Wednesday, December 31, 2008

সাহিত্যের ছোট কাগজ প্রাণস্রোত বইমেলায় বের হচ্ছে

সাহিত্যের ছোট কাগজ প্রাণস্রোত বইমেলায় বের হচ্ছে-

ছয় বছর পর আবার প্রকাশিত হচ্ছে সাহিত্যের ছোট কাগজ প্রাণস্রোত। এবারের প্রধান বিষয় বুদ্ধদেব বসু জন্মশতবার্ষিকী। প্রবীণ ও তরুণদের বুদ্ধদেব মূল্যায়ন প্রকাশিত হবে। থাকছে শুন্য দশকের পাঁচজন কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলাচনা। এবং কবিতা।

Sunday, December 28, 2008

সন্তোষ রায়ের কবিতা

সন্তোষ রায়ের কবিতা
জমিন

অনুরোধ করি না কাউকে; দেবতাকেও না।
বলি না, একখণ্ড মাটি দাও।
বাবা ছিলেন মাটির মানুষ, তারই
দান আমি।

শুতে গেলে মনে হয়- একখণ্ড জমিন পড়ে আছি-
দু'দিকে বিবদমান মানুষ, মাঝখানে আমি আলবাঁধা।

কাদা নিয়ে উঠে আসি।
আমি কি খাই? আমার কোন শেকড় নাই।
ব্যথা কি পাই? আমার কোন তন্ত্র নাই,
মন্ত্র নাই।

মা, তুলসীতলার প্রদীপ।
দেখেন, বোঝেন সব।
চোখ বুজে কা'র জন্যে অনুরোধ করেন, আমি জানি না।

