত কা খানা’ খেয়েছে। মৃত্যুর খাওয়া। এই খাওয়ার পর যে জঙ্গ, সে জঙ্গে তারা জিততেও পারে আবার হারতেও পারে। তা জিতছে বৈকি তিতা মিঞা। জিতেছে পুঁড়া গ্রামের মন্দির দখলের যুদ্ধে। তার পরদিন লাউঘাটির যুদ্ধেও তারা জিতেছে। গতকাল সাত সকালে খান্দানি ইয়ার মোহাম্মদের বাড়ির দুই মেয়েকে তিতা মিঞার সঙ্গীরা বিয়ে করেছে। উঁচু জাত হিন্দুর জমিদারের মন্দির, আশরাফ মুসলমানের মেয়ে কি গোরা নীলকরের নীল কুঠির বস্তা বস্তা নীল… সব কিছুই তিতা মিঞার লোকজন তছনছ করে দিচ্ছে! তিতা মিঞার দল এখন জমিদার কৃষ্ণদেবের আত্মীয় দারোগা রামরাম চক্রবর্ত্তীকে খুঁজছে যে কিনা সরফরাজপুরের শণের মসজিদ পোড়ানোর পর উল্টো মুসলমানদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। চাষীদের কাছ থেকে ফসলের একটা অংশ খাজনা নিচ্ছে তিতা মিঞা। কিম্বা, বলা ভালো চাষীরা নিজে থেকেই তাকে খাজনা দিচ্ছে। পৃথিবীতে তরিকা-ই-মহম্মদীয়া বা মহম্মদের তরিকা প্রতিষ্ঠা হতে খুব বেশি দেরি নেই যখন জমিনে চাষীরাই বাদশাহি করবে। আর আজ নাকি খোদ ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার সাহেব আসছেন নারকেলবাড়িয়াতে। গতকালই নারকেলবাড়িয়া আসার পথে বাউগণ্ডিতে যশোর লবণ আড়তে দাঁড়িয়ে থাকা ১৮ জন সেপাই আর বশিরহাট হতে তিন জন জমাদার আর ৩০ জন বরকন্দাজ আলেকজান্ডার সাহেবের সাথে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু, কই? আলেকজান্ডার তো তিতা মিঞার সামনে এসে মেনি বিড়ালটা হয়ে গেল। নারকেলবাড়িয়ার মাঠে তিতা মিঞারা জনা পাঁচশ মুনিষ্যি সেই অস্ত্র বলতে যা লাঠি, তরবারি আর বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল। আলেকজান্ডার প্রথমে ভাবলো কী যে হোক তার দলে সব মিলিয়ে জনা পঞ্চাশ মাত্র সেপাই, তাদের সবার আছে বন্দুক। আর, এদের হাতে লাঠি-সড়কি ছাড়া কিছুই নেই। তাই একটু ভাব নিলেন। বললেন বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ করতে। ফাঁকা আওয়াজে তিতা মিঞার সিপাহি-লস্করদের আণ্ডাটা হোল! উল্টো তারা লাঠি বাজিয়ে সিপাইদের কইলো জঙ্গে নামতে। এবার সিপাইরা বন্দুকে গুলি ভরতে যেই না গেল, তার আগেই লাঠি সোটা নিয়ে পাঁচশ শরাওয়ালা পঞ্চাশ জন সিপাইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দশ জনা সেপাই, তিন জনা বরকন্দাজ আর এক জনা জমাদার সাথে সাথে নিকেশ হয়ে গেল! একজন হাবিলদার জখম হোল কি যেন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো! দারোগা রামরাম চক্রবর্ত্তীকে বাঁশের কেল্লায় নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। এভাবেই তিতা মিঞা এক/একটা জঙ্গে জেতে আর সাজন গাজির গানের খাতা ভারি হতে থাকে,

পয়ারে লিখেছে তায়কেষ্টদেবের আব্র“ জায়
পুড়োর বাজার সব লেচ্ছে লুটে।
কাধে সব গরাণের কোড়াদৌড়ায় যেন থানের ঘোড়া
কায়েত বাওন সব পালাল ছুটে।।

কালীবাবু আবজেরেআলিজিন্দা২ সাহেবেরে
হাজার টাকা নজর গিয়ে দিল।
…বারাসাতের মেজেস্টে৩হুকুম দেছে পলটানে
প্রোছে টোটাতে বারুদ।
পায়জামা পিন্দিল তায়লাল কুর্ত্তি টোপ মাথায়
খাড়া হইল যন যোমের দূত।।

আক্কেল মোল্লা দেউলে ছিলনারকেলবেড়ে খবর দিল
হজরতের কচ্চেন সোমাচার।
পলটান আসিতেছে তাতেআলিজিন্দা সাহেব সাতে
কালীবাবু রসদ দিচ্ছে তার।।
হজরত হুকুম করেছোট বড় সাহেব তরে
পলটান আর আসতেছে জমিদার।
দিনের লড়াই করবাচ কিংবা মর
আমরা সবে কি করেছি তার।।

তিন লড়াই হল জিতসরাঅওলা আনন্দিত
নারিকেলবেড়ে হইল কারবালা।
বেদেপোতায় প’ল রোতলহুতে পড়িল সোত
তামাসা দেখিল খোদাতলা।।

১১.
ফৌজদারি নথি ৮৪
বনগাঁওয়ের ৭/৮ মাইল উত্তরে অবস্থিত মোলনাথ ফ্যাক্টরি থেকে নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ই, পি. স্মিথ এর লিখিত চিঠি। ১৭ নভেম্বর, ১৮৩১।

মহোদয়,

যথাবিহীত সম্মানের সাথে জানাচ্ছি যে মি. ডেভিড এণ্ড্রুজ ও তাঁর দল আমার সাথে হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে এই স্থানে পৌঁছেছি। বারগুরিয়া থেকে অলৌকিকভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে আমরা এসেছি। দুষ্কৃতিকারী গণ বারগুরিয়া ফ্যাক্টরি তছনচ করে। এছাড়া মি. এণ্ড্রুজ-এর একটি হাতি, আসবাবপত্র, তৈজসপত্রসহ একটি পানসি নৌকা, কিছু নগদ টাকা, ২টি বজরা, ১টি বাবুর্চীদের নৌকা, ডিঙ্গি, আমার পাল্কী এবং আমার অধিকাংশ আমলা পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে।

আজ সকালে যখন আমরা পান্সি ত্যাগ করি তখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী নয় এবং যথেষ্ট অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত নয়। কিন্তুউ, আমাদের এই তথ্য ছিল ভ্রমাত্মক। আমরা হাতিতে চড়ে ১২ থেকে ১৪ জন ডবল ব্যারেল বন্দুকধারী নিয়ে রওয়ানা হই। আমরা প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জন লোক দলে টানতে পেরেছিলাম। এরপর আমরা নারকেলবাড়িয়ার দিকে ফ্যাক্টরি থেকে দেড় মাইল পর্যন্ত অগ্রসর হই। কিন্তু আমরা প্রতিপক্ষের শক্তি অনেক বেশি বলে ধারণা করি। এরা আক্রমণের জন্য বেশ সংঘবদ্ধ মনে হয়। আমাদের শক্তি যথেষ্ট নয় মনে হওয়ায় আমরা যখন ফিরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করি, তখন বিদ্রোহীরা অত্যন্ত দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। এরা আমাদের দুইজন অনুসারীকে হত্যা করে কারণ এরা দৌড়াতে পারে নি। আমরা পানসিতে চড়ার সাথে সাথেই এরা তীরে লাইনবন্দি হয়ে আমাদের হত্যা করার চেষ্টা করতে থাকে। আমরা পানসি থেকে গুলি ছুঁড়লেও আশ্চর্যজনকভাবে এদের কোন ক্ষতি হয় নি। মাথা নিচু করে এরা গুলি এড়িয়ে নর্তন কুর্দন করতে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে মি. এণ্ড্রুজ জনগণকে গুলিবিদ্ধ করেন। তাঁর পোশাকের ধরন দেখে মনে হয় যে একজন সর্দার। এছাড়াও কয়েকজন গুলিতে আহত হয়। আমাদের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে। বিদ্রোহীরা নৌকাযোগে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। আমরা অপর তীরে নেমে দৌড়াতে থাকি। সৌভাগ্যবশত আমাদের হাতিগুলি পেয়ে যাই। এতে করে আমরা নিশ্চিত কচুকাটা হওয়া থেকে পরিত্রাণ পাই। পালিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের ফৌজদারি নাজিরকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয়। আমি এখনো আমাদের পথের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারি নি।

আমি ঘটনার সময় প্রত্যক্ষ করি যে বিদ্রোহী দলে কমপক্ষে ১০০০ থেকে ১৫০০ জন লোক রয়েছে। এরা সকলেই আশেপাশের গ্রামের সাথে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। আমি দ্বিধা না করে সরকারের কাছে আবেদন করছি যে এখনই যেন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিদ্রোহীদের ইছামতি নদীর সীমানার মধ্যেই প্রতিরোধ করা হয়। মি. এণ্ড্রুজের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিদ্রোহীরা বিশেষভাবে সক্রিয়। এই জেলার সম্পদ ও লোকজনের নিরাপত্তার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার যাতে এরা সদর স্টেশনের দিকে এগোতে না পারে।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ব্যারাকপুরের কমাণ্ডিং অফিসারের কাছে সরাসরি রিক্যুইজিশন পাঠাই একদল শক্তিশালী সৈন্য পাঠানোর জন্য। এই স্থানের ৭/৮ মাইল দক্ষিণে বনগাঁওয়ের দিকে যশোরের রাস্তায় সাথে সাথেই অগ্রসর হওয়ার জন্য আবেদন করি। বনগাঁও হল ইছামতি নদীর তীরে। কলিকাতা থেকে দেরীতে আসা একজন ফ্যাক্টরি কর্মীর কাছ থেকে এখনই জানতে পারলাম যে একজন কমিশনারের সাথে একটি সামরিক বাহিনীর দল কলিকাতা বা দমদম থেকে আসছে। এই দলটির প্রয়োজনীয়তা এখনই সবচেয়ে বেশি। এই দলটি উভয় দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়তা এখনই সবচেয়ে বেশি। কারণ ইতিমধ্যেই বিদ্রোহীরা দুইবার বেসামরিক শক্তিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। তাছাড়া বিদ্রোহীরা মি. এণ্ড্রুজের নৌকা দখল করে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে আছে।

বেসামরিক শক্তি সম্পূর্ণভাবে বিশৃংখল হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় আশেপাশের কোনো দারোগাই তাদের কর্মস্থলে নেই। এখন এই আতঙ্ক এলাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে লুট ও দুষ্কৃতিকারীদের জন্য পুরো এলাকাটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।

আমি আগামীকাল কৃষ্ণনগর পৌঁছার চিন্তা করছি। এই স্থান থেকেই আমি আমার দলের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারব। মি. এণ্ড্রুজ তাঁর সুবিধা অনুযায়ী যত শীঘ্র সম্ভব কলিকাতা যাওয়ার বিষয়ে ভাবছেন। কলিকাতায় তিনি ভাইস-প্রেসিডেন্ট-ইন কাউন্সিলের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবৃতি দেবেন। মি. এণ্ড্রুজ, মাদারল্যান্ড, ফ্যাকেন্ডি, গার্ডেন এবং হল সাথে সাথে যে সাহায্য করেছেন তাঁর জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং মি. এণ্ড্রুজের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাঁর জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।

আপনার বিশ্বাস ভাজন
স্বাক্ষর/ ই.পি.স্মিথ
ম্যাজিস্ট্রেট।

১২.
ফৌজদারি নথি ৬৯
(ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন-কাউন্সিলের কার্যবিবরণীর অংশবিশেষ। সামরিক বিভাগ, ১৬ নভেম্বর, ১৮৩১ নম্বর ২৩৯)।

সমীপে
ডেপুটি এডজুট্যান্ট জেনারেল, সামরিক বাহিনী,
সামরিক বিভাগ

মহোদয়,

সরকারের নিকট এই মর্মে নির্ভরযোগ্য সংবাদ এসেছে যে বারাসত ম্যাজিস্ট্রেসির অঞ্চলে একদল গোঁড়া ধর্মান্ধ জনসাধারণের উপর অত্যাচার করছে। স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন এদের দমন করার জন্য যে বাহিনী প্রেরণ করেছিল তা উক্ত বিদ্রোহীরা প্রতিরোধ করেছে। আমি ভাইস-প্রেসিডেন্ট-ইন-কাউন্সিলের নির্দেশে আপনাকে অনুরোধ করছি যে আপনি যাতে প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের জি ও সিকে সরকারের নির্দেশ জানিয়ে দেন। যাতে এই নির্দেশ হলে তিনি ব্যারাকপুর থেকে এক ব্যাটালিয়ন স্থানীয় পদাতিক সৈন্য, দুটি ৬ পাউণ্ডী কামান, দমদম থেকে প্রয়োজনীয় গোলন্দাজসহ একজন ফিল্ড অফিসারকে বারাসতে পাঠাতে পারেন। অনারেবল ভাইস প্রেসিডেন্টের এসকর্ট থেকে হাল্কা ঘোড়সোয়ার বাহিনীর ১২ জন সৈন্য এবং একজন হাবিলদার এদের সাথে যোগ দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

২. অফিসার কমান্ডিং এর সাথে ম্যাজিস্ট্রেট মিলিত হবেন। বারাসতে তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে এদেরকে তত্ত্বাবধান করবেন। দুষ্কৃতিকারীদের পরাজিত করে এবং প্রতিরোধ ধ্বংস করে জনগণের মাঝে শান্তিশৃংখলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কমান্ডিং অফিসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

৩. শেষে বলা হচ্ছে যে, প্রয়োজনে অধিক গোলাবারুদ ও কামান সরবরাহে পরিবহনের ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়া অধিক সাহায্য পাঠানো হবে।

৪. সৈন্যদলের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সব ধরনের সহায়তা ও রসদ সরবরাহ পরিচালনা করবেন।