আমি অনুরোধ করি না কাউকে
দেবতাকেও না।

Thursday, December 25, 2008

সুবোধ ঘোষের প্রবন্ধ


সুবোধ ঘোষের প্রবন্ধ
নতুন ক'রে পাব বলে


আদিযুগ আর নবতম যুগ, রূপের দিক দিয়ে এই দূয়ের মধ্যে ভিন্নতা আছে, কিন্তু এই ভিন্নতা নিশ্চই বিচ্ছেদ নয়। নবতমের মধ্যে হোক, আর পুরাতনের মধ্যে হোক, শিল্পীর মন সেই এক চিরন্তনেরই রূপের পরিচয় অন্বেষণ ক'রে থাকে।শিল্পীর সাধনা হলো নতুন ক'রে পাওয়ার সাধনা। শুধু পথ চাওয়াতেই আর চলাতেই শিল্পীর আনন্দ নয়, নতুন ক'রে পাওয়ার আনন্দও শিল্পীর আনন্দ। আদিযুগের রূপকে এই জগতে আর একবার পাওয়া যাবে না ঠিকই, কিন্তু আদিযুগের রূপকে নতুন ক'রে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা শিল্পী ছাড়তে পারেন না। কারণ, সেই পুরাতনের রূপের সঙ্গে একটি অখণ্ড আত্মীয়তার ডোরে বাঁধা রয়েছে নবতম যুগের মানুষেরও জীবনের রূপ।
জীবনের রূপ সম্বন্ধে এই অখণ্ডতার বোধ হলো কবি শিল্পী ও সাধকের মহানুভূতি এবং এই মহানুভূতিই মানুষজাতির শিল্পে ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেখানে সবচেয়ে কেশি স্পষ্ট ও সুন্দর আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে সেখানেই আমরা পেয়েছি ক্লাসিক গৌরবে মণ্ডিত সাহিত্য ও শিল্প। ক্লাসিক-এর রূপ ও ভাব খণ্ডকালের মধ্যে সীমিত নয়। কালোত্তর প্রেরণার শক্তিতে সঞ্জীবিত হয়ে আছে কবি বাল্মীকির রামায়ণ এবং ব্যাসদেবের মহাভারত। বিশেষ কোন জাতির জীবনের রীতিনীতি ও ঘটনা অথবা বিশেষ কোন যুগের ইতিহাসের উত্থান-পতনের ঘটনাকে আশ্রয় করে রচিত হলেও বিশ্বের ক্লাসিক সাহিত্যকীর্তিগুলির মধ্যে মানবজীবনের চিরকালীন আনন্দ হর্ষ ও বেদনার ব্যাকুলতা বাঙ্ময় হয়ে রয়েছে। ভোরের সূর্যের মত এই মহাপ্রাণময় কাব্য ও শিল্পরীতিগুলি মানুষের মনের আকাশে নিত্য নতুন আলোকের প্রসন্নতা ছড়ায়। তাই প্রতি জাতির সাহিত্যে দেখা যায় যে, নতুন কবি ও শিল্পীরা জাতির অতীতের রচিত মহাকাব্য গাথা সঙ্গীত ও শিল্পরীতি থেকে প্রেরণা আহরণ করেছেন।
কিন্তু ক্লাসিকের রূপ ও ভাবের ভাণ্ডার থেকে আহৃত উপাদান দিয়ে রচিত এই নতুন সৃষ্টিগুলি সম্পূর্ণভাবে আধুনিকতম নতুন সৃষ্টিরূপে পরিণতি লাভ করে, পুরাতনের পুনরাবৃত্তি হয় না। ইওরোপীয় সাহিত্য ও শিল্পে বিভিন্ন কয়েকটি রেনেসাঁর ইতিহাস লক্ষ্য করলেও এই বিস্ময়কর নিয়মের সত্যতা আবিষ্কৃত হয় যে, আধুনিক কবি ও শিল্পীর হৃদয় পুরাতনেরই মহাপ্রাণময় কাব্য ও শিল্পের রূপগরিমার সাযুজ্য লাভ করে বিপুল নতুনত্ব সৃষ্টির অধিকার লাভ করেছিল। এই সাফল্যের অন্তনির্হিত রহস্য বোধ হয় এই যে, ক্লসিকের অনুশীলনে কবি ও শিল্পী সহজেই সেই দৃষ্টিসিদ্ধি লাভ করে থাকেন, যার ফলে জীবনের রূপকে যুগ হতে যুগান্তরের প্রবাহিত এক অক্ষান্ত ও অখণ্ড রূপের ধারা বলে সহজে উপলদ্ধি করা যায়।
বিশ্বের ক্লাসিক সাহিত্য এই উপলদ্ধির বাণীময় রূপ। তাই ক্লাসিক-এর অনুশীলন সহজে মানুষের চিত্তের ভাবনাকে প্রকৃত রূপসৃষ্টির রীতিনীতি ও পথ চিনিয়ে দেয়। এক কথায় বলতে পারা যায়, ক্লাসিক সাহিত্য ও শিল্পরীতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়া জীবনের রূপকে নতুন করে নিকটে পাওয়ার উপায়।