১৬ নভেম্বর, ১৮৩১

আপনার বিশ্বস্ত
স্বাক্ষর/ ডব্লিউ কেইস মেল্ট কোল
সচিব/ সামরিক বিভাগ।

১৩.
একথা এখন মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে তিতা মিঞাকে হারানো গোরা সৈন্যেরও কম্মো না। তার দলের মিস্কিন শাহ ফকির নাকি কামানের গোলা মুখে মুখে গিলে খেয়ে ফেলতে পারে। এজন্যই কোম্পানীর সৈন্য আর গোরা নীলকররা এই নিয়ে তিনটা রণ… তিনটা জঙ্গে তিতা মিঞার দলবলের কাছে হেরে গেছে! বাপ রে, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দ্দি খাঁর নাতি সিরাজউদ্দৌলা যে গোরাদের সাথে ঘোড়া আর কামান নিয়ে লড়াই করেও হেরে গেছে, সেই গোরারা কিনা তিতা মিঞার দলের লাঠি-সড়কির সাথে কামান-বন্দুক নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চাষী আর তাঁতীদের বাদশাহী নদীয়া, বারাসত আর চব্বিশ পরগণায় প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। এই বাদশাহীর বাদশা তিতা মিঞা আর উজীর হলেন রুদ্রপুরের জোলা মইজুদ্দীন ও জমাদার হলো বাকের মণ্ডল। গরিব রায়তরা কেউ আর পাঁচ গাঁয়ের কোনো জমিদারকেই খাজনা দিচ্ছে না। হিঁদু জমিদারদের ভেতর মনোহর রায় একটু অন্য রকমের মানুষ। তিনি নীল চাষ করেন না। কাউকে দিয়ে নীল চাষ করানো পছন্দও করেন না। তিনি নিজে স্বয়ং তিতা মিঞার দলে যোগ দিয়েছেন। বৃটিশের উপর তেনার ম্যালা রাগ। রানাঘাটের পালচৌধুরী, ম্যাজিস্ট্রেট, জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় আর প্রাণনাথ চৌধুরীকে পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে, ‘দীন মহম্মদ বলে নতুন ধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে, কোম্পানির শাসন শেষ, তিতা মিঞার লোকেরাই মালগুজারি নেবে। রাজ্য এখন দীন মহম্মদদের। সময় মত রসদ দিলে তোমাদের শিরোপা দেওয়া হবে আর তিন মাসের খাজনা মকুব। তা না হলে তোমার কাছে ফৌজ গিয়ে লড়াই করবে।’ এই তো গত পরশু মাজেস্টে (ম্যাজিস্ট্রেট) স্মিথ সাহেব বনগাঁও হতে সাত/আট ক্রোশ উত্তরে মোলনাথ নীলকুঠি থেকে দেড় মাইল দূরে নারকেলবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে নদীতে পানসি চড়ে যখন রওনা করেন, তিতা মিঞার দল ইছামতী নদীর পার হতেই তাদের ধাওয়া করলো। স্মিথ সায়েবের সঙ্গের দু’শো/তিনশো মানুষের কাছে ছিল প্রায় খান চোদ্দ দোনলা বন্দুক। স্মিথ সাহেব, নীলকর ডেভিস অ্যান্ড্রুজ আর আরো দু’জন সাহেব ছাড়া বাকি সাহেব আর কিছু হিন্দুস্থানী সেপাই হাতির পিঠে আর পায়ে হাঁটা দিয়ে নারকেলবাড়িয়ার দিকে আসছিলো তিতা মিঞার দলকে ঠ্যাঙাতে! হায় কে কাকে ঠেঙ্গায়? উল্টো স্মিথ সায়েব আর তার সাথের ডেভিস অ্যান্ড্রুজ সায়েব নৌকা হতে তীরে দাঁড়ানো তিতা মিঞার লোকদের দিকে গুলি ছুঁড়লেও তারা মাথা নিচু করে লাফ দেয় আর গুলি সব ফস্কায়। আসলে তো ফকির মিস্কিন শাহ তার কেরামতি দিয়ে সব গুলি খেয়ে ফেলেন। রাণী ভিক্টোরিয়ার গুলি। এরপরে কিনা তিতা মিঞার লোকজন তীর হতে থান থান ইট আর কাঁচা বেল নৌকায় চড়া সাহেবদের উদ্দেশ্যে এমন ভাবে ছুঁড়তে লাগলো যে সাহেবরা যে যেভাবে পারে প্রাণে পালিয়ে বাঁচলো। সাহেবদের হাতি, পানসি নৌকা, সেপাইদের ফেলানো অস্ত্র-শস্ত্র সব তিতা মিঞার মুনিষ্যিদের হস্তগত হলো।

‘সাহেবের বাচা ভার, বে একতার কল্লে কাজে কাজে।
… … …
জানে বাচ যদি, সাহেব পালাও হাতি চোড়ে।।’

গর্ভনর জেনারেল স্বয়ং অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। পরপর দু’বার বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট এসে ক’জন গ্রাম্য লাঠি-সড়কিঅলার কাছে মার খেয়ে ফিরে যাবে, এর থেকে অসম্ভব অবাক করা আর কিছু হতে পারে না! ১৬ নভেম্বরই বারাসতে একটি ফিল্ড ব্যাটালিয়ন জমায়েত হয়েছে। মেজর স্কট হার্ডিং নেতৃত্ব দিচ্ছেন একাদশ স্থানীয় পদাতিক সৈন্যদলকে। ক্যাপ্টেন মাদারল্যান্ড অশ্বারোহী রক্ষী দল ও লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড গোলন্দাজ বাহিনীর দায়িত্বে। ১৮ নভেম্বর শুক্রবার রাতেই মি. আলেকজান্ডার ক্যাপ্টেন মাদারল্যান্ডের দেহরক্ষী দল ও একটি ক্যাভালরি বা অশ্বারোহী দল বাঁশের কেল্লার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই অশ্বারোহী দল রাতভর ভারি ভারি কামান বাঁশের কেল্লার কাছে টেনে নিয়ে গেছে। শনিবার সকাল নাগাদ বৃটিশ পদাতিক বাহিনীও পৌঁছে গেছে। মেজর স্কট হার্ডিং আর ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার বাঁশের কেল্লার সামনে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছেন। মেজর স্কট পকেট হতে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের করে জোরে পাঠ করলেন, ‘মহাশয়, ভারতবাসীর মহামান্য গভর্নর-জেনারেল আপনাকে সদলবলে গ্রেপ্তার করিবার জন্য পরোয়ানা দিয়াছেন। আপনি স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হইবেন কিনা জানিতে চাই!’

উত্তর এল না। মেজর হার্ডিং পতাকা নাড়লেন, ‘ফায়ার!’

…বাঁশের কেল্লার ভেতর হতে ততক্ষণে বৃষ্টিধারার মতো ইট, বেল ও তীর ছুঁড়ে আসছে। প্রশিক্ষিত সৈন্যদের রীতিমতো ভয় লাগছে।

মেজর হার্ডিং কর্কশ কণ্ঠে হেঁকে ওঠেন, ‘নো মার্সি সোলজারস্! নো পিটি, নো কন্সিডারেশন! ডেস্ট্রয় দিজ ডার্টি রায়তস!’ পকেট হতে রুমাল বের করে শ্বেত কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নেন তিনি। উফ, কী ভয়ানক নোংরা এই বাংলার চাষীরা! গত দুটো যুদ্ধে কোম্পানীর সৈন্যরা পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারার ভয়ে দয়া করতে যেয়েই ফাঁদে পড়েছে। এদের সাথে আর কোনো বিবেচনা নয়। আর দয়া-মায়া-ক্ষমা নয়। রক্তে ভেসে যাক, ভিজে উঠুক এ এলাকার মাটি। বৃটিশের পতাকা কিছুতেই নমিত হতে দেওয়া চলবে না।

দুম দুম শব্দ করে বিষ্ফোরিত হয়ে উঠলো কামান!

…তখন তিতা মিঞা… তিনি তাঁর বাঁশের কেল্লায় ধ্যানস্থ… তিনি কহিলেন, ‘তা চাষারা জমি চষপা না ক্যানো? কিন্তু, ফসল কি গোলায় নিতি পারো মিঞারা? নেয় তো জমিদার আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী!’ তিতা মিঞার চোখে ইছামতীর জল ছলছল করে। তিতা মিঞার চোখে খরার সূর্যেও আগুন ধবধব করে। আর, তখন বাঁশের কেল্লার ভেতরে সাজন গাজি আর তার দলের যত যুবক ছেলে… ধরো গে শাহগাজী চাষার ছেলে নূররাপ, সাতখানের ছেলে বাদল কারিগর, কালুর ছেলে কাইম, দিনাতের ছেলে নাকারি, হানিফের ছেলে মূলুক চাঁদ, বালতোরের ছেলে সাফি কারিগর, সাধুর ছেলে বায়োপার, কুশাইয়ের ছেলে রাফি, বরকতউল্লাহর ছেলে মাংলাই… সবার চোখেই জল ছলছল করে। সবার চোখেই আগুন ধবধব করে।

‘আজ এই নদে (নদীয়া), কুষ্টে (কুষ্টিয়া), সাতক্ষীরা, যশোর, চব্বিশ পরগণা, খুলনে (খুলনা) কি বারাসতের গাঁও কে গাঁও শুদু অভাব। যমুনা হতি ইছামতীর চরে চরে চাষার জমিতে চাষার ফসলে সবার হক আছে। শুদু চাষার কুনো হক নাই। অথচ, জমি কার?’

‘উপরে আল্লাহর আর নিচিতে চাষার!’

‘লাঙ্গল যার জমি তার! নীলির চাষ চলবি না — চিরস্থায়ী বাতিল করো — লাঙ্গল যার জমি তার! আজ যদি আমরা মারাও যাই কুনো ভয় নাই! মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি!’

শোন ছেপাই করি মানাজঙ্গেতে দিওনা হানা
জান মান করিয়ে সমার্পণ।

ভাই বন্ধু মেয়ে ছেলেসব মোরা এসেছি ফেলে
ঠিক করেছি কেবলই মরণ।।

ষোল টাকায় চাকরি করেএসেছ সব বন্দুক ধরে
খোয়ালি সব আখের আকরাত।

মেছের আলি ফকির ভারিদিন এছলাম করে জারি
তারে মারিবে কাফের কোন জাত।।

১৪.

ফৌজদারি নথি ৭৭

সমীপে

মান্যবর আই. থমসন
ডেপুটি সেক্রেটারি,
বিচার বিভাগ
ফোর্ট উইলিয়াম।
২০ নভেম্বর, ১৮৩১।

মহোদয়,
যথাবিহিত সম্মানের সাথে জানাচ্ছি যে আজ সকাল সাতটার সময় আমি বারাসতের অফিসিয়েটিং ডব্লিউ. এস. আলেকজান্ডারের একটি চিঠি পেয়েছি। উক্ত চিঠির একটি অনুলিপি ভাইস-প্রেসিডেন্ট-ইন-কাউন্সিলকে অবহিত করার জন্য প্রেরিত হল। এই চিঠিতে নারকেলবাড়িয়ার প্রতিপক্ষের পরাজয়ের সংবাদ রয়েছে। উক্ত স্থানে দুষ্কৃতিকারীগণ প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছে। তা সত্ত্বেও তাদের নেতা তিতুমীরসহ আরো ৫০ জন নিহত হন। এছাড়াও ৩০ জন আহত ও ২৫ জনকে বন্দি করা হয়।

২. আমার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেরিত বাহিনীর রসদের জন্য সরকারের সামরিক সচিব কর্নেল কেউজমেন্ট ব্যারাকপুরের কমান্ডিং অফিসারকে নির্দেশ দেন। ঐ স্থান থেকে প্রাপ্ত রসদ বারাসতে প্রেরণের কথা বলা হয় এবং আমি আরো রসদ সংগ্রহ ও প্রেরণের জন্য বারাসত যাওয়ার প্রস্তাব করছি।

৩. যশোরের ম্যাজিস্ট্রেট যাতে তাঁর আয়ত্তাধীন এলাকা থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রেরণ করে এবং তদারকির জন্য ঘটনাস্থলে যায় সে সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

৪. নিহতদের মরদেহ আমার মতে কোনো বাছবিচার না করে পুড়িয়ে ফেলা অথবা যা উত্তম বলে বিবেচিত হয় তা করা প্রয়োজন। এছাড়া বাঁশের কেল্লায় প্রাপ্ত সম্পদ নৌপথে বাওগণ্ডুতে নিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। এতে প্রাপ্ত সম্পদগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং প্রকৃত মালিককে ফেরত দেয়া যাবে।

আলীপুর আপনার অনুগত
কমিশনার অফিস ই, আর, বারওয়েল
২০ নভেম্বর, ১৮৩১। সার্কিট কমিশনার।

গোরা সৈন্যরা নারকেল বাড়িয়ার জঙ্গে চাষার বাদশাহ তিতা মিঞাকে গুলি করে মেরে ফেরেছিল। গোরারা তিতা মিঞার লাশটা পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলেছিল যাতে তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে ছোটজেতের মানুষদের আর কখনো আসমানের নিচে চাষার বাদশাহি গড়ার সাধ না হয়! এমন সাধের বাঁশের কেল্লা গোলায় গোলায় ভেঙে পড়েছিল। তিতা মিঞার ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হলো যে জায়গায় তাকে নাকি গাঁয়ের মানুষ এখন ‘ফাঁসতলা’ বলে ডাকে! ডাকতেও পারে। আলীপুরের জেলে বসে সাজন গাজি অত ডাক কি শুনতে পায়? বামুনের ছেলে হয়েও যে দেবকি পাঠক বাঁশের কেল্লার আখেরি জঙ্গ পর্যন্ত তিতা মিঞার দলে ছিল, মামলা চলার সময়েই সে পাগল হয়ে গেছিল। আহা দেবকির বড় সাধ ছিল যে তার পৈতৃক দেবোত্তর সম্পত্তিতে নীল চাষ তিতা মিঞা ঠেকাবেন। তাই তো বামুনের ছেলে মন্দিরে গোরক্ত ছিটানোর পরও তিতা মিঞার দল ছাড়ে নি! পাগল হবার পর মারাও গেল! তিতা মিঞার দুই ছেলের ভেতর বড় ছেলের জঙ্গে ডান হাত কাটা গেছিল আর ছোট ছেলে একদমই নাবালক ছিল বলে দু’জনই ছাড়া পেয়েছিল। বাঁশের কেল্লার সিথানে পতপত করে ওড়া কোরআনের আয়াত লেখা সবুজ পতাকাটাও বৃটিশ নিয়ে গেছে। মোট পঞ্চাশ জন সাথী মারা গেছিল সেই জঙ্গে আর সাজনদের মতো প্রায় সাড়ে তিনশো জনাকে কোমরে-পায়ে লোহার শেকল বেঁধে চব্বিশ পরগণা হতে সুন্দরবন পার করে আলীপুরের জেলে এনে পোরা হয়। দৈনিক বরাদ্দ মাত্র দুবেলা এক ছটাক করে চাল। সাজনের ছোট ভাই পাতলা বড় ভাগ্যবান। নারকেলবাড়িয়ার শেষ জঙ্গে চাষার বাদশাহ তিতা মিঞার সাথে আরো যে উনপঞ্চাশজনা মারা গিয়ে ভেস্ত নসীব হয়েছে, সে তাদের একজন। কিন্তু, সাজন তো মরলো না। সে বড় গোনাগার। দ্বিনের লড়াইয়ে তার হলো সাত বছর জেল খাটার সাজা। মা গোলেবকাওলি বিবি বহুদূর পর্যন্ত সাজনের পিছ পিছ কাঁদতে কাঁদতে আর বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এসেছিল।

‘তুমি যাও দিকি মা — অকুন যাও — আমারে যাতি দাও!’

‘পাতলা কই মরি গেলো — তুই কোতা যাস — ও সেপাই, মোর পুত্তুররে চাড়ি দাও!’

‘যা দিকি তুই মা বিটি কুনকানের! যা মা — আমার দ্বিনির লড়াইয়ে — জমির লড়াইয়ে সাজা হয়িচে — এতে কোন গোনা নাই!’

…একুন এই আলীপুর জেলের অন্ধকার দরজা-জানালার শিক গুনতে গুনতে তোমরাই কও, হে এই জঙ্গনামার পাঠকেরা, মুই সাজন গাজি আর কী করতি পারি এই ময়লা খাতাটায় জঙ্গের গানগুলো আর চাষার বাদশা তিতা মিঞার কতা সাজোয়ে-গুচোয়ে রাকা ছাড়া?

রচনা: আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০০৮

তথ্যনির্দেশ


০১. তিতুমির ও তার শিষ্যরা ইসলামের কঠোর শরিয়তি বা শরিয়তপন্থী সংস্কারকে মান্য করেছিল বলে এলাকার লৌকিক ইসলামপন্থীরা তাদের ‘শরাওয়ালা’ (বানানভেদে ‘সরাঅলা’ বা ‘সরাওয়ালা’) বলেও ডাকতো।

০২. তিতুমীরের সহযোদ্ধা ও গ্রামীণ গান রচয়িতা সাজন গাজির গানের খাতায় ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার সাহেবকে আলিজিন্দা সাহেব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

০৩. বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট।


a_falgun@yahoo.com

সেদিন তুষার ঝরেছিল

সেদিন তুষার ঝরেছিল
(স্মৃতিচারণ)
ইমতিয়ার শামীম


শহীদুল জহিরের মৃত্যুর পরপরই কোনও কিছু লেখার বেলায় আমার ব্যক্তিগত সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই হলো, তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি পরিচয় ছিল না। দশকওয়ারি সাহিত্যবিভাজনে বিশ্বাসী সম্পাদক ও আলোচকরা যাদের গায়ে আশির দশকের ছাপ লাগিয়েছিলেন, শহীদুল জহিরসহ আমাদের অনেকের গায়েই সেই ছাপ এতদিনে সুস্পষ্টভাবে বসে গেছে অনেকটা জন্মদাগের মতো। আক্ষরিক জন্মের কথা ধরলে তিনি আমার একযুগ আগে পৃথিবীতে এসেছেন। তবু এখন সম্পাদক ও আলোচকদের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি,–তাঁরা আমাদের একই সময়ের বৃত্তে আবদ্ধ করেছেন জন্যে। আশির দশকের উল্লেখযোগ্য সব লেখকের সঙ্গেই ধীরে ধীরে আমার পরিচয় হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু শহীদুল জহির। তাঁকে আমি মুখোমুখি দেখি নি। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয় নি।