মহাভারতের মূলকাহিনী ছাড়া আরও এমন শত শত উপাখ্যানে এই গ্রন্থ আকীর্ণ যার মূল্য সহস্র বৎসরের প্রাচীনতার প্রকোপেও মিথ্যা হয়ে যায়নি। কারণ, ব্যক্তির ও সমাজের মন এবং সম্পর্কের যে-সব সমস্যা মহাভারতীয় উপাখ্যানগুলির মূল বিষয়, সে-সব সমস্যা বিংশ শতাব্দীর নরনারীর জীবন থেকেও অন্তর্হিত হয়নি। নরনারীর প্রণয় ও অনুরাগ, দাম্পত্যের বন্ধন বাৎসল্য ও সখ্য- শ্রদ্ধা ভক্তি ক্ষমা ও আত্মত্যাগ ইত্যাদি যে-সব সংস্কারের উপর সামাজিক কল্যাণ ও সৌষ্ঠব মূলত নির্ভর করে, তার এক-একটি আদর্শৌচিত ব্যাখ্যা এইসব উপাখ্যানের নায়ক-নায়িকার জীবনের সমস্যার ভিতর দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। শত শত ব্যাক্তি ও ব্যাক্তিত্বের যে-সব কাহিনী মহাভারতে বিবৃত হয়েছে তার মধ্যে এই বিংশ শতাব্দীর যে-কোন মানুষ তাঁর নিজের জীবনেরও সমস্যার অথবা আগ্রহের রূপ দেখতে পাবেন। এই কারণে শতেক যুগের কবিদল মহাভারত থেকে তাদেঁর রচনার আখ্যানবস্তু আহরণ করেছেন।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ক্লাসিক সাহিত্যের তুলনায় ভারতের ক্লাসিক এই মহাভারত কিন্তু একটি বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র। এই মহাভারতই বস্তুত ভারতের সাধারণ লোকসাহিত্যে পরিণত হয়েছে।ভারতের কোট কোটি নিরক্ষরের মনও মহাভারতীয় কাহিনীর রসে লালিত। ভারতীয় চিত্রকরের কাছে মহাভারত হলো রূপের আকাশপট, ভাস্করের কাছে মূর্তির ভাণ্ডার। গ্রাম-ভারতের কথক ভাট চারণ ও অভিনেতা, সকল শ্রেণীর শিল্পী মহাভারতীয় কাহিনীকে তার নাটকে সংগীতে ও ছড়ায় প্রাণবান করে রেখেছে। মহাভারতের কাহিনী এবং কাহিনীর নায়ক-নায়িকার চরিত্র ও রূপ ভারতীয় ভাস্কর স্থপতি চিত্রকার নট নর্তক ও গীতিকারের কাছে তার শিল্পসৃষ্টির শত উপাদান, ভাব, রস, ভঙ্গী, কারুমিতি ও অলংকারের যোগান দিয়েছে। মহাভারত গ্রন্থ প্রতিশব্দ উপমা ও পরিভাষার অভিধান। ভারতের জ্যোতির্বিদ মহাভরতীয় নায়ক-নায়িকার নাম দিয়ে তাঁর আবিষ্কৃত ও পরিচিত গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহের নামকরণ করেছেন। আকাশলোকের ঐ কালপুরুষ অরুন্ধতী রোহিনী চন্দ্র বুধ ও কৃত্তিকা, কতগুলি জ্যোতিষ্কের নাম মাত্র নয়- এরা সকলেই এক-একটি কাহিনীর, এক-একটি প্রীতি ভক্তি ও রোমান্সের নায়ক-নায়িকা। গঙ্গা নর্মদা যমুনা ও কৃষ্ণবেনা- কতগুলি নদীর নাম মাত্র নয়, ওরাও কাহিনী। ভারতের বট অশোক শাল্মলী করবী ও কর্ণিকার উদ্ভিদ্ মাত্র নয়, তারাও সবাই এক-একটি কাহিনীর নায়ক ও নায়িকা। নৈসর্গিক রহস্য ও মেরুজ্যোতির অভ্যন্তরে কাহিনী আছে, সামুদ্র বাড়বানলের অন্তরালে কাহিনী আছে, সপ্তাশ্বযোজিত রথে আসীন সূর্যের উদয়াচল থেকে শুরু করে অস্তাচল পর্যন্ত অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে কাহিনী আছে। মহাভারতীয় কাহিনীর নায়ক-নায়িকার নাম হলো ভারতের শত শত গিরি পর্বত নদ নদী ও হ্রদের নাম। ভারতীয় শিশুর নামপরিচয়ও মহাভারতীয় চরিত্রগুলির নামে নিষ্পন্ন হয়।