কালাকালের অর্থে এই দেখা হওয়া না-হওয়া অবশ্য কোনও বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষ যখন বেদনার্ত হয় তখন মহাকালের কথা ভাবে না। মৃত্যুগন্ধী সময়ের আবেগই তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠে। এ জন্যেই হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির কথা বলতে গিয়ে হয়তো ব্যক্তিটির সঙ্গে স্মৃতিচারকের স্মৃতিগুলিই বড় হয়ে ওঠে। যতক্ষণ না তা হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটিকে অবলম্বন করে নিজেকেই বড় করে তোলার মতো না হয় ততক্ষণ তা দৃষ্টিকটূও নয়। সত্যিকার অর্থে মানুষটির প্রতি ব্যক্তিগত মুগ্ধতা ছাড়া এইসব সময়ে অন্য কোনও বয়ান খুব বেশি প্রীতিকর মনে হয় না। অথচ তেমন কোনও সঞ্চয়ই নেই আমার, যা দিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে একটু ব্যক্তিগত হতে পারি।

তারপরও কোনও না কোনওভাবে তিনি আমার ব্যক্তিগত আত্মার সঙ্গী। কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর পাঠক এবং আমরা একই সময়ের মানুষ। কারণ যে জনপদ আর মানুষগুলো তাঁর জনপ্রিয় সে রাতে পূর্ণিমা ছিল উপন্যাসে বেড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে বেশ ক’টি ছোটগল্পে, কাকতালীয়ভাবে হলেও তাঁর মতো আমিও সেই জনপদের মানুষ। তাঁর মতো আমারও পিতার ভিটে সিরাজগঞ্জ জেলাতে। তাঁর রায়গঞ্জ আমার চেনা জায়গা, চেনা ওই গোপন রাজনীতির ক্ষত ও ক্ষতি। ‘ক্ষত যত ক্ষতি তত’ এই সত্যেরই তো মুখোমুখি করেন তিনি তাঁর কথাসাহিত্যে। আমরা আমাদের শৈশব কৈশোরের দিনগুলোয় জনপদের সেই ক্ষত ও ক্ষতিকে দেখেছি রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে, অশ্রুপাতের মধ্যে দিয়ে। এমনকি যখন আমরা প্রায়উন্মূল হয়েছি সিরাজগঞ্জ থেকে এবং বিশেষত সিরাজগঞ্জ শহরবাসী কারও টেলিফোন পেলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি কারও মৃত্যু অথবা দুর্ঘটনার খবর পেতে, এই ক্ষত ও ক্ষতি তখন আরও ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়েছে। যেমন, এক সকালে এক বন্ধুর ফোন পেয়ে আমি জানতে পারি ফিরোজ মাস্টার খুন হয়েছেন। ফিরোজ মাস্টার ছিলেন সিরাজগঞ্জ জনপদে গোপন রাজনীতির এক কিংবদন্তি। গোপন রাজনৈতিক জীবন পেরিয়ে তিনি তখন একটি ডানপন্থী দলে যোগ দিয়ে নির্জন জীবনযাপনের পথ বেঁছে নিয়েছেন। প্রতিদিন রাতে খাওয়ার পর বাড়ি থেকে বের হন এবং হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটি কালভার্টের ওপর গিয়ে কিছুক্ষণ একা একা বসে থাকেন। এক রাতে তিনি হাঁটতে বেরিয়ে আর ফিরে আসেন না। তাঁকে উদ্ধার করা হয় নিহত অবস্থায়।

আরও একদিন গভীর রাতে খবর এলো, ভয়ানক এক গাড়িদুর্ঘটনা ঘটেছে বগুড়া মহাসড়কে। নিহত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও একদা গণবাহিনীর সংগঠক মির্জা আবদুল আজিজ ও ম. মামুন। গুরুতর আহত আরেকজন গণবাহিনীর সংগঠক ও জাসদ নেতা আবদুল হাই। ম. মামুন ছিলেন গোপন রাজনীতির কালে ফিরোজ মাস্টারের প্রিয় অনুসারী। যৌবনে কামারখন্দে দিনেদুপুরে এক পুলিশ অফিসার হত্যার দায়ে ম. মামুন অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যুক্ত হন স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাতে।

দূর থেকে এরকম যত মৃত্যুর খবর পেয়েছি কিংবদন্তিময় একটি সময়ের একেক সংগঠকের ততবারই কেন জানি মনে পড়েছে সে রাতে পূর্ণিমা ছিলর কথা। বললে হয়তো বিশ্বাস হবে না–কিন্তু ওই জনপদের অধিবাসী আমরা জানি, রায়গঞ্জ-কামারখন্দ-জামতৈল জনপদের কোনও কোনও এলাকার চেয়ারম্যান হওয়ার মানে জেনেশুনে নিজের মৃত্যু ডেকে আনা। অথচ সেই মৃত্যুর মোহে প্রতিবারই কেউ না কেউ নির্বাচন করে, চেয়ারম্যান হয় এবং কোনও এক রাতে অথবা দিনে খুন হয়ে যায়।

এও এক জাদুবাস্তবতাই বটে!

দুই.
ক্ষত ও ক্ষতি নিয়ে এইভাবে আমরা সিরাজগঞ্জ থেকে প্রায়উন্মূল হয়েছি, প্রায় সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছি সিরাজগঞ্জের সঙ্গে, পৃথিবীমুখী হয়েছি তারপর আমাদের প্রিয় মার্কেজের বুয়েন্দিয়ার মতো। মাকের্জের উপন্যাস শত বছরের নির্জনতায় গভীর এক ক্রান্তিকালীন সময় আছে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া সেখানে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে আবারও দূর অভিযানে বের হওয়ার। কিন্তু তার স্ত্রী উরসুলা কিছুতেই রাজি হয় না বসতি ত্যাগ করতে। বুয়েন্দিয়া তাকে বলে, দূরঅভিযানে যেতে তার কোনও অসুবিধাই নেই, কেননা ‘এখনও এখানে আমাদের কেউ মারা যায় নি। মরে মাটির তলায় আত্মীয় কেউ না শোয়া পর্যন্ত কোনও জায়গায় কারও অধিকার বা প্রেম জন্মায় না।’ সে কথা শুনে তার বউ উরসুলা শান্ত কঠিন কণ্ঠে বলে, ‘তা হলে আমি এখানেই মরব, যাতে তোমরা সবাই এখানেই থাকো।’ মানুষের মাটি, স্বদেশ ও বসতি গড়ে ওঠে এরকম সব বুয়েন্দিয়ার আত্মার শোক দিয়ে, এরকম সব উরসুলার হৃদয়ের শোক দিয়ে। শহীদুল জহিরের গ্রামের বাড়ি ছিল রায়গঞ্জে, কিন্তু তিনি জন্ম নিয়েছিলেন পুরানো ঢাকায়। নিজের এক বসতি তিনি স্থাপন করতে চেয়েছেন তাঁর সব গল্পউপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। সেইখানে কখনও তরমুজের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, ডালপুরিভাসা তেল টগবগিয়ে ফোটে, ইঁদুর ও বিড়াল খেলা করে, আবদুল করিম বারবার কাচের গ্লাস ভেঙে জানালার পাশে রাখে, পাতকুয়ায় সুবোধ চন্দ্র ও তার স্ত্রী স্বপ্না বারবার পড়ে যায়। কখনও আবার তিনি যেন বা জেনেশুনেই সংখ্যালঘু হয়ে যান, বিচ্ছিন্নতার বদলে ডুবে যান সংখ্যালঘুতার বিপন্নতায়। বিবিধ অঞ্চল ও আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি অবলম্বন করেছেন বিভিন্ন গল্পে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছেন সে রাতে পূর্ণিমা ছিল উপন্যাসের উপস্থাপনস্বর।