(ভারত প্রেমকথা/ মুখবন্ধ, ১৪০২ বঙ্গাব্দ)

তুষার গায়েনের কবিতা

তুষার গায়েনের কবিতা
যে রূপ আমি শুনিলাম কানে

মালিনী মাসির হাসি, নিলাজ গুঞ্জন তুলে আনে
আনন্দিত শিহরণ এই ভীত মনে- সরোবরে
ছায়া প’ড়ে আছে তার এ অমোচনীয় আঠার প্রলেপ
বায়ুযোগে ঢেউ উঠে গোল হয়ে, সরে যায় দূর
গোলাকার তলে- তবু রূপ তার হাসিতে অনড়
বেড়ালের মত এই অপরাহ্ণ বেলা!

নিবিড় নৈঃশব্দ চারিদিকে, ফুল ফোটাবার যত
আয়োজন গাঢ় প্ররোচনা করে যায় ঝিঝিদেঁর
দল, জোনাকিও জোটে এসে- জ্বলে নেভে ঈর্ষাতুর
দূর তারাদের দেখে। যে গেছে চন্দনবনে-

মাসি! তাঁর চোখ তুমি বেঁধে রাখো কেন?
সুরভি কি ঢেকে যায় বলো, আঁচলের তলে?
সখির কাঞ্চনরূপ কালির কলঙ্কে বুঝি মোছে!
হয়েছে, হয়েছে মাসি, তাঁকে দূর থেকে ভালবাসি
দেখি নাই যাকে কোনদিন, তবু তার রূপের কীর্তন
তাঁর, আমি শুনেছি তো কানে!

মাসুদ খানের কবিতা

মাসুদ খানের কবিতা
সোনার খনির খুব কাছে

সোনার খনির খুব কাছে গিয়ে বসে থাকে রোজ
স্বর্ণজরে ভোগা রোগামতো একটি মানুষ।
পাশেই জলধি এক, অথই অপার।
শামুকে শ্যাওলায় মাখামাখি
আশ্চর্য সোনালী এক শৈবালিনী জেগে ওঠে যদি,
আকার ও অলংকারসহ,
কোনো এক মৎসগন্ধা সন্ধ্যাবেলায়-

সেই লোভে লোকটা এসে বসে থাকে মোহ-লাগা সারাটা দিবস...

(*সরাইখানা ও হারানো মানুষ,২০০৬)

Wednesday, December 24, 2008

তিনিঃ বুদ্ধদেব বসু সমীপে/ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

তিনিঃ বুদ্ধদেব বসু সমীপে/
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

তাঁর সংগে আমাদের সম্পর্কে ছিলো না জটিলতা
তিনি খুব সোজা করে দেখাতেন কীভাবে বাড়ির
বাহিরে পা দেবে, আর ঘুরে আসবে বাড়ির ভিতরে
তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে ছিলো না জটিলতা।
কিন্তু একদিন তাকেঁ কী রকম অচেনা বোধ হলো-
হয়তো হেমন্ত তাকেঁ ছুয়েঁ গেছে, মন ভালো নেই...
এরকম নিচু স্বরে কথা কননি কখনো
হয়তো হেমন্ত তাকেঁ ছুয়েঁ গেছে, মন ভালো নেই...

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ
শেষ দিনটি
(বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর স্মৃতি)

আমি কখনো কোনো শোক মিছিলে যাই না। শুধু, সুধীন্দ্রনাথ মারা গেলে তাঁর শবের অনুগামী হয়েছিলুম। তাঁর ছাত্র ছিলুম তথন, যাদবপুরে। বুদ্ধদেব আমাদের বিভাগের প্রধান ছিলেন তখন। তারপর অনেকেই গেলেন- প্রায় সকলেই অপ্রত্যাশিতভাবে গেলেন। নারায়ণবাবু চলে গেলেন, শান্তিদা- শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন হঠাৎ, নরেনদা গেলেন। তার কিছুকাল আগেই গেছেন বুদ্ধদেব। শেষ গেলেন অচিন্ত্যকুমার আর ঋত্বিক। এঁরা আমার চেনাশুনো, আপনার জন। আপনার জনের এই হঠাৎ-যাওয়া আমি সহ্য করতে পারি না। কিন্তু, সহ্য করতেই হয়। আমি শুধু যা পারি, তা এই শবানুগমনে না থাকা। শ্রাদ্ধশান্তিতে যোগ না দেওয়া। পালিয়ে-যাওয়া মানুষের সঙ্গে কোনো সংশ্রব না থাকুক- এই চাই।
বুদ্ধদেব নেই- আকাশবানী থেকে প্রচারিত সংবাদটুকু শুনে বালিশে মুখ গুজেঁ শুয়ে পড়েছি- তখন সকাল। জানালা-দরোজা বন্ধ করে অন্ধকার বানিয়েছি। শুয়েই ছিলাম, আমার বন্ধুরা এসে জোর করে নিয়ে গেল। যামিনী রায়ের পুত্র মণিদা ছিলেন, গাড়ি নিয়ে। তাঁর সংগে আমি আর নিখিল নাকতলা যাই। সেখানে পৌছেঁই সব মানুষের অবনত মাথা আর ফুলগন্ধ আমাকে ভীষণ জব্দ করে। তখনো তাঁর ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখিনি। সেখানে স্তব্ধতা আর মানুষের অসহনীয় ভীড়। কারুকে কাঁদতে দেখলেই আমার চোখে জল এসে পড়ে। বুকের ভেতরটা কেমন খালি-খালি লাগে। যেখানে সবার চোখে জল, মুখ বিষাদ-থমথমে, আমি সেখানে দাঁড়াতে পারি না। কেন এলুম? নিজেকে ভর্ৎসনা করতে থাকি, মনে মনে। অনহ্য এক বেদনার নীলরঙ আমার মুখে চোখে জুড়ে বসে। আমরা এক ঝলক তাঁকে দেখে, পাশে, দেবব্রতর ফ্লাটে চলে যাই। সেখানে গিয়ে অবিরাম সীধুপান চলে। গান হয়, চোখ জলে ভাসে- ওঁর সম্পর্কে কথা একেবারেই হয় না। যেন এক সমূহ দৃশ্য থেকে উদ্ধার পেতে, স্মৃতি থেকে পার- আমরা গলাধঃকরণ করতে থাকি অগ্নি। যা তাকেঁও, কিছুকাল বাদে, বৃত্তাকারে ঘিরে ধরবে। অনুমান করি।
কিছুক্ষণ বাদে স্টেসম্যান কাগজের অরণি আসেন, নরেশ গুহ তাকেঁ বুদ্ধদেব সম্পর্কে রচনা তৈরি করতে সাহায্য করেন। আমরা মাঝে মধ্যে শুনি। অরণির হাতের কাগজ পুড়ে যায় অকস্মাৎ। আমাদের মনে হয়, তিনি তাঁর সম্পর্কে কোনোরকম রচনাই চান না। আমরা ঐ ঘটনার পর, কেমন অন্যরকম হয়ে যাই। অরণি আবার শুরু করেন। নরেশদাকে বলিঃ এমন কোনো কথা বলবেন না যাতে ওঁকে আবার কাগজ পুড়িয়ে দিতে হয়!
সারাদিন আমরা আর ঐ খুপরি থেকে বেরুই না। কেউ কেউ বেরোয়। আমি, নিখিল আর মণিদা ঠায় বসে থাকি। সন্ধে নাগাদ ওরা কেওড়াতলা যায়, আমাকেও যেতে হয়। না যাওয়াই ভালো ছিল। সেখানে আমি, পরে শুনেছি, প্রচণ্ড গোলযোগ করেছি- যাতে কিছুতেই অগ্নি তাকেঁ স্পর্শ না করে- আমি এমন দাবী করেছিলুম পাগলের মতো। বলেছিলুম, ওঁর দেহ আমাদের দিয়ে দেওয়া হোক, আমরা কাছে রাখব।
পাগলের কথা কেউ শোনেনি। প্রতিবাদে সমস্ত পাগল স্থানত্যাগ করে সেদিন।
বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমাদের যোগাযাগ প্রায় বিশ বছরের। বিশ বছরের স্মৃতি একটা সার্থক পাহাড়। এখানে সেই শেষ দিনটির সামান্য চিত্র তুলে ধরা হল।

(শব্দমন্ত্র, বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা, তারিখ নেই। ১৯৭৪?)