আমাদের সেই জনপদের একঘেয়ে মুথা ও মেঠো সমতল, খরখরে গ্রীষ্মের দাবদাহ সঞ্চয় করে রাখা প্রায়উৎপাটিত নিঃসঙ্গ বটগাছ, আঁকাবাঁকা মেঠোরাস্তা, অথবা বর্ষায় ডুবে যাওয়া রুপালি আকাশ, কর্দমাক্ত রাস্তা এবং একজন চেয়ারম্যান খুন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুন হওয়ার জন্যে প্রস্তুত আরও সব হবু চেয়ারম্যান, এসব কিছুই শহীদুল জহির একে একে কব্জা করে নিয়েছিলেন। তাঁর মতো আর কেউ জানে নি, এইসব জনপদ ও মানুষের গল্প সত্যিই গল্প মনে হয়। আমাদের গ্রামগুলোর মানুষের গল্প, জীবন, হতাশা, সংগ্রাম আর যৌনতাও এত বিচিত্র যে এই আমিও যখন তা এমনকি সিরাজগঞ্জেরই কাউকে শুনাই, শুনতে শুনতে তারা বলে, এইসব আজগুবি গল্প কোনখানে পাই’ছো? সলপের গল্প, না? ভেবে দেখুন, ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত একজন মানুষ দণ্ডিত হওয়ার পর্যায় এড়াতে গ্রামের সালিশে অজ্ঞান হয়ে গেল। কিছুতেই তার সংজ্ঞা আর ফিরিয়ে আনাই যাচ্ছে না। দাঁতের মধ্যে চামচ ঢুকিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে পানি খাওয়ানোর। কিন্তু সে পণ করেছে কিছুতেই কিছু খাবে না। হঠাৎ একজন কী মনে করে একগ্লাস দুধ এনে ঠোঁটের ওপর রাখতেই অজ্ঞান মানুষটা গরুর দুধের ঘ্রাণ পেয়ে ধর্ষণের দায়ে দণ্ডিত হওয়ার যাবতীয় আশঙ্কা ভুলে ঢক ঢক করে তা গিলে ফেলল। আবার এই মানুষটিই যখন প্রবীণ আর স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত, একদিন হঠাৎ তার পাড়াপড়শিদের সম্পর্কে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই যে ট্রেনে চড়ল, নিজের এলাকার নাম মনে না থাকায় সে আর পারল না নিজের বাড়িতেও ফিরে আসতে। গ্রামের মানুষদের কাছে সে বেঁচে রইল নিরুদ্দেশ এক গ্রামবাসী হিসেবে। কেউ আবার বুড়ো হয়ে গেল প্রচণ্ড বর্ষার সময় বোয়াল মাছের গ্রাসে অণ্ডকোষ হারানোর স্মৃতি নিয়ে। আবার যুদ্ধ যখন চলছে, তখন এমন একজন মানুষকে পাওয়া গেল, যে মৃত, অর্ধমৃত সব খানসেনা আর রাজাকারদের লিঙ্গ কেটে একটি টুকরিতে জমা করত। জালিম খানসেনা আর তার দোসরদের জন্মক্ষমতাই সে নষ্ট করে দেবে, এই তার একমাত্র আকাক্সক্ষা।

এরকম এক জনপদ যেখানে আছে সেখানে শুধুমাত্র জাদুবাস্তবতা দিয়ে শহীদুল জহিরকে বিচার করতে যাওয়া এক অর্থে তার প্রতি অবিচার করা। আমি অবশ্য তাঁর পাঠক হই অনেক পরে। সম্ভবত ১৯৯৩ সালে। মারুফ রায়হানের আগ্রহে মাটি পত্রিকার গল্পসংখ্যায় শহীদুল জহির লেখেন ‘আমাদের কুটিরশিল্প’, আমি লিখি ‘বালকের বামহাত’। ততদিনে তিনি জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা লিখে সুপরিচিত। কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটল গল্পপাঠক হওয়ার মাধ্যমে। তাঁর লেখার শক্তিমত্তা নিয়ে আমার কোনও সংশয় ছিল না, এখনও নেই; কিন্তু তাকে ‘জাদুবাস্তবতা’র ঘেরটোপে বন্দি করতে আমি বরাবরই দ্বিধান্বিত হয়েছি। অনেক পরে বাংলাপিডিয়াতে একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য পাই তাঁর সম্পর্কে, সেটিকেই বরং অনেক ঠিক মনে হয়। তাঁর লেখার অন্যতর একটি রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সেখানটাতে, বলা হয়েছে শহীদুল জহিরের সে রাতে পূর্ণিমা ছিলতে প্রকাশ পেয়েছে বাস্তবতা ও সুরিয়ালিজম।

এর মধ্যে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার বিশ বছর পার হয়েছে গত বছর। আমাদের বুর্জোয়া রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে যে রক্তাক্ত অধ্যায় তৈরি হয় এবং ক্রমাগত যা ধর্মাশ্রয়ী বিশ্বরাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় বিকৃত গণতন্ত্রচর্চার ধারা গড়ে তোলে, কবিতায় এই পরিস্থিতির একটি মনোজগত ও সংঘবদ্ধ ছায়া পড়ে শামসুর রাহমানের উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বইটিতে। কয়েক বছরের মধ্যেই সৈয়দ শামসুল হক লেখেন স্মৃতিমেধ নামের উপন্যাস, যাতে স্বাধীনতার দশ বছর পর শহীদ এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জিনাত এক রাজাকারকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সবাইকে অস্থির করে তোলে। বিস্মিত, আহত ও ক্রুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা দেবর মুখোমুখি হয় তার ভাবি জিনাতের। আর জিনাত নিজেই নিজেকে অপমানিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের জাগিয়ে তোলার প্রস্তুতি নেন এই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে, তোরা রাজাকারকে মন্ত্রী বানাতে পারিস, আমি পারি না স্বামী বানাতে? এই উপন্যাস পত্রিকায় ছাপা হওয়ারও বছরপাঁচেক পর ১৯৮৭-তে আমাদের হাতে আসে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। যাকে অনেকেই প্রথমে প্রবন্ধের বই মনে করে হাতে নেন, তারপর ‘ও’ বলে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন। এ বইটি থেকেই মূলত শহীদুল জহিরকে জাদুবাস্তবতার লেখক হিসেবে অভিহিত করা হতে থাকে। যদিও দর্শন হিসেবে জাদুবাস্তবতার চেয়ে অস্তিত্ববাদই এতে অনেক বেশি প্রকাশিত হয়েছে।

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কাহিনী লতিয়ে ওঠে ১৯৮৫ সালে, ঢাকার লক্ষীবাজার লেনে। এ কাহিনী প্রকৃতার্থে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির পথপরিক্রমার কাহিনী, যে রাজনীতি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর লুপ্ত হয়েছিল, ১৯৭৫-এর পর আবার ফিরে এসেছে মহাসমারোহে। যুদ্ধাপরাধী, যে প্রত্যয়টি ব্যবহারে ইদানিং আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, এক অর্থে তা অনেক বেশি নিরীহ। কেননা এই প্রত্যয়টি কেবল যুদ্ধের অপরাধকেই উচ্চকিত করে, ধর্মীয় রাজনীতির নিষ্ঠুরতা এ প্রত্যয়ে ঢাকা পড়ে যায়। অথচ একাত্তরের স্মৃতি, যন্ত্রণা ও অভিজ্ঞান থেকে আমাদের কাছে ধর্মীয় রাজনীতি যুদ্ধাপরাধের সমার্থক। রাজাকার, আলবদর বা আলশামস প্রত্যয়গুলির প্রয়োগ বরং তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেক ইতিহাসচেতনাজাত। যাই হোক, এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তারপরও মনে পড়ল, কারণ শহীদুল জহিরের এ উপন্যাসে বদু মওলানা খানসেনাদের দোসর, যে একাত্তরে মানুষকে চাপাতি দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে তার বাড়ির ছাদ থেকে জনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এই বদু মওলানারই ছেলে আবুল খায়ের তার পিতার চেতনাসমেত মহাসমারোহে ফিরে আসে লক্ষীবাজার লেনে। সে আবিষ্কার করে মেয়ের নাম মোমেনা রাখার মধ্যে দিয়ে এই মহল্লার এক অর্বাচীন প্রকারান্তরে তার প্রতি, তার আদর্শের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। কেননা একাত্তরে ওই অর্বাচীনের বোন মোমেনাকেই তো তারা ধর্ষণ করেছিল। তার মানে একাত্তরকে এ বান্দা ভুলে যায় নি। আবদুল মজিদ,–সে আবুল খায়েরকে ভাষণ দিতে দেখে এবং দ্বিধান্বিত হয় এবং দ্বিধার এই জগত ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার এই দ্বিধাকে আরও স্থায়ী করে এলাকাবাসী,–যারা বদু মওলানার ভয়ে ভীত–নিজেদের বাড়ি থেকে উৎপাটিত হওয়ার ও নির্যাতিত হওয়ার কিংবা আবারও চাপাতির কোপে খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার ভয়ে যাদের পক্ষে সম্ভব নয় আর জেগে ওঠা। সৈয়দ হকের স্মৃতিমেধ-এর সঙ্গে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কাহিনীর একটি শ্রেণিরূপ তফাৎ সুস্পষ্ট। স্মৃতিমেধ-এ পুরুষেরা, মধ্যবিত্ত পুরুষেরা, তাদের ওপর, তাদের নারীদের ওপর খানসেনা ও তাদের দোসরদের ধর্ষণ-নির্যাতন ভুলে গিয়ে একই শ্রেণীতে লীন হয়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত নারীটিকেই বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে হচ্ছে নিজের ইতিহাসগত অস্তিত্ব। আর শহীদুল জহিরের উপন্যাসে নিম্নধ্যবিত্ত পুরুষ তার অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা চালাচ্ছে তার আত্মার নিগড়ে বাধা এক নারীর স্মৃতিকে ঘিরে নতুন এক নারীর উদ্বোধনের মাধ্যমে।