আনন্দ রোজারিওর কবিতা/ ছায়া রোদ

আনন্দ রোজারিওর কবিতা
ছায়া রোদ

অশ্বশালার পাশে মায়া পড়ে আছে, একাকী নিখোঁজ
আমি কেন অপস্মার হেতু বৃক্ষের মন্দ্রিত খেদ
ব্রত করে গায়ে মাখি, মর্দিত আলো তালু জুড়ে
বিঘোষিত কেশ আর পীড়ক আধাঁর

জলের চিহ্ন দেখে ভয় পেতে ভালবাসি
তিনটি প্রবল হাঁস উড়ে আসে-
উড়ে যায় ক্রমশ ঈশানে
তারস্বরে ডেকে বলি, আয় ভাই, বেদনার দর্পিত বোন...

চুপি চুপি মেঘ খসে আসে, ঝরে নিহত প্লাবন

সেতুর উপরে আমি তাই ছায়া ভাঙ্গি, মনোনীত রোদ

Monday, December 15, 2008

কবিতা

আনন্দ রোজারিও
নৌকা বিলাস
(সুলেখাকে, অনেক সময় কেটেছে দুর্বাঘাসে-বনবাসে)

১.
যখন এসেছে মেঘ, তোকে বলি ,
বালিকার প্রকৃত গণিত ফুটে আছে গাছে
শিশির জমেছে পায়ে শ্যাওলায় ভরে আছে পথ
এই ক্ষণে এসেছি পালিয়ে
পুরনো স্বভাব মেনে মা তোমার-
নিরাপদ ছায়া থেকে ঝরে পড়ে নিভৃত খোলস

আমি এক গোপন সর্প দ্যাখো শ্রীমতি বিহনে কাদিঁ
আয়ুজলে বুনে রাখি সমূহ বিনাশ


২.
এসেছি পাতার কাছে হাত মেলে রাখি অন্ধকার
পায়ে পায়ে গ্রাম ভেঙে পড়ে
চোখে জমে জল
হাড়ের বেদনা জাগে দরোজার বিভুতি ছায়ায়
দূরে যেতে যেতে, তোকে বলি, নদী ও জলের কাছে
শুয়ে আছে ফুল চোর, অপরাহ্ণে নিহত বকুল


৩.
সুপারির গল্প শুনে রোজ রাতে শুতে চলে যাই
কতিপয় বালক আছে, তোকে বলি,
পথে যেতে যেতে তারা সব গোপাটের ছায়া পরিসর

তৃষ্ণা জমেছে দ্যাখো থেমে থেমে কষ্টে প্রবীণ

নাও বেয়ে যেজন গিয়েছে চলে
তার নামে গাই নাই বিলাসের গান



.....................................
বুনো পরি

তমসাকে বলি, করপুটে যে তোমার অন্ধকার জোনাকি
ভয়ার্ত গাড়ির মতো একবার জ্বলছে আর নিবছে
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে গলিত লাভা
আঙুলের পাশ দিয়ে খোলা বারান্দায় লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে তিনটি বালক,
হাতে কাশফুলের লম্বা তীর, উঠোন থেকে হা হা স্বর মাখা পথে
পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে অজগরের মতো তিরতিরে
আর্ত নদীর কাছে যেতে যেতে

তমসাকে বলি, চোখ লুকিয়ে বলছি- তমসা, এ রকম-
রৌদ্র উপড়ানো অন্ধকার ছিল বলে বাকেঁ বাকেঁ
তরল অন্ধকার তার ঘেরা টোপে বালকের চোখের বিস্ময়