শহীদুল জহিরের দ্বিতীয় উপন্যাস সে রাতে পূর্ণিমা ছিলও মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ের গল্প। অবক্ষয়িত সময়, গুপ্ত সব হত্যাকাণ্ড এসব এখানে শান্ত সমাহিত পূর্ণিমা রাতের নিচে। গোপন রাজনীতিতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে বুর্জোয়া ও সাম্যবাদী উভয় রাজনৈতিক শক্তিরই ধর্মীয় রাজনীতির কাছে পরাস্ত হওয়ার আখ্যান তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে এতে। সপরিবারে একটি হিন্দুপরিবারকে হত্যা করার অভিজ্ঞতাকে মূলসূত্র ধরে শহীদুল জহির এ ঘটনাকে নিজের সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে উন্নীত করেন এমন এক অভিজ্ঞানে, যার ফলে খুব সাধারণ পাঠকও বুঝতে পারেন এটি আসলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার রূপক উপাখ্যান। বন্যার স্রোতের মতো বাক্যের পর বাক্য বেরিয়ে আসে এ উপন্যাসে, প্রায়ই আমাদের মনে থাকে না কে এ সব বাক্যের কথক, লেখক নিজে নাকি কোনও চরিত্র, নাকি কোনও প্রতিচরিত্র। চাঁদের অমাবস্যা বিভ্রমও রয়েছে একইসঙ্গে। শহীদুল জহিরের আলোচকরা বিশেষত এ উপন্যাসটিকেই জাদুবাস্তবতার প্রামাণ্য বই হিসেবে উপস্থাপন করে আসছেন।

আমার মনে হয়, জাদুবাস্তবতার যোগ যতটুকুই থাক না কেন, শহীদুল জহিরের সাহিত্য আলোচনার জন্যে এ প্রত্যয়টি যথেষ্ট নয়। ২০০৫-এ বাংলা সাহিত্যের জাদুবাস্তবতাসংক্রান্ত এক লেখায়ও প্রসঙ্গক্রমে আমি লিখেছিলাম, “এইসব ছাপ ছাড়াও শহীদুল জহির টিকে থাকতে পারেন, তাঁর কথাসাহিত্যের একটি উপসংহার তৈরি করতে পারেন।” এ ছাড়াও লিখেছিলাম, ‘‘যে জন্যে তাঁর লেখার প্রতি আমাদের মনযোগ ও মোহাচ্ছন্নতা তৈরি হয় তা হলো লোকজ উপাদান, ভূগোলের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ এবং একই প্রসঙ্গে ঘুরপাক খাওয়ার মতো গ্রামীণ (গ্রাম্য নয়) ভাষাভঙ্গি। বিশেষত এই ভাষাভঙ্গির কারণে নগরের কাহিনীতে প্রবেশ করার পরও শহীদুল জহির পাঠকের কাছে স্বস্তিকর মনে হয়, কেননা আমরা আসলে নিজেদের মধ্যে পরিক্রমণ করতেই ভালবাসি এবং এই ভাষাভঙ্গি পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে অপার এক দুলুনি তৈরি করে। কিন্তু এসবের পাশাপাশি ইতিহাসবোধের প্রতি উপেক্ষা অথবা অমনোযোগ শহীদুল জহিরের লেখা ও অনুভূতির বিস্তৃতিকে সীমিত করে ফেলতে পারে, যা আমরা বিশেষ করে তাঁর সব উপন্যাসেই লক্ষ্য করি। তাঁর জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা কিংবা সে রাতে পূর্ণিমা ছিল উপন্যাসে আমরা একটি জাতির জাদুবাস্তবতাময় ক্রান্তিকাল খুঁজে পাই বটে, কিন্তু তা কি আমাদের মধ্যে সেই জাতির হাজার বছরের মিশে যাওয়া ইতিহাসবোধের ক্ষরণ ঘটাতে পারে? না কি আমরা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থেমে গিয়ে সীমিত এক পরিসরেই আনন্দিত হতে থাকি?’’ তাঁর মুগ্ধ পাঠকদের দলে থেকেও এ রকম একটি মন্তব্য করায় তিনি কী মনে করেছিলেন, সেটি আমার আর কোনওদিনই জানা হবে না।

তিন.
মৃত্যুগন্ধী এই সময়ে পুরানো ওই অনুভূতিটুকু আবারও উল্লেখ করছি শুধু এ কারণেই যে অপরিচয়ের বদলে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাই যৌক্তিক ছিল আমার চিন্তাগুলোকে আরও পরিণত করতে। যদি আমার তাঁর সঙ্গে পরিচয় হতো, যদি আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতাম, তা হলে নিশ্চয়ই তাঁর লেখার এরকম সব দিকই হতো তাঁর ও আমার আলোচনার বিষয়। এখন তাঁর সঙ্গে আর কারোরই দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। যদিও কবি সমুদ্র গুপ্তের সঙ্গে যতবার দেখা হবে ততবারই আরও বেশি করে আমার মনে হবে তাঁর কথা এবং হয়তো আনমনে চেষ্টা করব একই বংশোদ্ভূত দুজনের চেহারার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উদ্ঘাটনের।

এমন হয়েছে, কয়েকবারই আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে আমাদের বন্ধু গল্পকার ও সরকারি কর্মকর্তা ফয়জুল ইসলামের কারণে। আমি আগ্রহী হয়েছি সেই মানুষটিকে দেখতে, যার বিছানা বরাবর একটি টিভি এমনভাবে প্রতিস্থাপন করা যাতে মানুষটি শুয়ে থেকেও আরাম করে রিমোট ঘুরিয়ে টিভি দেখতে পারে। তাঁর সম্পর্কে ওপরের স্পর্শকাতর বিভিন্ন সব বাক্য লেখার ও ছাপানোর পর আমি তাঁকে আমার তখনকার সর্বশেষ বইটি (মাৎস্যন্যায়ের বাকপ্রতিমা) পাঠাই পাঠ করতে। এবং কয়েকদিন পরে উত্তেজিত কিংবা নিরুত্তেজিত ফয়জুল ইসলাম আমাকে বলে, ‘স্যার তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।’ এই বলাবলি বেশ কয়েকবার ঘটে, আবদুল করিমের গ্লাস ভেঙে জানালার পাশে রাখার মতো। কখনও আমি হাসি, ‘যেতে তো হবেই, আপনি ওনাকে স্যার বলেন, আর আমি তাকে ভাই বলব। আপনি কীভাবে স্যার বলেন সেটা তো আমাকে দেখতে হবে।’ কখনও ফয়জুল আমাকে শোনায়, শহীদুল জহির কার কার লেখার প্রশংসা করেছেন। শুনতে শুনতে বলি, ‘বড় লেখকরা সব সময়েই প্রশংসা করেন। এমনকি খারাপ লেখকদের লেখায়ও মহৎ উপাদান খুঁজে পান। উত্তেজিত হবেন না, ধৈর্য হারাবেন না।’ আসলে যদি আমাদের যাওয়া হতো তা হলে কী নিয়ে কথা বলতাম আমরা? এই জাদুবাস্তবতার ঘোর? অথবা অস্তিত্ববাদ? অথবা বাস্তবতা ও সুরিয়ালিজম? অথবা এসব কিছুই নয়! আমরা কথা বলতাম দুর্ধর্ষ নকশালী ইসমাইলকে নিয়ে, বাংলাদেশের পতাকা যে সবসময় মাথায় বেধে রাখত মাথায় যুদ্ধকালে আর স্বাধীন সিরাজগঞ্জ শহরে প্রথম প্রবেশ করেছিল যার বাহিনী। অথচ পরে যে পুরো বাহিনীই খুন হয়ে গেল নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ করে! হয়তো কথা বলতাম ফিরোজ মাস্টারকে নিয়ে, গণবাহিনী নিয়ে, গোপন রাজনীতি নিয়ে, ধর্মজ রাজনীতির হিংস্র কদর্য মানুষগুলিকে হত্যা না করে কেন গোপন রাজনীতির মানুষগুলো কেবল নিজেদের মধ্যেই হানাহানি করেছে সেসব নিয়ে। আর মুক্তিযুদ্ধ,–সে কথাও নিশ্চয়ই উঠত। বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার দুর্বলতার কথা কে না জানে! আর এই জন্যে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পোস্টিং দিলে তিনি বিব্রতও হয়েছিলেন ভীষণরকম।

প্রবাদ হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত, নিজেকে শহীদুল জহির সরিয়ে রেখেছিলেন আর সব লেখক থেকে অনেক দূরে। কিন্তু মানুষ থেকেও কি? যাকে তাঁর একাকীত্ব ও নির্জনতা বলছি তাকে কি আমরা ব্যাখ্যা করব শুধু লেখকদের আড্ডায় তাঁর অনুপস্থিতির তত্ত্ব দিয়ে? রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা পান করতে করতে তিনি কি শুনতেন না মানুষের কথা? এই যে এত মানুষ, এত চরিত্র, এত অঞ্চলভাষা তা তিনি পেলেন কোথা থেকে? বেশ কয়েক বছর আগে কথা পত্রিকায় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের নেয়া তাঁর একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। উত্তর দেয়ার ভাষাভঙ্গি থেকে মনে হয়েছিল, মানুষ থেকে তিনি যত নির্জনে ছিলেন বলে শোনা যায় তত নির্জনে ছিলেন না সম্ভবত। মিডিয়া থেকে দূরে ছিলেন এবং এই দূরত্বই তাঁকে এ ছাপ এঁটে দিয়েছে। কেননা লেখক হিসেবে মিডিয়ার প্রতি অনেকের যে দাসত্ব রয়েছে, শহীদুল জহিরের দাসত্বহীনতা সে ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয়, অনুকরণীয়। দাসত্বের গ্লানি ঢাকার জন্যে তাঁকে তাই ঠেলে দেয়া হয়েছে নির্জনতার প্রকোষ্ঠে।

শহীদুল জহিরের কাছে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না, কেননা মোটা দাগে বলতে গেলে ফয়জুল ইসলামের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ কমে এসেছিল। কেন, সেটা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে দূরত্বও অনেক দূরত্ব কমিয়ে আনে। ফয়জুলই আমাকে তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানালেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আমি সেই মৃত্যুর দৃশ্যকল্পের অনেকটাই অনুমান করতে পারলাম, কেননা আমি নিজেও দীর্ঘকাল একা থাকতে অভ্যস্ত ছিলাম। আমি দেখতে পেলাম, একজন মানুষ ভর দুপুরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। মুগ্ধ পাঠকদের কেউ কাছে নেই, পদাধিকার বলে অনেক ক্ষমতা থাকলেও সেই সময় ‘জ্বি স্যার’ বলার মতো কেউই তাঁর কাছে নেই। তিনি অনেক কষ্টে সিড়ি ভেঙে ভেঙে নামতে নামতে একসময় নোংরা সিঁড়িতেই বসে পড়লেন। দুপুরের উজ্জ্বল আলো পৃথিবীর সবখানে। ইস্কাটনের ওইসব সরকারি বাসাগুলো দেখার ভাগ্য আমাদের অনেকেরই আছে। তিনি তাঁর অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা করছেন চারপাশের উজ্জ্বল আলোর কাছে। চেষ্টা করছেন বসন্তের বাতাস টেনে নিতে অবাধ্য বুকের ভেতর। অপেক্ষা করছেন নিজস্ব এক জাদুবাস্তবতার। টেলিফোন করছেন বোনের ছেলের কাছে। কিন্তু ঘুমন্ত মানুষের কানে রিংটোন খুব সহজে পৌঁছায় না, তা সে যত আপনই হোক না কেন। কেউ তার কোনও কাজে আসে নি, কেবল তাকে মানুষ ভেবে হঠাৎ করেই তাকে দেখে ছুটে এসেছে ‘সামান্য’ এক কাজের মানুষ। সে তাকে রিকশায় করে হলি ফ্যামিলিতে পৌঁছে দিয়েছে। তারপর ডাক্তারদের প্রসঙ্গ না হয় থাক। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরা তাঁর অনেক নিঃসঙ্গতা ও মহীয়ানতার সন্ধান পেয়েছি, তিনি তাই নিয়ে বেঁচে থাকুন এই পৃথিবীতে।

চার.
ইংল্যান্ডে তুষার পড়লেও লন্ডনে তুষারপাত বিরল এক ঘটনা। গত গুড ফ্রাইডে’তে হঠাৎ করেই ঘোষণা আসে, আগামীকাল থেকে তুষার পড়তে পারে। ওই রাতে আমি অনেকদিন পর সিগারেট কিনি আসন্ন হিমের আশঙ্কায়। শনিবার সকালে দেখি, সত্যিই এই মার্চের মধ্যে, যখন সামার খুব কাছে চলে এসেছে, ঝির ঝির করে তুষার পড়ছে আকাশ থেকে। পরদিন রবিবার, সকাল নয়টা পেরিয়ে গেছে আর তখনও আমি শুয়ে, স্ত্রী বাইরে থেকে টেলিফোন করে আমাকে আবারও তুষারপাতের খবর জানায়। আমি ওঠার পর জানালা খুলে মুখে একটু বরফ মেখে অভ্যাসবশত ই-মেইল চেক করতে বসি এবং ইনবক্সের প্রথমেই চোখ আটকে যায় ফয়জুল ইসলামের চিঠিটিতে : ‘শহীদুল জহির হ্যাজ ডায়েজ টুডে: লাইফ ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান ডেথ।’ আমার চ্যাটিংবক্সে লালবৃত্ত জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু মাহবুব মোর্শেদ সেই লাল বৃত্ত পেরিয়ে একই মেসেজ দেয়। আমি এইসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জানালার পাশে এসে দাঁড়াই।

দেখি সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ করে আমার প্রিয় বাংলাদেশের কার্পাস তুলোর মতো পেঁজা পেঁজা শাদা শাদা নৃত্যরতা তুষার ঝরে পড়ছে, গলে পড়ছে জানালার কাচে, রাস্তার ওপরে, লাইটপোস্টের গায়ে, ওক আর চেরিনাস্ট গাছের গায়ে। মনে হচ্ছে, যে প্রকৃতি এতদিন নীরবে তার সঙ্গী ছিল সেই প্রকৃতি আজ ভেঙে পড়ছে শহীদুল জহিরের শোকে। এই কদিন আগেই এক প্রিয় মানুষকে আমি লিখেছিলাম, মানুষকে বা হাতের উল্টো পিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়। আজ আমিও সেই চেষ্টা করি, কাঁপা কাঁপা হাতে তুষারের দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে সিগারেট জ্বালানোর চেষ্টা করি, মনে মনে বলি, যিশু চলে গেছেন, যিশু তুষারে ঢেকে যাচ্ছেন।

http://arts.bdnews24.com/?p=1282#more-1282
১০ চৈত্র ১৪১৪/ ২৪ মার্চ ২০০৮