নদীর অন্ধত্ব আমি, তমসাকে বলি, আমি সেই নিহত প্রদীপ

কবিতা

আনন্দ রোজারিও-র
কবিতা

নদী মরে গেলে সত্য হারিয়ে যায়
দু'পাড়ের মানুষের বুক থেকে ঝরে পড়ে
বয়সের মতোন এক একটা নিটোল স্বপ্ন
প্রতিটি গল্পের সাথে জেগে থাকে থাকে দীঘর্শ্বাস
এ রকম কথা আমাকে শুনিয়েছে একজন বুড়ো চাষি

আমি সেই থুত্থুড়ে বুড়ো চাষির বুকের ভেতরে
হাত দিয়ে দেখি-
অনেক দূরের সবুজ ধান
পুড়তে পুড়তে হলুদ হয়ে যায়

Wednesday, December 10, 2008

পরিযায়ি গান

পরিযায়ি গান
আনন্দ রোজারিও




আলোর উৎসমুখ যে তুমি হে ধেণু
পিপাসার্ত আমি, পান করাও তোমার কাম্যজল
হরষিত হোক ধূম উদ্গীরণের অগ্নি-
পুনর্বার স্নাত হই

দস্যুচিহ্নিত কোন ভূমি নয়
আমরা যেচে নিয়েছিলাম রাত্রিপ্লাবী ঘৃণা আর
পিতার মুর্খমুখোশ

পাহাড় থেকে যারা ফিরেছিলো ধ্বস্ত ছিল তাদের হস্তযুগল
অক্ষিকোটর থেকে উৎপাটিত তাদের চোখ
ত্রস্তকান্ত আমরা সবাই ছিলাম আয়ূধবিহীন
আমাদের পদতল থেকে একটু একটু করে ভেসে গিয়েছিল
একটি বাশিঁ আর ভেষজের নম্র বিজ্ঞান
তপোবন লুণ্ঠিত বলে আমাদের মাতৃনাম সহসা নিখোঁজ

তোমরা বলেছ বলেই নদীবক্ষে উঠেছে ঘূর্ণি
সহসা ধূলার আড়াল থেকে তবুও সরিয়ে নিয়েছ বস্ত্রাবরণ
সেই প্রথম আমরা জ্ঞাত হই- যৌনতায় কোন গন্ধভেদ নেই
দণ্ডহীন তামসবিকার, হে ধেণু, তারপর
রক্তপাত চলেছে কপট কীড়ায়- নগরে- ধর্মক্ষেত্রে- ঘুমন্ত শিয়রে
তবুও আয়ূষ্মান- তোমরাই কবি, আমরাতো প্রদোষের প্রতিবিম্বগণ

হে ধেণু, পশুচিহ্নিত নখাগ্রে কোন দূরনীরিক্ষ জ্যোৎস্না নয়
তখন চমকিত হয় আত্মহত্যার মতোন যৌনগন্ধী মেঘ
আর আমরা দাড়িয়ে রয়েছি প্রান্তর ছেড়ে খাদের কিনারে
যুযুধান মৃত্যুরহিত

তবুও প্রাণবন্ত করছ হে ধেণু, অবীজি ব্রীহি আর সুপক্ক গোধূমচূর্ণ
খল খল করে বয়ে চলেছে সে কোন খরসান নদী
তীরে তার অরণ্যচারী মৃগদল আর হৃতবান ফলবীথি

নিজেরই ছায়ার ভিতরে শুনছি দ্রিমি দ্রিমি গান
ঝলসিত মাংসে মেশাচ্ছি বহুকাল ধরে
আমাদের আনন্দিত কুন্দকুসুম
হে ধেণু, সে আমার বেদনার বনচর বোন

যতবার দেখেছি তাকে, ততবার অপসৃয়মান পিতা
চতুর্দিক থেকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন জায়মান চারটি প্রবল মুখ
আর হাহাকার

হে ধেণু, তৃষ্ণার্ত আমি, যাচমান অন্ধকারে
কুচভারে নত নই, আলোর উৎস ছেড়ে
যে তুমি আমার প্রতীম
আমাকেই উপ্ত করি আমার নিভৃতে